‘মহাদেবের মৃত্যু রহস্য’ –আমির হোসেন

সাহিত্য, 6 June 2022, 257 বার পড়া হয়েছে,
রাস্তার মোড়ে মোড়ে, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলিতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যমদূতের মতো চিৎকার করে ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে টহলরত সাঁজুয়া যান। ধর-পাকড়াও চলছে শহরের অলিতে-গলিতে। বিশেষ করে টুপি-টিকিওয়ালাদের তার্গেট করছে দাঙ্গা-পুলিশ। টুপিপক্ষ তাদের বড় মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে জমায়েত হয়েছে। যে কোনো সময় অন্যপক্ষের মন্দির ও তাদের দোকান-পাট ভাঙচুর করতে উদ্ধত তারা। টিকিপক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা ভাংচুর করার মতো সাহস না দেখোলেও প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরি করে আছে মন্দির-আশ্রমকে কেন্দ্র করে। শহরের প্রবীণ যারা তাদের মনে আছে, তারা দেখেছে-বিশ^যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের কারণে রাস্তায় রাস্তায় কঙ্কালসার মানুষকে বসে, নয়ত দাঁড়িয়ে ভিক্ষে চাইতে। কাউকে কাউকে ডাস্টবিন থেকে পঁচা আর উচ্ছিষ্ট জিনিস তুলে নিয়ে যেতেও দেখা গেছে। যত্র-তত্র পড়ে রয়েছে মরা মানুষের লাশ। ক্রমে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণ হয়েছে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মুখে শোনা যেতে লাগল দু‘ধরণের ¯েøাগান। একদিকে জয় হিন্দ্ আর ভারত মাতা কি জয়, অন্যদিকে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। খবর শোনা গিয়েছিল-কলকাতা আর বিহার মল্লুকে মুসলমানদের মেরে-কেটে সাফ করে দিচ্ছে হিন্দুরা আর মুসলমানরা ঢাকা, নোয়াখালি, বরিশাল ইত্যাদি অ লের নদ-নদীর পানি লাল করে দিচ্ছে হিন্দুর রক্তে। অর্থাৎ শুরু হয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সুবিধাজনক স্থানে সবাই সবাইকে মেরে বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ লুট করে নিচ্ছে। এই খবরের ভিতর দিয়েই খবর শুনেছিল যে, ব্রিটিশ রাজের দিন শেষ। তাদের ভারত স¤্রাজ্যকে পাকিস্তান আর হিন্দুস্থানে ভাগ করা হয়ে গেছে। পাকিস্তানে হিন্দুর জায়গা নেই আর হিন্দুস্থানে মুসলমান থাকলে বেঘোরে মারা পড়বে। শুরু হয়ে গেল বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি ফেলে বউ-বাচ্চা, ভাই-বোন ও মা-বাবাকে নিয়ে দেশান্তর। উভয়েরই বিপরীত দিকে যাত্রা। রাতা-রাতি সর্বস্ব হারানোর যে নিদারুন কষ্ট তা ভুক্তভোগি ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারে নি। এরপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানও আর থাকল না। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও দু‘লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে এ দেশ স্বাধীন হল। সে অনেক কথা, যে মহান নেতার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হল, তাঁকে সপরিবারে হত্যার মাধমে পঁচাত্তর পরবর্তিতে আবার এদেশের মাটিতে রোপিত হল সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের কাল্পনিক সেই বীজ। সেই বিষবৃক্ষই এখনও মাঝে মাঝে ছড়িয়ে দিতে থাকে তার বিষাক্ত ফল। তাই দেশের এরকম মফস্বল শহরগুলিতেও সামান্য কারণেই দেখা দেয় নোয়াখালি-বরিশাল কিংবা ঢাকার রায়ট বা দাঙ্গার প্রতিরূপ। না প্রতিপক্ষের মতো সমানে সমান না হলেও এখন প্রতিবেশি দেশে ধর্মাশ্রয়ী সরকার ক্ষমতায় আছে সেই ভরসায় এদেশে সংখ্যালঘু পক্ষটাও পাল্টা দাঁড়াতে ততটা ভীত নয়। উত্তেজনা চলছে। রণসাজে সজ্জিত হয়ে আছে স্ব স্ব ধর্মপ্রাণ জনতা। পাঠকগণের অনেকে হয়ত অনুমান করে নিয়েছেন আবার হয়ত রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দাঙ্গা। রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত যে ধর্মীয় দাঙ্গা তার ইতিহাসই বা জানে ক‘জন ধর্মীয় দাঙ্গাকারি। রাম মন্দির ত বাল্মীকি রচিত রামায়ণ নামক মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত একটি পৌরাণিক ও কাল্পনিক স্থাপনা। সে মহাকাব্যের একটি চরিত্র রাজা রামচন্দ্র। