বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,/ ক্ষমা করো আজিকার মতো,/পুরাতন বর্ষের সাথে/পুরাতন অপরাধ যত।’ আমাদেরও প্রত্যাশা পুরনো বছরের যত ব্যর্থতা-বেদনা, হতাশা-নিরাশা এমনি করে ক্ষয় হোক আবর্ত আঘাতে।
কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘ অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে/সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে/দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার/বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়/দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।
নতুনকে আমরা স্বাগত জানাই, পুরোনোকে বিদায় দিয়ে। এ রীতি চিরন্তনী বাণী উপহার দিয়েছে মানুষকে; নতুনকে বরণ করো-পুরোনোকে ছেড়ে। ২০২২ সালের প্রথম সূর্যোদয়কে সে কারণেই স্বাগত জানাই নানা বর্ণিল প্রত্যাশা ও স্বপ্ন দেখার বাসনায়।
কিন্তু যে ২০২১ সাল চলে গেল কিংবা তারও আগে বছরখানেকের মতো যে সময় গত হলো, শোক ও দুঃখে, সর্বগ্রাসী ত্রাস ও মৃত্যুভয়ে, তাকে বিদায় দিলেও স্মৃতি থেকে বাদ রাখা কি সম্ভব? একেবারেই নয়। কারণ ২০২০ সাল এসেছিল ভয়ংকর দানবরূপে, যে দানব বিশ-একুশের কাল পেরিয়ে গোটা বিশ্ব সংসার তছনছ করেছে, ছিনিয়ে নিয়েছে অর্ধকোটি মানুষের জীবন!
মহামারির এ তাণ্ডবকে অনেকেই প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করতে চাইবেন, কিন্তু মোট কথা-এর মূল লক্ষ্যবস্তু মানুষ, হাজারো-লাখো মানুষের জীবন। যাদের জীবন গেছে, দানব জীবাণু যাদের অস্তিত্ব বিলীন করেছে, তারা সবকিছুর বাইরে; কিন্তু যারা বেঁচে আছে, তারা পার করেছে শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম এক বিচ্ছিন্নতা! বিশ্বের সব মহাদেশ-এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা, এমনকি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে করোনার রাহুগ্রাস কোটি মানুষকে অসহায় করেনি। কোনো বড় যুদ্ধপ্রলয়ে যা ঘটেনি-তা-ই ঘটেছে উন্মত্ত ভয়ংকর এ সময়ে।
না, এ মহাপ্রলয় নতুন বছরকে ছেড়েছে বা ছাড়বে, সেটিও নিশ্চিত করে বলা যাবে না; নানা নামে বিবর্তিত হয়ে ২০২২ সালেও এ মহাদানবের বিচরণ অব্যাহত থাকবে এটা ধরেই নেওয়া যায়। তবে যে নামেই অশুভ আসুক, তার দাহন একই থাকে। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তে চীনের মাটিতে মাথা তুলে যে মহাদানব বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছে, শত নখরে বিস্তৃত হয়ে আগ্রাসী থাবায় জনজীবন, অর্থনীতি, যোগাযোগ, পারস্পরিক সম্পর্ক তছনছ-ক্ষতবিক্ষত করেছে, নতুন বছরে তাকে আমরা স্বাগত না জানালেও সে তো আজরাইলই।
বাংলাদেশের জীবনকেও ক্ষতবিক্ষত করেছে এ মহাপ্রলয়, সংখ্যার ভেদে কম ভাবা হলেও এ শকুনি ছোবল খুব কম ছিনিয়ে নেয়নি আমাদের মানুষদেরও। ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহুবিধ পুরোধাকে, যারা আমাদের নমস্য ছিলেন কর্ম ও কীর্তিতে, পরাভূত হয়েছেন তারাও মৃত্যুতে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গেল বছরে আরও একটি আতঙ্কজনক আগ্রাসন ঘটেছে; আফগানিস্তান থেকে ২০ বছরের দখলদারিত্ব গুটিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দেশটিতে পুনরুত্থান ঘটেছে তালেবানদের, যারা ধর্মের উগ্রবাদী শাসনের জাঁতাকলে গণতন্ত্র, নারী অধিকার, এমনকি মানবাধিকারকে পদদলিত করে চলেছে।
