মানবজীবনে যেসব উপকরণ যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত করেছে তার অন্যতম হচ্ছে সংবাদপত্র। আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিহার্য। সংবাদপত্র যে সকল সংবাদ পরিবেশন করে তা নয়, জনমতের প্রতিফলন ও জনমত গঠনেও সংবাদপত্রের রয়েছে ইতিবাচক ভূমিকা। গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার সংবাদপত্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবেও কাজ করে। এভাবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধ। কাজ করে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে।
আধুনিক সংবাদপত্রের ভূমিকা কেবল সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেশ-বিদেশের রাজনীতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সংবাদ ছাড়াও তা পরিবেশন করে বিচিত্র তথ্য-প্রতিবেদন। শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য এবং সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদন জগেতের বিচিত্র কর্মধারা এখন সংবাদপত্রের আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি ও রাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ইতিহাস ও ভূগোল, ধর্ম ও দর্শন, ব্যবসা ও বাণিজ্য সবই এখন সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। সংবাদপত্রের থাকে শিশু-কিশোর ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা বিভাগ, মেয়েদের জন্য আলাদা পাতা, থাকে জনজীবনের সমস্যাভিত্তিক চিঠি পত্রের কলাম। কোনো কোনো পত্রিকা আবার পাঠকদের নিয়ে গড়ে আলাদা ফোরাম। কোনো কোনো পত্রিকা বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে জনমত জরিপ করে এবং সরকার ও জাতিকে পরামর্শ দেয়। সব মিলিয়ে সংবাদপত্র এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চলমান নির্দেশিকা।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই জনগণ জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও সরকারের নীতি ও কর্মপন্থা সম্পর্কে জনগণ অবহিত হয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে। ক্ষমতাসীনরা সবসময় তাদের পদক্ষেপকে জোর সমর্থন করেন আর বিরোধীরা তার সমালোচনা করেন। কিন্ত সংবাদপত্র উভয় পক্ষের মতামত, যুক্তি ও তথ্য-নির্ভর আলোচনা প্রকাশ করে পাঠকদের নিজস্ব অভিমত গঠনে সাহায্য করে। সংবাদপত্রের পাতায় জ্ঞানীগুনী ও বিশেষজ্ঞদের লেখা প্রবন্ধ ও অভিমত গঠনে সাহা্য্য করে। এভাবে সরকারের জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপকে সমর্থন ও গনবিরোধী নীতির সমালোচনায় সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বর্তমানে আমাদের দেশে পাঠক্রমভিত্তিক এবং পরীক্ষানির্ভর সার্টিফিকেটমুখী শিক্ষায় শিক্ষার্থীর জ্ঞানের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়েছ। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা পরিণত হয়েছে নোট ও গাইডনির্ভর মুখস্থ বিদ্যায়। অন্যদিকে সংবাদপত্র এথন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রকেই তার আওতায় এনেছে। ফলে তাতে কেবল দৈনন্দিন জগতের খবরাখবর খাকে না, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্য, খেলাধুলা, বিনোদন, স্বাস্থ্য, চাকরি, জীবিকা ইত্যাদি সম্পর্কেও নানা তথ্য থাকে। নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের মাধ্যমে বহুমুখী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়। এতে জনগণের জ্ঞানের ক্ষেত্র যেমন সম্প্রসারিত হয় তেমনি ভাষাজ্ঞানও বাড়ে। তা ছাড়া দেশ ও জাতির সমস্যা-সম্ভাবনা সম্পর্কে তাঁরা অবগত হন। তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক সচেতনতা জাগ্রত হয়। আর্ন্তজাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সম্প্রীতিবোধের প্রসার ঘটে। এভাবে সংবাদপত্র জনগণের সর্বতোমুখী শিক্ষায় অবদান রাখে।
সংবাদপত্রের ইতিবাচক দিকের মতো কিছু সীমাবদ্ধতাও চোখে পড়ে। এখন অনেক সংবাদপত্র বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর কিংবা রাজনৈতিক দলের স্বার্থকেই বড়ো করে দেখে। তা ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ সংবাদপত্রই পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। জনস্বার্থের চেয়ে বাণিজ্য-স্বার্থই এদের কাছে মুখ্য। তা ছাড়া এক শ্রেণির সংবাদপত্রই পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। জনস্বার্থের চেয়ে বাণিজ্য-স্বার্থই এদের কাছে মুখ্য। তা ছাড়া এক শ্রেণির সংবাদপত্র হীন স্বার্থে রাজনীতিক বিভেদ সৃষ্টি ও বল্গাহীন মিথ্যা প্রচারে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে ব্যস্ত। এই প্রেক্ষাপটে দায়বদ্ধ নিরপেক্ষ সাংবাদিক আদর্শও নস্যাৎ হচ্ছে। এটি দেশ ও জাতির জন্যে কল্যাণকর নয়।
বর্তমানে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মানব উন্নয়ন এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতেও সংবাদপত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উন্নততর জীবন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আগ্রহ সৃষ্টিতে সংবাদপত্রের দায়িত্ব কম নয়। আমাদের দেশে রয়েছে ব্যাপক নিরক্ষরতা ও সামাজিক পশ্চাৎপদতা। এই প্রেক্ষাপটে সমাজ-জীবনে আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও বিজ্ঞানমুথী চেতনার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা হতে হবে কল্যাণমুখী। দলীয় স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊধ্বে উঠতে হবে সংবাদপত্রকে। গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন সুশীলসমাজ গড়ার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে। জনস্বার্থ ও মানবতার পক্ষে অবস্থান নিলে সত্যিকার অর্থে সংবাদপত্র হয়ে উঠবে জনগণের কন্ঠস্বর।
– আদিত্ব্য কামাল বার্তা সম্পাদক, জনতার খবর।