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পূর্বে ষোড়শ পুরুষ হতে ধারাবাহিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার যুগ, বৈদিক যুগ, মহাকাব্যের যুগ পার হয়ে যত রাজনৈতিক চরিত্রের কথা জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত থেকে শুরু করে নেহেরু, সুভাষচন্দ্র পর্যন্ত রামচন্দ্রকে তাদের মধ্যে কোনো কাল বা সময়ের সীমায় ফেলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, কবি বাল্মীকিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো। অপরপক্ষে বাবরি মসজিদ রক্ষার নিরঙ্কুশ সমর্থনকারিরা ধরেই নিয়েছেন যে এ মসজিদ স¤্রাট বাবর নির্মাণ করেছেন। তাদের মনে স্বাভাবিক ধারণা জন্মেছে যে বাবর যেহেতু গোঁড়া মুসলমান তাই স¤্রাটের পক্ষে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ স্বাভাবিক। তাই উভয় পক্ষই ঐতিহাসিক সত্যের চেয়ে তাদের ধর্মীয় চেতনাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। আর সঙ্কটে বারবার ঘটেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। জান-মালে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উভয় দলই। না এ দাঙ্গাভিমুখিতার কারণ রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে নয়। এ দাঙ্গা টিকিওয়ালাদের মহাদেবকে হত্যা করা হয়েছে। এবং হত্যা করেছে অবশ্যই টুপিওয়ালারা।
মহাদেবের মৃত্যু সংবাদে আসন্ন দাঙ্গা-খাঙ্গামা সংঘটনের বিষয়টি আঁচ করতে দেরী হয় নি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কতৃপক্ষের। সে জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের জন্য এর পোস্ট মর্টেম করে রিপোর্ট অনুসারে অপরাধীদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াসের কথা শোনানো হলেও মানবে কেন মহাদেব ভক্তরা। পোস্ট মর্টেমের কাটা-চেরা করা! মহাদেবের এমন অসম্মান মানবে কেন তারা? তারপরেও পশু বিভাগের সার্জনের কাটা-চেরাবিহীন প্রাথমিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেল যে মহাদেব বিষপানে মরেছে। এ বিষ কি মহাদেব নিজে পান করেছে না অন্য কেউ তাকে পান করিয়েছে সে বিষয়ে পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মহাদেবের মত্যুতে পুলিশ কেস হবে এ খবর দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে টুপিওয়ালের কাছে। তারা যেন জিহাদ-যুদ্ধের জন্য সদা-সর্বদা রণ সাজে সজ্জিত হয়েই থাকে।  সুতরাং আর যায় কোথায়। সামান্য মালাওয়ানের বাচ্চারা করবে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি-মামলা। তা মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। আসন্ন এ মামলার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া তাদের ঈমানি দায়িত্ব। অতএব নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মালাওয়ানদের বিভিন্ন মন্দির-আশ্রমের উপর। হামলা-পাল্টা হামলায় কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াসহ আহত হয়েছে বেশ ক‘জন। আঘাত প্রাপ্ত হয়ে আহত হওয়া থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বাদ যায় নি। একদিকে শহরের টুপিওয়াদের সামলানো সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা আর অন্যদিকে ক্ষমতাধর প্রতিবেশি দেশের রাষ্ট্রদূত-এম্বাসিডরগণের চাপে চেপা শুটকি হতে বসেছে সদাশয় পুলিশ সুপার মহোদয়। তাঁর মাথার উপর সাতহাত পানি। দু‘দিকের চাপ ছাড়াও আছে বিভাগীয় রেঞ্জের ডিআইজি মহোদয়ের তদারকির চাপ। বাধ্য হয়েই তিনি থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের মাধ্যমে তার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন লাটিচার্জসহ ধর-পাকড়াও করতে। ধৃতও হয়েছে কম না। এত হাঙ্গামা ধ্বংস-যজ্ঞ যাকে নিয়ে কে সেই মহাদেব? মহাদেবকে আবার সাধারণ মানুষই মেরে ফেলল কিভাবে?
