এক মানবতার ফেরিওয়ালার গল্প’

জনতার কন্ঠ, সারাদেশ, 7 October 2021, 572 বার পড়া হয়েছে,

ভালকে ভাল মন্দকে মন্দ বলার মানসিকতা বর্তমান সময়ে একেবারেই প্রায় হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। যদিও বা দু’একজন এমন মানুষ পাওয়া যায় তবে সে মুখে তালা মেরে রাখেন। কারণ, সংকীর্ণমনা নিন্দুক সমাজ নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করবে এই ভয়টাই তার বেশি। তাতে কি? নিন্দার ভয়ে সত্য প্রকাশে কুন্ঠাবোধ করায় হচ্ছে ভীরুতা এবং পরোক্ষভাবে নিন্দুকদের উৎসাহিত করা। সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা কেবল কৌশলে কৃতিত্ব চুরি করে। আত্মিকতৃপ্তি পায় নিজের অবৈধ প্রশংসায়। অন্যের সত্যটা প্রকাশে গা জ্বলে। আবার সমাজের কোন কাজই কোনদিন না করেও সে হয় সমাজসেবী। মানবতার লেশ মাত্র নেই অথচ মানব প্রেমিক, মানবতার ফেরিওয়ালা ইত্যাদি। এইসব বিশেষণে বিশেষায়িত হন ছলে-বলে-কৌশলে। এই সমাজের কিছু অর্থলোভী নির্বোধ মানুষ আছে যারা সত্যটাকে আড়াল করে মিথ্যাটাকে জাহির করতে সাচ্ছন্দবোধ করে অথচ এই সমাজেই আবার এমন কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃত পক্ষেই মানবতাবোধ সম্পন্ন, মানবপ্রেমিক এবং মানবতার ফেরিওয়ালা। নিরবে নিঃশব্দে যারা মানব কল্যাণে, মানব সেবাই ব্রত আছেন কিন্তু কখনও প্রকাশ করতে চান না নিজেকে। এরকমই একজন মানুষ জনাবা কোহিনূর আক্তার প্রিয়া।

সময়-অসময় নেই, দিন আর রাত নেই । তার মানবিক দায়িত্ববোধ তাকে পরিচালনা করেছে অসহায় মানুষের টানে মমত্ববোধ থেকে। গভীর রাতেও তাকে দেখা গেছে কোন না কোন অনাহারী মানুষের পাশে দাঁড়াতে। খাদ্য সামগ্রী তুলে দিতে হাতে। এরকম অনন্য দৃষ্টান্ত অনেক আছে তার। যার সাক্ষী হয়তো দু’চারজন ছাড়া পাওয়া যাবে না। তাতে তার কিছু যায় আসেনা। যারা মানব প্রেমিক তারা স্রষ্টার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হয়। মানুষ কি বললো না বললো সেই অপেক্ষায় থাকে না।

কম-বেশি তার সাথে একটু-আকটু ঘনিষ্টভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে আমার। পেশাগত কারণেই অনেক কর্মকান্ডও করার সুযোগ হয়েছে এক সাথে। তিনি মানবিক ছিলেন একথা বলবো না তবে সব গুনের বাইরেও যে বিশেষ একটি গুন মানুষ হিসেবে থাকা উচিত সেটা জনাবা কোহিনূর আক্তার এর মধ্যে আছে এবং তা একটু আলাদা’ই। একজন নারীর মধ্যে এতোটা মানব প্রেম থাকতে পারে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য অন্তত আমার কাছে।

ছোটবেলায় প্রখ্যাত লেখক ইব্রাহিম খাঁর একটি অসাধারণ ছোটগল্প পড়েছিলাম। গল্পটির নাম ‘ভাঙ্গা কুলা’। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে গল্পটির কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে যখন দেখি কিছু নিবেদিতপ্রাণ লোক নিঃস্বার্থভাবে অন্যের সেবা করেন। গল্পটির সঙ্গে আমার আজকের গল্পের অনেকটা মিল আছে। গল্প বললে মনে হয় ভুল হবে। কারণ, আমি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরছি। বর্তমানে ‘ভাঙ্গা কুলা’ গল্পটি পাঠ্যবইয়ে কোনো ক্লাসে পড়ানো হয় বলে আমার জানা নেই।

গল্পটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

বিশ্ব্যাবপী করোনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। সবাই আতঙ্কিত ও শঙ্কিত। এটা এমনই এক ভাইরাস, কেউ আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে তার পাশে কেউ যাচ্ছে না। অত্যন্ত কাছের মানুষও পর হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্যোগকালে লকডাউনের জন্য অনেকে বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না। খেটে খাওয়া দিনমজুর ও অনেক মধ্যবিত্ত মানুষও খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন অতিবাহিত করছে।

