প্রিয় ঋতু হেমন্ত -জাকারিয়া জাকির

সাহিত্য, 18 October 2022, 179 বার পড়া হয়েছে,

বাংলার প্রকৃতিতে এখন বিরাজ করছে সুমঙ্গলা হেমন্ত। ঋতুর রানী শরতের প্রস্থানের পরই হিমবায়ুর পালকি চড়ে হালকা কুয়াশার আঁচল টেনে আগমন হয়েছে তার। প্রকৃতিতে ফুটে উঠেছে সুন্দর রূপবিভা। হরিদ্রাভ সাজবরণ করেছে পত্রপল্লব। কাঁচা সোনার রঙ লেগেছে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠে। মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে ধান কাটার ধুম। ধানের ম-ম গন্ধে ভরে উঠছে চারদিকে।

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। বারো মাসে আমাদের ছয়টি ঋতু- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। নামেও যেমন এদের বৈচিত্র, রূপে প্রকৃতিতেও বিচিত্রতা নিয়ে তারা দেখা দেয়। এদেশের জীবনে ও প্রকৃতিতে নানারকমভাবে নিজেকে তারা তুলে ধরে। বসন্ত ঋতুরাজ কিন্তু অপরাপর ঋতুও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে রূপে রঙে কম আকর্ষণীয় নয়। সব ঋতুই নিজ নিজ রূপ নিয়ে এখানকার মানুষের মন ভোলায়।

নিছক ভাল লাগা দিয়ে প্রিয় ঋতু নির্বাচন করা সমীচিন মনে করা ঠিক নয়। আর পাঁচটা ঋতুকে বাদ দিয়ে হেমন্তকে মনে ভালবাসার আসন দেয়ার পেছনে নিশ্চই যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। অন্য ঋতুকে প্রত্যক্ষ করা, উপভোগ করা জীবনের সাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। গ্রীষ্মের প্রখর গরম, বর্ষার বৃষ্টি আর কাদা, শরতের মেঘপুঞ্জ আকাশ, শীতের আমেজ আর বসন্তের সৌন্দর্যের সাথে খরার তীব্রতা-কোন কিছুই যেনো হৃদয়ে আপন করে গ্রহণ করার মতো নয়। দায়ে পড়ে এদের সাথে যেনো বসবাস করতে হয়। কিন্তু হেমন্তের ব্যাপারটি আলাদা। সে যেনো হৃদয়ে আসন পেতে বসে আছে। তাকে বের করা যায়না, তাকে ভুলে থাকা যায়না। কারণটি লুকিয়ে আছে হেমন্তের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। শরতের পূর্ণতার পরিণতি রূপলাভ করে হেমন্ত। কার্তিক ও অগ্রাহয়ন এ দু’মাসে হেমন্ত কাল। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠগুলো সোনালী ধানে ভরে যায় এবং দিগন্তে নীল বর্ণ রেখায় মিশে একাকার হয়ে যায়। হেমন্ত আসে শরতের পায়ে পায়ে। চলে যায় শীতের পদধ্বনি শুনতে শুনতে। বর্ষার প্রচুর পানি পেয়ে প্রকৃতি সতেজ হয়ে ওঠে। শরতের মাসে তার যথাযথ প্রকাশ। শরতের মন ভোলানো রূপের পশরার মাঝেই হেমন্তের শুভ আগমন ঘটে। হেমন্তের বৈশিষ্ট্য তার ফসল ভরা মাঠে নিহিত। দেশের মানুষের আগামী দিনের সম্ভাবনা নিয়ে আসে হেমন্ত। মাঠে মাঠে পাকা ধানের সীমাহীন সমারোহ। মাঠ ভরা ফসলের উপহার নিয়ে আসে হেমন্ত। বাংলাদেশের প্রকৃতি তখন নতুন সাজে সেজে ওঠে। তার মধ্যে যেনো পরিপূর্ণতা। আকাশে-বাতাসে ফসলের মন জুড়ানো গন্ধ যেনো ভেসে বেড়ায়। অনেক আশায় মানুষ মাঠে যে শ্রম দিয়েছিল তার ফল পায় ফসল হিসেবে এ সময়ে। আশার পূরণ ঘটে এ সময়ে। ফসল পেয়ে কৃষকের মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে তা ছড়িয়ে যায় সারাদেশে।

নীলাক্ষী হেমন্ত কৃষককে করে আশীর্বাদ। ফসল কাটার গানে হেমন্তের মাঠ হয়ে ওঠে মুখর। কার্তিক ও অগ্রাহয়নের প্রথম শীতের আমেজ পেয়ে ঘাসের মাথায় মাথায় জমে ওঠে শিশির কণা। কৃষকের উঠোনে জমে ধান।