রক্ত-মাংসের মানুষ কতৃক কি করে সম্ভব মহাশক্তিধর ও মৃত্যুঞ্জয়ী মহাদেবকে হত্যা করা!সম্ভব না, তবে সম্ভব হয়েছে। মহাদেব সংক্রান্ত জনশ্রæতির যে ধু¤্রজাল দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচলিত বিশ^াসের আবরণে প্রচারিত হয়েছিল, সেই বিশ^াসেরই বা কি অর্থ দাঁড়াল। বিশ^াসীদের কাছে তো মহাদেব ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী এবং মহাশক্তিধরই। তার অমরত্ব বিষয়ে লোকশ্রæতিরও কি কোনো অন্ত ছিল! প্রথমত ধু¤্রজালটি ছিল মহাদেবের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে। মহাদেব কখন, কিভাবে, কার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে,  সে বিষয়ে নাকি কেউ বলতে পারে না। কেউ কখনো প্রত্যক্ষ করে নি তার জন্মগ্রহণ ক্ষণ বা দৃশ্য। এবং তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভবও না। তার জন্ম অন্য আট-দশটা স্বাভাবিক জন্ম ঘটনার মতো নয়। তার জন্ম বিশ^াসের আবরণে মোড়া। তা সাধারণ চোখে প্রত্যক্ষ করা মোটেই সম্ভব না। সে রাত হলে বেশির ভাগই মন্দিরে থাকে, দিনে শহরময় ঘুরে ফিরে বেড়ায়। কখনও কখনও খেয়াল-খুশিমত অন্যকোন সুবিধাজনক স্থানেও রাত কাটায়। খাবার খাদ্যের সন্ধানে কখনও কখনও তাকে শহরতলিতে যেতেও দেখেছে কেউ কেউ। তবে সে কালভৈরবী মন্দিরেরই সম্পদ। তাকে মহাশক্তিধর ও মৃত্যুঞ্জয়ী মহাদেব ভেবেই সম্মান দেখানো হয় এবং সেমতো পূজা-আর্চনা করা হয়। ঠাকুর পুজার মতই তার জন্য বিশ^াসীরা অত্যন্ত ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে সব সময় যজ্ঞ-নৈবদ্য দিয়ে তার খাবার-খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের আয়-উন্নতি ও সন্তান-সন্ততির রোগ-বালাই হতে মুক্তি পেতে নিয়মিত তার শরীর বুলানো হাত নিজেদের নাকে-মুখে-গাড়ে মুছে নিয়েছে। যে কোনো শুভ কাজে হাত দেওয়ার পূর্বে এমনকি সন্তানের পরীক্ষা কক্ষে যাবার পূর্বে ভাল ফলাফলের লক্ষে মহাদেবের শরীরের হাত বুলিয়ে তাকে ভাত-কলা-চাল ইত্যাদি নৈবদ্যে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছে। সেই সাথে বিশ^াসীদের দ্বারা শহরময় ছড়িছে মহাদেব সম্পর্কে রহস্যঘেরা বিশ^াসের ধু¤্রজাল। রহস্যময়ী এ মহাদেব সম্পর্কে বিশ^াসের ধু¤্রজালের কারণে শহরময় সে হয়ে উঠেছে কিংবদন্তির নায়ক। তার সম্পর্কে প্রচলিত বিশ^াসের যেন শেষ নেই। জানা যায় যে, মহাদেব কখনো অপরিচ্ছন্ন জায়গায় খাবার খেতো না। এবং সবার নিকট থেকে খাবার গ্রহণও করত না। তবে যার নিকট থেকে খাবার খেতো বা যার দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বাড়ি-ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হতো, তারা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন। এবং