এসব অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন অতিবাহিত করা মানুষের জন্য লোকজনকে বলে খাবারের ব্যবস্থা করা, বাড়িতে বাড়িতে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া, অনলাইন ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে জরুরি রক্তের প্রয়োজনে রক্তের ব্যবস্থা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সহযোগিতা করা, করোনায় মানুষকে সচেতন করে লিফলেট বিতরণ, বিনা মূল্যে গরিব মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ, অসহায় ভবঘুরে মানুষের হাত ধোয়ার জন্য সাবান সেনিটাইজার দেওয়া, লকডাউনে মানুষকে ঘরে থাকতে সচেতন করা নিজের জীবন বাজি রেখে এমন অনেক কাজ নিঃস্বার্থভাবে করে যাচ্ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এক নারী। যাঁর নাম কোহিনূর আক্তার প্রিয়া। তিনি এভাবেই কাজ করে যেতে চান বাকী জীবন। শুধু করোনাভাইরাসের সময় নয়, স্কুলজীবন থেকেই নিঃস্বার্থভাবে নীরবে মানুষের সেবা করে আসছেন তিনি। মানুষের উপকার বা সেবা করাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান।

নিজের সামান্য আয় দিয়ে অসহায় ভবঘুরে পথশিশুদের রিতিমত পরিচর্যা করে থাকেন তিনি। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি পান করানো এবং কখনো ফুল দিয়ে বরণ করেন। ঈদের আগে এতিম শিশুদের পোশাক কিনে দেন, শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বা শীতের পোশাক বিতরণ করেন। বির্ভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে নিরাপদ স্থানে যেতে সহযোগিতা করেনI

যেকোনো বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন সবার আগে। অনেক অসহায় মানুষের আস্থার শেষ ঠিকানা কোহিনূর। এলাকার অসহায় গরিব মানুষের ক্যানসার, ব্রেন টিউমার, প্যারালাইসিস ও দুর্ঘটনায় বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হলে তাদের জন্য নিজে ও মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকায় হাসপাতালে এসব মানুষকে নিয়ে যান। কোহিনূরের এই মহৎ কাজের জন্য দেশ-বিদেশের অনেক প্রবাসী তাঁর মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মেড্ডার আরামবাগ এলাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম কোহিনূর আক্তার প্রিয়ার। বাবা হাজী সহিদ মিয়া ও মা সুলতানা রাজিয়া’র ৬ সন্তানের মধ্যে ৪র্থ কোহিনূর আক্তার। বর্তমানে বাবা-মা দু’জন’ই প্রয়াত। বয়স ৩৭ বা ৩৮ বছর হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। ভাইয়েরা নিজ নিজ জীবিকার পথ বেছে নেন আর বোনদের বিয়ে হয়ে যায়।

প্রচার বিমূখ এই মানুষটি বিগত ২০ বছর যাবত নিজ অর্থায়নে অসংখ্য অসহায় হত-দরিদ্র ও পথ শিশুদের জন্য কাজ করে আসছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের অর্থায়নে অসংখ্য অসহায়, হতদরিদ্র গরীব মানুষের চিকিৎসার জন্য দিয়েছেন নগদ অর্থ ও সামাজিক সেবা।

তিনি ‘প্রাউড অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া’, ‘সেবার লক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া’, স্বপ্নের ব্রাহ্মণবাড়িয়া’, গ্রীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া’, হৃদয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া’, ব্লাড ফর ব্রাহ্মণবাড়িয়া’, ‘মজিদ মাষ্টার ফাউন্ডেশন, ছাড়াও বহু সামাজিক সংগঠনের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি নারী মুক্তি সংসদ, জেলা নাগরিক ফোরাম এর মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা।

ভবিষ্যত পরিকল্পার বিষয়ে জানতে চাইলে ‘কোহিনূর আক্তার প্রিয়া’ বলেন, মানুষের সেবা করা, অসহায়দের মুখে হাসি ফোটানো, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সেবা ও লেখা পড়ার ব্যবস্থা করা এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। ভবিষ্যতে অসহায় বৃদ্ধাদের সেবার লক্ষে আমি আমার বাড়িতেই একটি বৃদ্ধা নিবাস করার পরিকল্পনা আছে।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যদি মানুষের কল্যাণে কিছু কিছু অর্থ দান এবং মানুষকে সেবা দানে এগিয়ে আসে তাহলেই ‘আলোকিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ গড়া সম্ভব’ বলে মনে করেন কর্মগুণে আলো ছড়ানো ‘কোহিনূর আক্তার প্রিয়া’।