এরপরও বলি, আমাদের জন্য ২০২১ সাল এসেছিল ইতিহাসের আশীর্বাদ হয়ে জাতীয় মহালগ্নের সাতরঙা পুষ্পস্তবক হাতে। কারণ এর পেছনে আছে দীর্ঘ জাতীয় সংগ্রাম এবং আনন্দ-বেদনার মিশ্রিত ইতিহাস, বাংলাদেশের জন্ম, টিকে থাকা ও বৃদ্ধির ইতিহাস। নৃশংস অতিমারির তাণ্ডবে এ দুই মহালগ্নের বাহ্যিক আয়োজন সীমিত থাকলেও তাৎপর্যের মানদণ্ডে এরা গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মুছে দেওয়াও সম্ভব হয় না। আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি আমাদের রাষ্ট্রপিতাকে, যিনি তার জীবনের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে চিরকালীন নিপীড়িত বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন করেছিলেন।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, প্রভূত সংকট-সীমাবদ্ধতার পরও, নিঃসন্দেহে এগিয়েছে। অর্থনীতি, অবকাঠামো ও সামাজিক সূচকে জাতীয় প্রগতির চিহ্নগুলো পরিষ্কার। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষরা একের পর এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেও এ এগিয়ে যাওয়া রুদ্ধ হয়নি। হয়তো এ কারণে আত্মতুষ্টির ব্যাপারটি বড় হয়েছে কারও কারও কাছে। কিন্তু ২০২১ সালের কিছু ঘটনাবলি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অসীম ত্যাগ ও বিসর্জনের ইতিহাস পেরিয়ে, স্বাধীনতার রাজনৈতিক শক্তির হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও দর্শনগত বা মনমানসিকতার উন্নয়নে এগোতে পারিনি আমরা।
২০২১ সালে বেরিয়ে এসেছে সমাজজীবনের এমন এক অভব্য, অমানবিক সাম্প্রদায়িকতার ক্লেদ, যা গোটা জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। সে ক্লেদ দেশের নানা অংশে বাঙালির অহংকারকে কলঙ্কিত করেছে। কুমিল্লার শ্রী চান্দমনি হিন্দু মন্দির একশ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষের হাতলার শিকার হয়েছে। পীরগঞ্জের জেলেপল্লি আগুনে পুড়েছে। ফেনীতে হামলার শিকার হয়েছে মন্দিরের প্রতিমা।
অনস্বীকার্য, এসব অঘটন বাংলাদেশের ভিতকে নড়িয়ে দিয়েছে। যে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা, অহংকারের বিজয় কেতন তুলে, সেই বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে কালিমালিপ্ত হয়েছে জাতীয় অহংকারের মুখ। অতএব রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক ও সমাজশক্তিকে ভাবতে হবে।
ধর্ম ব্যক্তির বিশ্বাস, আবেগ ও অনুভূতি, এর অবমাননা গর্হিত কাজ। কিন্তু আগের অনেকবারের মতো এবারও দেখা গেল ২০২১ সালের ঘটনাবলির বেশিরভাগই পরিকল্পিত। স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে অপপ্রচারের এমন কিছু ফন্দি খোঁজে, যাতে সমাজের বৃহত্তর অংশকে উত্তেজিত করা যায়। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লা, ফেনী এবং পীরগঞ্জের জেলেপল্লিতে যেসব কলঙ্ক ঘটানো হয়েছে, তার প্রায় সবই এ পরিকল্পনার ফসল। অতএব প্রশাসনযন্ত্রের সক্রিয় পদক্ষেপ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সামাজিক প্রতিরোধ। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিগত দিনের অপরাধগুলোর বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায়, বিচার বিলম্বিত হওয়ায়, এসব অপরাধের প্রবণতা আজও কমেনি।
আশা ছাড়া জীবন অচল হয়, স্বপ্ন দেখা ছাড়া জীবন স্থবির হয়। সে কারণেই আশা রাখি-২০২২ নতুন আশা, নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেবে। মানুষ লড়াই করেছে, এযাবৎ নানা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, আশা রাখি মহামারির তাণ্ডবকে পরাজিত করতে পারবে মানুষ। কারণ বেঁচে থাকার মূল শর্ত সংগ্রাম, লড়াই। মানুষ, মনুষ্যত্ব এ সংগ্রামে সফল হোক, প্রার্থনা করি।