এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সম্পর্কের সব বিষয়, বিশেষ করে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় এসেছে। দুই প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের স্বার্থে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল এবং সবুজ অংশীদারির জন্য যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্মত হয়েছেন।’
অভিন্ন নদ-নদী প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘৫৪টি নদী ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জল প্রকল্পে সহযোগিতা করে আসছি। আমরা ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের জন্য কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের যৌথ ঘোষণাপত্রেও তিস্তার পানি বিষয়টি উঠে এসেছে। ঘোষণায় পরিষ্কারভাবে যৌথ নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। একই সাথে বলা হয়েছে, তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে ভারতও যুক্ত হবে। উল্লেখ্য, তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের চীনের কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো নদী অববাহিকাকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে পানি সংকট মোকাবিলা করা।
তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বরাবর এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি একদম শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ে। ২০১৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাথে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ঢাকা সফর করলে সেবারও চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুক্তি হয়নি। গজলডোবা তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ৯ লক্ষ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হয়। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হলে সেখানকার লাখো কৃষক সংকটে পড়বে। সম্প্রতি সিকিমের রাজনৈতিক দলগুলোও তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বার্থে বিকল্প ও সাময়িক সমাধানের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার বাংলাদেশের পানি সংকট সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক। ৬৮ বছর ধরে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় সংকটের সমাধান আন্তরিকতার সাথে সমাধান করে মোদী সরকার। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি সহ নানা সংকটে বরাবর এগিয়ে এসেছে ভারত। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াও রামপাল, রূপপুর ও জামালপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের বিনিয়োগ, ভারতীয় তেল পরিশোধনাগার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আনা ব্যবস্থা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেও নেপাল থেকে ভারতীয় গ্রিডলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার তিস্তার পানি সংকট সমাধানেও এগিয়ে এসেছে ভারত। তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পে ভারত যুক্ত হলে ভারত থেকে পানি এনে তিস্তায় সংযুক্ত করে সংকটের সমাধান করা সহজতর হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে উত্তরবঙ্গের তোর্সা-দুধকুমার-সঙ্কোশ-ধরলার সহ আরও যে সব নদীতে উদ্বৃত্ত পানি আছে তা খাল খনন করে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ও ভারত দুই সরকারই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে চায়। কিন্তু দুই দেশের সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে। তাই এবারের যৌথ ঘোষণাপত্রে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প সমাধানের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যৌথ নদী কমিশন এ বিষয়ে প্রস্তাব করবে এবং তার পরেই বিকল্প সমাধানগুলো সুনির্দিষ্ট হবে।
বাংলাদেশের পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই ভারতের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ যে ভাবেই হোক তিস্তা অববাহিকায় পানি আসা বেশি জরুরি। ভারত থেকে খালের মাধ্যমেই আসুক কিংবা অন্য কোনো ভাবেই হোক না কেন, উত্তরবঙ্গের পানি সংকটের সমাধান হলে, তা বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন যেমন বাড়াবে, একই সাথে পরিবেশ-প্রকৃতি ও মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও উন্নত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলওয়ার হোসাইন বলেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র সমস্যা ভোগ করে আসছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই। জরুরি ভিত্তিতে এ চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটির গুরুত্ব অনেক। দেশের অর্থনীতি এখনো কৃষির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তিনি বলেন, আমাদের আশা বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর সঙ্কট সমাধানের দুয়ার খুলবে।
নদী গবেষক শেখ রোকন বলেন, শুধু ভারত বা চীন নয়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও এ প্রকল্পে যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ চীন নদী অববাহিকায় নতুন নগরায়ন ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য বেশি লাভজনক হবে। অন্যদিকে তিস্তা অববাহিকতায় পানি সরবরাহের জন্য নদীর পাড় ভরাট করার চেয়ে ভারত থেকে পানি আনা বেশি বাস্তবসম্মত ও পরিবেশের জন্য উপযোগী। তবে একই সাথে পানি বণ্টনের জন্য সরকারকে কূটনৈতিক চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ভারতের নদী ও নদীকেন্দ্রিক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শদাতা উত্তম কুমার সিনহার ম,তে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতকে একটি ‘অনমনীয় এবং অসংবেদনশীল’ দেশ মনে করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী রাজনীতিতেও একটি ইস্যু হয়ে ওঠে। তাই রাতারাতি পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান না হলেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।