সংসারে জমে ওঠে প্রচুর কাজ। রাত্রির প্রায় অর্ধেকটা চলে ধান মাড়াইয়ের ব্যস্ততা। রাত্রি প্রায় শেষ হওয়ার পূর্বেই গৃহবধূ যায় উনুনের পাশে, চলে ধান সিদ্ধ করার পালা। মাঠে রবি শস্যের জন্যে চলে চাষাবাদের কাজ। কোথাও পাকা ধানে হলুদ বর্ণ, কোথাও ধান কাটা শূন্য মাঠে শালিক পাখির ব্যস্ততা। হেমন্ত আমাদের সমৃদ্ধি দেয়, আনন্দ দেয়। জীবনকে করে তোলে সুখকর। তাই হেমন্ত ঋতুকে আমাদের প্রিয় ঋতুর মর্যাদা দিতে হয়।
হেমন্ত ঋতুর সৌন্দর্য্যরে প্রধান দিক তার ফসল ভরা মাঠে মাঠে পাকা ফসল সোনালী রং ছড়িয়ে থাকে। আকাশ থাকে নির্মল নীলাকাশ। বাতাসের হালকা ঢঙে ফসলের শীষ নাড়া দিয়ে যেনো খেলা করে বেড়ায়।

তখন গরমের কোনো প্রভাব নেই। শীতের আমেজ অনুভব করার সূযোগ তখন ঘটেনা। আবহাওয়ার এমন উপাদেয় পরিবেশ তার কোনো ঋতুতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। প্রকৃতিকে তখন খুব চমৎকার উপভোগ্য বলে মনে হয়।

হেমন্ত ঋতু বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। হেমন্তের অবদানেই দেশের সমৃদ্ধি, মানুষের সুখ। হৈমন্তিক প্রকৃতির এই আনন্দময় অবদান মানুষের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দ উৎসবে মেতে থাকার ঋতু এই হেমন্ত। পার্বণের আনন্দ স্পর্শ জাগায় মনে মনে।

হেমন্তকাল এমনই এক ঋতু যে আপনি চারদিকে একটু খেয়াল করলেই এই ঋতুর সৌন্দর্য মোহিত করবে। এতটা স্নিগ্ধতা চারদিকে বিরাজ করে যে, তার মোহ কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। নইলে কি সাধেই এই হেমন্তকাল সবার মনে গেঁথে আছে, সবুজে সবুজে প্রতিটি ফুল এত সুন্দর করে ফুটে থাকে তা দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। ফুলের রংগুলো দেখতে ভীষণ মিষ্টি। ফুলের রংগুলো কখনো কমলা, হালকা লাল কিংবা রানী গোলাপি। এর মাঝে সাদা রঙের ফুলের কথা বলতে ভুলে গেলে হবে নাকি? সাদার মায়া বরাবরই স্নিগ্ধ আর শুভ্র। শরতের ফুল কাশফুলের কথা না বললে হয়ে যাবে অন্যায়। কেননা শরৎকাল যেতে না যেতেই চলে আসে হেমন্তকাল। এমন এক সময়ে ঘরের ভেতরটা না বদলে নিলে হয় বুঝি? হেমন্তের ছোঁয়া ঘরের ভেতরেও প্রবেশ করুক। বছরের এই সময়ে জেলেদের মুখে ফুটে ওঠে অকৃত্রিম এক হাসি। কেননা, ইলিশ চাষের জন্য এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে দেশের সব জেলে। সামনেই আসছে বৈশাখ মাস, জাতীয় মাছ ইলিশের চাহিদা সে সময়ে প্রায় সর্বোচ্চ থাকে। যার ফলে জেলেদের তুমুল ব্যবসা হয়। নদীর ঝলমলে পানিতে ইলিশের চাষ শুরু হয়। জেলেদের জন্য এই সময়টা যেন কোনো উৎসবের থেকে কম নয়। দিন রাত এক করে তারা ইলিশের চাষ করে যায়। যাতে বৈশাখ মাসে এই কষ্টের প্রতিফলন দেখতে পারে। ইলিশ মাছ খেতে ভালোবাসেন না এমন কেউ নেই এই দেশে। এই মাছের স্বাদ সবার কাছেই কম বেশি প্রিয়। এই মাছ খান না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গরমের প্রখরতা হেমন্তের শীতল আবেশে শেষ হয় বলেই এই ঋতুটা মন ও চোখের জন্য এতটা শান্তিময়। এই সুন্দর সময়টা অতিক্রম করলেই সামনে অপেক্ষা করছে শীতকাল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতকালের মেয়াদটা দীর্ঘ বলেই মনে হয় কেবল এই তিনটা ঋতুই আছে আসলে তা নয়! অল্প সময়ের জন্য ঘুরতে এলেও হেমন্তের প্রভাব প্রকোপ সবার হৃদয়ে। অনেকেই অপেক্ষা করে এবং সময় নিয়ে উপভোগ করে।

জাকারিয়া জাকির,নির্বাহী সম্পাদক- জনতার খবর