সাধ্যমত তাকে ফল-মূল, শাক-সবজি, মিষ্টি-পাঁয়েশ ইত্যাদি খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই মহাদেবকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবিশ^াসী চোরেরা তাকে অনেকবার চুরি করার চেষ্টা করেছে। জানা যায় চুরির উদ্দেশ্যে চোরেরা রাতের আঁধারে দীর্ঘ সময় নৌকা চালিয়ে নদী পার হয়ে যেখান থেকে রওয়ানা দিয়েছিল সেখানেই ফিরে গিয়েছে। কিংবা তাকে চুরির উদ্দেশ্যে কখনও বড় নৌকায় তুলেছে। কখনও ট্রাকে উঠিয়েছে। তারপর সারা রাত ব্যাপী চেষ্টা করা হয়েছে। নৌকা ও ট্রাকের ইঞ্জিন কোনভাবেই স্ট্রাট নেই নি। অগ্যতা চোর সম্প্রদায় কয়েক লক্ষ টাকা মূল্যের মহাদেবকে চুরির আশা পরিত্যাগ করে নামিয়ে দিয়ে পালিয়েছে। কোনো কোনো চোরেরা আবার মনে করেছে যে, মহাদেবকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও তাকে জবাই করা অসম্ভব। জবাই করলে কিছুদিনের মধ্যেই তাদের বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। কেউ কেউ তাকে চুরি করে দূরে দত্তখোলার বিলের কাছে নিয়ে গভীর রাতে নাকি জবাই করার প্রস্তুতিও নিয়েছিল। ইস্পাতের ধারালো চকচকে ছুরি তার রক্ত-মাংসের গলায় চালাতে গিয়ে পাথরের মতো ঠেকেছে। উপরন্তু জবাইকারি অলৌকিক কোনো আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মহাদেবের গলার নিকট হতে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েছে। সাথি চোরেরা জান রক্ষার্থে দৌড়ে পালিয়ে এসেছে এবং তারা প্রচার করেছে যে এ মহাদেব অবশ্যই মৃত্যুঞ্জয়ী ও মহাশক্তিধর। তাকে হত্যা বা জবাই করা কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। কিংবদন্তির সেই মহাদেবকে হত্যা করা হয়েছে। এবং করেছে তার শক্তি সম্পর্কে অবিশ^াসী টুপিওয়ালারা। সুতরাং তাদেরকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। নয়লে তাদের ধর্ম থাকে না। অপর পক্ষই ছেড়ে দেবেন কেন? অতএব দাঙ্গা অনিবার্য। আর অনিবার্য এ দাঙ্গার ভয়াবহ দৃশ্য সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে। তবু রক্ষা যে এ দাঙ্গা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পরে নি। সদাশয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠিন হস্তক্ষেপে এ শহরের দাঙ্গার ভয়াবহতা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এসেছিল। উভয় পক্ষকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ^াস দেওয়া হয়েছিল পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে মহাদেবের হত্যাকরির বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।
