আধুনিক বাংলা সমাজে মনোমোহন দত্তের চর্চা কেনো জরুরী?—-রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস

সাহিত্য, 2 February 2025, 36 বার পড়া হয়েছে,

রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস : মহর্ষি মনোমোহন দত্ত ছিলেন এক মহান আধ্যাত্মিক সাধক, সমাজ সংস্কারক এবং আত্মজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও শিক্ষা আধুনিক বাংলা সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান যুগে যখন মানুষ প্রযুক্তির প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েছে, যখন মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আত্মিক মূল্যবোধ সংকুচিত হয়ে পড়ছে, যখন সম্পর্কে সম্পর্কে চলছে হিংসা-খুন-পরশ্রীকাতরা, যখন আহারের পূর্বেই ভেঙ্গে যাচ্ছে প্লেট, তখন মহর্ষি মনোমোহন দত্তের দর্শন আমাদের কাছে একটি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে। তাঁর জীবন ও দর্শনের চর্চা আধুনিক বাংলা সমাজে কেনো জরুরী, তা নিয়ে আমার দুটি কথা বলার চেষ্টা। মহর্ষি মনোমোহন দত্তের মূল শিক্ষা ছিল আত্মজ্ঞান অর্জন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃত শান্তি এবং মুক্তি আত্মজ্ঞান থেকেই আসে। বর্তমান সমাজে অনেকেই বাহ্যিক পৃথিবী ও ভোগবিলাসের দিকে মনোনিবেশ করে নিজের রসনা-ইচ্ছার প্রাপ্তির অযথা পূরণে ব্যস্ত হয়ে আছেন। এরফলে, আত্মিক উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে না মানুষ। মহর্ষি মনোমোহন দত্তের জীবনাচরণ, তার লেখা,  আমাদের শেখান যে, আসল সুখ এবং শান্তি আমাদের অন্তরে, আমাদের আত্মায়। আধুনিক বাংলা সমাজে এই শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রযুক্তির যুগে মানুষের অন্তর্গত শূন্যতার আয়তন বাড়েছ। মানুষ তাঁর নিজের সাথে নিজের স্বার্থের দূরত্ব তৈরী করছে। চারদিকে কেবলই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ থেকে মানুষ ক্রমশ দূরে বহু দূরে সরে সরে যাচ্ছে। এই যে বিশাল শূন্যতা তা কেবলই আত্মজ্ঞান দ্বারা পূর্ণ করা সম্ভব।

মহর্ষি মনোমোহন দত্তের চর্চা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে যে, ধর্ম শুধুমাত্র রীতিনীতি বা আচার-অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের আত্মিক উন্নতির একটি চমৎকার প্রক্রিয়া হতে পারে। যদি আমরা এটিকে সেভাবে গ্রহণ করি। আপনারা অনেকেই জানেন, তিনি সাধারণ ধর্মীয় কাঠামো বা অন্ধবিশ্বাসের একদমই বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি সব ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে আত্মজ্ঞান অর্জনকেই সর্বোত্তম বলে বিশ্বাস করতেন। আজকের সমাজে যখন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও শান্তির প্রয়োজনীয়তা বেশি জরুরী হয়ে পড়ছে, তখন তাঁর এই মুক্তচিন্তার চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মহর্ষি মনোমোহন দত্ত ধ্যান ও আত্মজ্ঞান অর্জনের জন্য নিরন্তর সাধনার উপকারিতা বোঝাতে চেয়েছিলেন। আজকের এই দ্রুতগতির যুগে, যেখানে সবাই তাড়াহুড়া ও মানসিক চাপের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে, সেখানে ধ্যান এবং আত্মবিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরী। মনোযোগী জীবনযাপন ও ধ্যানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার মনের অশান্তি দূর করতে পারেন এবং জীবনকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারে। আপনি দেখুন- কীভাবে যোগাসন কিংবা অন্যান্য ভাবে মানুষ তার মনকে নিয়ন্ত্রণের এবং শরীর ও মনের প্রশান্তীর জন্য প্রকৃতির কাছে ফিরে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের মনুষ্য সমাজের একটা বিশাল অংশ মেডিটেশনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এটা কিন্তু তাঁর কাছেই ফিরে যাবার ব্যাপার মাত্র। ওই যে আত্মার জন্য শান্তির অনুসন্ধান। মুক্তির পথ। আমরা জানতে পারি, মহর্ষি মনোমোহন দত্ত সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি যৌতুক প্রথা, কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য এবং বিভিন্ন সামাজিক অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর চিন্তা ও শিক্ষা আজকের সমাজে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, কারণ বর্তমানেও সমাজে অনেক পুরনো কুসংস্কার, বৈষম্য এবং সামাজিক অবিচার রয়ে গেছে। মহর্ষি মনোমোহন দত্তের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিতে পারে, যাতে আমরা সামাজিক সমতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারি। সমাজের সহিংতা কমাতে পারি। অপরাধমুক্ত পরিচ্ছন্ন একটা জীবন ভাবতে পারি।  মহর্ষি মনোমোহন দত্ত মানুষের মর্যাদা ও মানবাধিকারের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি মানুষের আত্মিক উন্নতি এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি জোর দেন। আধুনিক সমাজে যখন ব্যক্তি স্বার্থ এবং সামাজিক অসাম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে, তখন মহর্ষির মানবিক মূল্যবোধ এবং তাঁর শিক্ষা মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাঁর দর্শন অনুযায়ী, সমাজে সকল মানুষের মধ্যে সমান অধিকার এবং সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।মহর্ষি মনোমোহন দত্ত নিজেকে এক যুগান্তকারী চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, কারণ তিনি ধর্ম, সমাজ এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা মানুষের বুদ্ধি ও মননশক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান বিশ্বে যখন তথাকথিত ‘প্রবণতা’ ও ‘পপুলার থট’ অনেক সময় ভুল পথে পরিচালিত করে, তখন মহর্ষি মনোমোহন দত্তের চিন্তা একটি সুস্থ ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আমাদের পরিচালিত করতে পারে। মহর্ষি মনোমোহন দত্তের শিক্ষা আমাদের উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও দুঃখের মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় অন্তর্দৃষ্টি এবং সমাধানমুখী চিন্তার দিকে পরিচালিত করে। বর্তমান সমাজে যখন মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন তাঁর আত্মিক দর্শন এবং চাপমুক্ত জীবনযাপনের উপায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি। সবশেষে বলা যায়-মহর্ষি মনোমোহন দত্তের দর্শন, শিক্ষা এবং জীবনযাপন আধুনিক বাংলা সমাজে নতুন আলো দেখাতে পারে। তাঁর চর্চা আমাদের আত্মজ্ঞান, সামাজিক দায়িত্ব, মানবিক মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে ধাবিত করতে পারে। সমাজের মধ্যে শান্তি, সমতা এবং মানবিকতা প্রতিষ্ঠা করতে মহর্ষি মনোমোহন দত্তের দর্শন আজকের সমাজে জরুরি হয়ে উঠেছে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, বার্তা সম্পাদক দৈনিক ফ্রনটিয়ার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।