সাবিনার স্বপ্ন নিভে গিয়েছিল লণ্ডনের এক পার্কে

সোসাল মিডিয়া, 20 September 2025, 56 বার পড়া হয়েছে,

কিডব্রুক। লন্ডনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আধুনিক নগরায়নের ছায়ায় গজিয়ে ওঠা এক নিস্তরঙ্গ উপশহর। নতুন নির্মিত অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, শিশুদের খেলার পার্ক, হাঁটার পথ, কফিশপ; সব মিলিয়ে এক সাজানো-গোছানো নিঃশব্দ বসতি। এখানেই বসবাস করতেন এক বাঙালি তরুণী, যিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা, যাঁর প্রাণ ছিল শিশুদের হাসিতে, স্বপ্ন ছিল শিক্ষা দিয়ে বদলে দেওয়ার।

এলাকা ঘিরে ক্যাটর পার্ক, যার প্রশস্ত সবুজ ঘাসের চাদরে ছায়া ফেলে শতবর্ষী ওক গাছেরা। এই পার্কেই ছিল একটি গোপন অন্ধকার কোণ, যেখান থেকে একদিন ভোরে উঠে এসেছিল এক মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর।

২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, একটা খুব সাধারণ শনিবার সন্ধ্যা। ঠিক ৮টা ১৫-তে এ তরুণী ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ মিনিট দূরের একটি রেষ্টুরেন্ট-এ তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। হাতে ছিল মোবাইল, পরনে ছিল প্রিন্টেড ম্যাক্সি ড্রেস। যেভাবে প্রতিদিন হাঁটেন সেভাবেই হাঁটছিলেন। কিন্তু তিনি আর পৌঁছালেন না।

দুদিন পর, পার্কের এক কোণে একটি লাল পাতা ঝরা গাছের নিচে পাওয়া গেল তার নিথর দেহ। মাথা থেঁতলানো। পাশে পড়ে ছিল লোহার একটি পাইপ। এ যেন আধুনিক লন্ডনের বুকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা।

সাবিনা নেছা। জন্ম- ১৯৯৩ সালের ২৩ জুন লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে। বাবা-মা এসেছেন বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলা থেকে। বাবা আব্দুল নূর আগে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। মা আজমিন নেছা গৃহিণী। সাবিনা পাঁচ বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় বোন জেবিনা, ছোটরা রেবেকা, শারমিন ও নাদিয়া।

গ্রিনউইচ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় ডিগ্রি শেষ করে কাজ শুরু করেন রুসেল প্রাইমারি স্কুলে। সাত-আট বছরের বাচ্চাদের ইংরেজি ও গণিত পড়াতেন। শিক্ষার্থীরা তাকে ভালোবেসে ডাকত “মিস সাবিনা”। তিনি শুধু শিক্ষিকা নন, বন্ধু, অভিভাবক ও অনুপ্রেরণা ছিলেন।

তাঁর এক স্বপ্ন ছিল- একদিন বাংলাদেশে একটি শিশু শিক্ষা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করবেন। যেখানে ব্রিটেন ও বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত সেতুবন্ধন হবে।

তিনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। নিজের একটি পরিবার গড়তে চেয়েছিলেন। জীবনটাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তার সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল মাত্র ২৮ বছর বয়সেই। ১৫ বার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল তাকে। যেন কেউ রাগে, ঘৃণায় তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল।

যে ব্যক্তি তাকে হত্যা করে, তার নাম কোচি সেলামাজ। আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিক। বয়স ৩৬। একসময় পিজ্জা ডেলিভারি করতেন, পরে বেকার। মানসিকভাবে অস্থির, সহিংস আচরণের ইতিহাস আছে।

সেদিন সন্ধ্যায় সাবিনার গতিবিধি লক্ষ্য করেই পার্কের নির্জন কোণে অপেক্ষা করছিল সে। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, তাকে আক্রমণ করার আগে সে ২০ মিনিট ধরে ওই এলাকাতেই ঘোরাফেরা করছিল। তার হাতে ছিল প্রায় দুই ফুট লম্বা একটি লোহার পাইপ।

৮টা ৩০ মিনিটে, যখন ক্যাটর পার্কের আলো কিছুটা কমে এসেছে, তখনই সে আক্রমণ চালায়। সাবিনার উপর সে যেন এক পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৫ বার আঘাত করে তার মাথা থেঁতলে দেয়। তারপর সাবিনাকে অচেতন অবস্থায় পার্কের এক কোণে নিয়ে গিয়ে গলা টিপে হত্যা করে। তার দেহ ঘাস ও পাতা দিয়ে আড়াল করে রেখে দেয়।

পরদিন সকালে এক কুকুর হাঁটাতে বের হওয়া এক পথচারী দেহটি আবিষ্কার করেন। পুলিশ জানায়, সাবিনার ফোন, ঘড়ি, পার্স কিছুই খোয়া যায়নি।

খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই সাবিনার পরিবার ভেঙে পড়ে। লন্ডন জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। মেয়েরা রাস্তায় নামে মোমবাতি নিয়ে। তারা বলে—”আমরা আর চুপ থাকবো না।”

ইস্ট লন্ডন মসজিদে জানাজায় অংশ নেন শত শত মানুষ। কেউ সাবিনার ছবি বুকে চেপে ধরেছিল, কেউ হাত ধরে বলেছিল, “আমরা তোমার জন্য ন্যায় চাই।”

২৯ সেপ্টেম্বর, পুলিশ কোচি সেলামাজকে ইস্টবোর্নের একটি গ্যারেজ থেকে গ্রেফতার করে। ডিএনএ পরীক্ষায় সাবিনার রক্ত ও চুল তার গাড়িতে পাওয়া যায়। তার ফোনের লোকেশনও ঘটনাস্থলের সাথে মেলে।

আদালত তাকে “high risk offender” হিসেবে চিহ্নিত করে। তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, কমপক্ষে ৩৬ বছর জেলে থাকতে হবে।

সাবিনার বড় বোন জেবিনা বলেন, “আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম—কী ভয়ঙ্কর এক জন্তু সে! কেন এমন নির্মমভাবে আমার বোনকে হত্যা করল?”

আন্তর্জাতিক মিডিয়া যেমন নিউ ইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা সাবিনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট করে। এই হত্যাকাণ্ড ব্রিটেনে নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে ঝড় তোলে। সরকার ২০২৩ সালে “Women’s Safety Act” পাস করে, যাতে রাস্তায় হয়রানি, সিসিটিভি, নারীদের জন্য হটস্পট চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়।

তবে আন্দোলনকারীরা বলে: “পুলিশ মেয়েদের ‘সতর্ক’ হতে বলে, ছেলেদের আচরণ বদলাতে নয়। মনোভাব না বদলালে আইন একা কিছু করতে পারবে না।”

উল্লেখ্য, ব্রিটেনে ২০২১-২২ সালে নারী হত্যার হার ১৬% বেড়েছে—এই তথ্য ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

সাবিনা নেসা এখন কেবল একটি নাম নয়—একটি আন্দোলনের প্রতীক। তার নামে স্কুলে তৈরি হয়েছে “সাবিনা নেসা মেমোরিয়াল গার্ডেন।” তার বোন চালু করেছেন “Sabina Nesa Foundation।”