সে মতো চলল জোর তদন্ত। তদন্তের ভার গ্রহণ করলেন সদর কোতয়ালি থানার অফিসার্স ইনচার্জ স্বয়ং। তিনি আঠারশ আটানব্বই সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৭৪ ধারা মোতাবেক পা হতে মাথা পর্যন্ত অপমৃত্যু বরণকারি মহাদেব ও তার মৃত্যু স্থানের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করলেন। এরপর প্রশাসনের পরামর্শ অনুযায়ী মহাদেব ভক্তরা বড় একটি ট্রাক নিয়ে তিতাসপাড়ায় যায়। বড় বড় বাঁশ ও কাছি দড়ি দিয়ে বেঁধে বিশেষ কায়দায় মহাদেবের লাশ নিয়ে আসা হয় কালভৈরবী মন্দিরের কাছে। লক্ষ লক্ষ টাকার নৈবদ্য সাজিয়ে হিন্দু-বুদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ শত শত ভক্ত-বৃন্দের উপস্থিতিতে শহরের নামকরা সব পুরোহিদদের পৌরহিত্যে যথাযোগ্য মর্যাদায় মন্দিরের পাশে সমাধিস্থ করা হয় মহাদেবকে। আর অফিসার্স ইনচার্জ মহোদয় তদন্তের স্বার্থে মহাদেবের বিচরণের সম্ভাব্য স্থানগুলি সম্পর্কে ডাটা সংগ্রহ করলেন। হত্যার সাথে কারা কারা যুক্ত থাকতে পারে সম্ভাব্যদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে জরুরী ভিত্তিতে মাত্র এক মাসের মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট তৈরী করা করলেন। জিডি তদন্ত রিপোর্টের প্রত্যাশায় শহরের সন্দেহভাজনদের গং হিসেবে আসামী করে ফৌজদারী কার্যবিধির প ান্ন ধারা অনুসারে মামলা রজ্জু করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে দেখা গেল মহাদেব মৃত্যু বরণ করেছিল শহরের একেবারে উত্তরের তিতাসপাড়া সংলগ্ন তিতাস নদীর তীরে। যেদিন সকালে মহাদেব মৃত্যু বরণ করে তার আগের দিন বিকেলে মহাদেবকে বেশ কয়েকজন দেখেছে শহরের একেবারে দক্ষিণের শহরতলির গ্রাম ভাদুঘরের পশ্চিম দিকের মাঠের দিকে যেতে। ভাদুঘরের সর্ব দক্ষিণে কা নপুর গ্রাম। সে গ্রামে দেশান্তরি হতে হতে এখনও শতাধিক ঘর রয়েছে কৈবর্ত শ্রেণি। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই কৈবর্তই জল আর জাল নির্ভর। অর্থাৎ মৎস শিকার যাদের জীবিকার উৎস। বাদ বাকি ক‘ঘর আছে আংশিক মৎস শিকার ও আংশিক কৃষি নির্ভর কৈবর্ত। কা নপুরের চিনিবাশ দাস এমনই একজন কৈবর্ত। যারা বছরের কিছুটা সময় থাকে জাল আর জল নিয়ে আর কিছুটা সময় থাকে সামান্য কিছু কৃষি জমি নিয়ে। বছরের এই সময়টা বিশেষ করে ফাল্গুন-চৈত্র এই দু‘টি মাস জেলেরা দুঃসহ জীবন-যাপন করে। নদী-নালা, খাল-বিল এ সময় জলশূন্য হয়ে পড়ে। খাল-বিলের তলদেশে ফাটল ধরে। জেলে জীবনে খাদ্যাভাব চৈত্রের শেষে এমন রূপ নেয় যে, একে দুর্ভিক্ষও বলা যেতে পারে। পুরুষেরা নিষ্কর্মা দিন কাটায়। বাচ্চাকাচ্চারা ক্ষুধার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ঘন ঘন মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তখন কৈর্বত্য দাসদের দারুন দুর্দিন কাটে। কিন্তু মৎস শিকার ও কৃষি নির্ভর এই কৈবর্ত্যরা এ সময়টাতে কৃষি কাজেই সময় কাটায়। চিনিবাশ দাসেরও রয়েছে গ্রামের পশ্চিম দিকের মাঠে দু‘বিঘা জমি। এর একটিতে সরিষা বোনা হয়েছিল। সরিষাও ভাল ফলন হবে বলে আশা করা যাচ্ছিল। সরিষার ছড়ায় পাক ধরতে আর সপ্তাহ দুই সময় লাগবে। এ ফসলটি ঘরে তুলে একই জমিতে ইস্কিমের পানিতে আমনের চারা রোপন করবে। এমন সময় সরিষার গাছে এক ধরণের ক্ষতিকর মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা গেল। চিনিবাশ স্থানীয় কৃষি অফিসারের পরামর্শ মতে পোকা দমনের জন্য হেনিজল নামের এক প্রকার কিটনাশক ঔষধ এনেছিল। এলাকায় সংখ্যালুঘু মানুষ সে। তাই পান থেকে চুন খসলে সম্ভাব্য বিপদ ঘটতে পারে সে কথা মাথায় রেখে সে দিনের বেলায় জমিতে সেই ঔষধ ছিটায় নি। সে চিন্তা করেছিল তখনও  যেহেতু ফাল্গুন মাস আসেনি। রাতের বেলায় কিছুটা কূয়াশা পড়ে জমিতে। সেহেতু সন্ধ্যা বেলায় জমিতে পোকার বিষ প্রয়োগ করলে রাতে কারো গরু-বাছুর জমির সরিষা গাছ খাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেয়। তাছাড়া সারা রাতের কূয়াশার জলের সাথে ছিটানো বিষ গাছের উপর আর থাকবে না। মাটিতে পড়ে যাবে। সে জন্য চিনিবাশ সন্ধ্যা রাতে তার জমিতে পোকা মারার বিষ ছিটিয়েছিল। কিন্তু সে রাতে যে স্বয়ং মহাদেব এসে তার জমির সরিষাসহ অন্যান্য আগাছা ও ঘাস খেয়ে যাবে সে কথা কশ্চিন কালেও চিন্তা করে নি চিনিবাশ। মহাদেব মারা যাবার খবর শহর পার হয়ে শহরতলির কা নপুর গ্রামেও পৌঁছেছিল। বিশেষ করে বিষপানে মহাদেবের মৃত্যু হয়েছে এ সংবাদে অন্তরাত্মা নড়ে গিয়েছিল চিনিবাশের। তার ভিতরের মানুষটি তাকে সতর্ক করে বলেছিল কি সর্বনাশ করলিরে চিনিবাশ। তোর ত বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। চিনিবাশ পরের দিন তার জমিতে গিয়েছিল। সেখানে গরুতে ফসল খাওয়া ও নষ্ট করার আলামত সে দেখেছে। তখন তার মনে সুনিশ্চিত বিশ^াস জন্মেছে যে তার জামির বিষযুক্ত সরিষা গাছ ও অন্যান্য ঘাস খেয়েই মহাদেবের মৃত্যু হয়েছে। অতএব এ অপরাধের শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এবং সে শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন। এছাড়া মহাদেব নামের ষাড়টির মৃত্যু নিয়ে দাঙ্গা এবং কেস-মামলার খবরও শুনেছিল চিনিবাশ দাস। সে জেনেছিল সদর মডেল থানার অফিসার্স ইনচার্জ মহাদেবের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের জন্য তদন্ত করছেন। মহাদেব মৃত্যুর পর পনের-বিশ দিন যাবৎ রাতে ঘুমুতে পারে না চিনিবাশ। খাওয়া-দাওয়াও করতে পারে না ঠিক মতো। পাপবোধ এবং সেই সাথে আসন্ন শাস্তির ভয়ে অন্ন-জল প্রায় ছেড়ে দিয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে চিনিবাশ। এ পাপবোধের প্রতিক্রিয়ায় একদিন সকলের অগোচরে সে গিয়ে হাজির হয় সদর থানায়। সরল মনে খুলে বলে তার জমিতে মাজরা পোকা পড়া ও এর কবল থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষি অফিসারের পরামর্শ অনুসারে জমিতে হেনিজল বিষ প্রয়োগ করার কথা। তবে কারো গরু-বাছুরের যাতে করে কোনরূপ ক্ষতি না হয় সে জন্য সে সন্ধ্যার পর এ বিষ প্রয়োগের বিষয়টিও প্রকাশ করে। সেই বিষই কি খেয়েছিল কিনা মহাদেব তা সে নিশ্চিত করে বলতে পারে না। যদি তার জমির বিষপানে মৃত্যু হয় মহাদেবের, তাহলে ত তার ইহ এবং পর উভয়কালই নরকের আগুনে জ¦লতে হবে। অতএব সদাশয় অফিসার ইনচার্জের তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হলে মাননীয় আদালতের বিচারে তার শাস্তি হলে তা সে মাথায় পেতে নেবে। পর জনমে না হোক, এ জনমেতো পাপের ভার কিছুটা হলেও কমাতে পারবে।
চিনিবাশের বক্তব্যের সূত্র ধরে ভাদুঘর-কা নপুরের বেশ কয়েকজন মানুষের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অফিসার্স ইনচার্জ নিশ্চিত হন যে ষাড়টি চিনিবাশের জমিতে ছিটানো হেনিজল বিষ পান করেই মৃত্যুবরণ করেছে। যথাসময়ে জিডি তদন্ত রিপোর্টটি মেজিস্ট্রেট আদালতে স্থানান্তরিত হল। এবং যথাসময়ে মামালাটি ফৌজদারি আদালতের মেজিস্ট্রেট কোর্টে শোনানির জন্য ওঠল। টুপিওয়ালা ও টিকিওয়ালাদের নেতৃত্বস্থানীয়রাসহ শহরের অনেক মান্য-গণ্য ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম হলো আদালত প্রাঙ্গন। বিচারক তদন্ত রিপোর্টের বিস্তারিত পাঠ করে মহাদেব মৃত্যুর রহস্য প্রকাশ করেন ও মামলার রায় প্রদান করেন। রায়ে ফসল রক্ষার জন্য চিনিবাশের মাজরা পোকা দমন নাশক হেনিজল ছিটানো আইনের পরিপন্থি নয় মর্মে সেসহ মামলার সকল আসামীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রত্যাহার করে ফৌজধারি কার্যবিধির দুইশত একচল্লিশের-ক ধারায় আসামীদের অব্যাহতি দেন। এবং মহাদেবকে নিয়ে সকল অবৈজ্ঞানিক ও প্রচলিত লোকবিশ^াস ভিত্তিহীন ও মহাদেব একটি সাধারণ ষাড় গরু এ মর্মে রায় প্রকাশ করেন। এছাড়া এই গরুটিকে নিয়ে পরবর্তী কোনো দাঙ্গা-ফ্যাসাদ থেকে বিরত থাকার জন্য স্থানীয় আইন প্রয়োগকারি সংস্থার মাধম্যে উভয় পক্ষকে নির্দেশ প্রদান করে বহুল আলোচিত এ মামলাটি ডিসচার্জ করে দেন। আদালত প্রাঙ্গন ত্যাগ করতে করতে কারো কারো মুখে রসাত্মক বক্তব্য শোনা গেল, কত রঙ্গ দেখাইলারে মহাদেব, রঙ্গ দেখাইলা কত। অথচ তুমি সামান্য বিষ মিশ্রিত ঘাসও পরখ করে খেতে জানলা না।
”গল্প মহাদেবের মৃত্যু রহস্যলেখক : আমির হোসেন, কবি ও কথাসাহিত্যিক