এলো খুশির ঈদ – জাকারিয়া জাকির

উপ-সম্পাদকীয়, 6 April 2024, 143 বার পড়া হয়েছে,
বাঙালি মুসলমানের সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসব ঈদ। অন্য কোনো জাতীয় দিবসের সাথে এর তুলনা চলে না। মুসলমানদের দু’টি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। একমাস রোযা পালনের পর পহেলা সাওয়াল ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। এর দু’মাস দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। ‘ঈদ’ শব্দটি, যার অর্থ হলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। ঈদ নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে তা প্রতি বছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে।

বাঙালির ঈদ উৎসবে যুক্ত হওয়ার আকুলতা দৃশ্যমান হয় ঈদের আগের দুদিন বাংলাদেশের পথে পথে; ট্রেনে-লঞ্চে-বাসে। প্রিয় স্বজনের সঙ্গে উৎসবে মিলিত হওয়ার মানসে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটছে, মানুষের এ আকুলতার দৃশ্য আমরা প্রতি বছরই দেখি, পাশাপাশি দুর্ঘটনার বার্তাও জানতে পাই।

উৎসবের আয়োজন এবং চারিত্র্য বদলে যায় কালের আবর্তে। বদলে যায়নি কবি নজরুলের সেই কালজয়ী গান, ঈদুল ফিতরের ভোর থেকেই বেতারে বাজত-
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ…।’
নজরুলের সেই গান আজও বেজে চলেছে। আমার শৈশবে আমরা যেভাবে ঈদ উৎসব উদযাপন করতাম, এখন আর  তেমনটি দেখি না।

ঈদ উপলক্ষে কিছু স্বাধীনতা পেতাম। ঈদের আগের দিন, ‘চানরাইত’ ছিল উদযাপন। বেশ কজন বন্ধু মিলে আড্ডা; আড্ডায় প্রধানত গল্পের আসর বসত; রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের জুয়ার আসর বসত; আর আমাদের উৎসবের বড় আকর্ষণ ছিল সদ্য পাওয়া জামা-জুতো; যেগুলো আমরা সযত্নে লুকিয়ে রাখতাম। কেউ দেখলেই যেন ওগুলো পুরান হয়ে যাবে; সেগুলো পরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে প্রদর্শন।

এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ছুটতাম ফিরনি-পায়েস-জর্দা বা সেমাই খাবার লোভে; আর বাড়ি গিয়ে গুরুজনদের পা ছুয়ে সালাম করতাম; আমাদের শৈশবে ‘সালামি’ বা ‘ঈদি’ পাওয়ার ভাগ্য হতো না খুব একটা; দুপুরের পর শহরের দুয়েক জায়গায় ঈদের মেলা বসত; মেলায় ঘুরে ফুরিয়ে যেত ঈদের দিন; আমাদের শৈশবে তো টেলিভিশন ছিল না; উৎসব বিনোদন কী হতে পারে, তেমন কোনো পরিকল্পনা আমাদের মাথায় সেভাবে আসেনি। অনেক পরে মধ্য বয়সে দেখতাম শহরের মোড়ে মোড়ে সড়কের পাশে জমে যেত গানের আসর, সে আসরে গান বাজত স্টেরিও রেকর্ডারে। লাউড স্পিকারে উচ্চগ্রামে বাজা সেসব গানের সঙ্গে ব্যাকরণহীন নৃত্য করত যুবকেরা। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ দিয়ে গান শুরু হলেও শেষ হতো ব্যান্ডের গান বা হিন্দি গান দিয়ে।

মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে, ব্যবহার্য সামগ্রীর পরিবর্তন হয়েছে, মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে, সামাজিক বন্ধন, সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে বারবার। কিন্তু বাঙালির ঈদ উৎসবের পরিশীলিত একটি রূপরেখা তৈরি হয়ে ওঠেনি যেন। মানুষ বেড়েছে, ঈদের জামাত ঈদগাহ থেকে ছড়িয়ে গেছে মসজিদে মসজিদে, মহল্লায় মহল্লায়, মেকি আনুষ্ঠানিকতা বেড়েছে কিন্তু সৌহার্দ এবং ভ্রাতৃত্ববোধ যেন কমে গেছে। ইফতার পার্টির আনুষ্ঠানিকতা বেড়েছে, জাকাত-ফিতরা বিতরণের নামে ‘শোডাউনের’ প্রব ণতা বেড়েছে; কেবল বাড়েনি মানবিক মূল্যবোধ। মানবিক মূল্যবোধের আকাল জাতির দৃশ্যমান সব অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতে চাইছে।

একবিংশে এসে আমাদের জীবনে যুক্ত হয়েছে প্রভাবশালী এক নতুন অনুষঙ্গ, যার নাম প্রযুক্তি, এসেছে মোবাইল ফোন, যুক্ত হয়েছে অ্যান্ড্রয়েড হ্যান্ডসেট, ডাক যোগাযোগব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিয়ে এসেছে এসএমএস, মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ভয়েজ এসএমএস, সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে আমাদের সময়; গুগল-ইউটিউব, অনলাইন, সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। পত্রপত্রিকার ঈদসংখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে এসেছে অনলাইন পোর্টাল, ঈদসংখ্যাগুলোতে উপন্যাসের নামে সংকলিত হচ্ছে বড়গল্প; পত্রিকাগুলো ঈদ সংখ্যার নামে প্রকাশ করছে বিজ্ঞাপন প্রচারের বাণিজ্য মহড়া; তারপরও কি পাঠক মগ্ন হচ্ছে পাঠে? সবার মুখ অধোবদন মোবাইল ফোনে; ফেসবুকে-চ্যাটিংয়েই চলছে এখন তারুণ্যের ঈদ উৎসব। করপোরেট নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের পুঁজি যেভাবে সুতো টানবে, আমরা তো পুতুল হয়ে সেভাবেই নেচে চলি। এমন বাস্তবতায় নতুন প্রজন্ম কি কেবল প্রযুক্তির ঘোরে নিমজ্জিতই থাকছে? না, এর মাঝেও কিছু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ তাদের মেধা আর বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত করছেন সময়কে; সে কথা অস্বীকার করতে পারি না। ফেসবুক আর পত্রপত্রিকায় কবিতা-গল্প-উপন্যাসের নামে প্রকাশিত অজস্র আবর্জনা আর জঞ্জালের ভিড়ে নতুন প্রজন্মের কিছু মেধাবী লেখাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আজকাল, সেটা আশার কথা।নতুন প্রজন্মের নতুন জামা-জুতো, ফাস্টফুডে রসনাবিলাস তো আছেই; কিন্তু তা যেন প্রদর্শনের কোনো তাড়া নেই তাদের; তাদের ঈদ উৎসব সন্ধান করতে গিয়ে পাই আড্ডা-হুল্লোড়-অস্থিরতা-একাকিত্ব আর অন্তর্দহন। নতুন প্রজন্মের বুকেও আছে আবেগের আগুন; তারুণ্যের বুকের আগুন নিশ্চিত করে আশা ফুরিয়ে যায়নি। অধোবদন তরুণদেরই কেউ কেউ হয়তো জেগে উঠবে রুচি-সংকটের এই দুঃসময়ে; করপোরেট আগ্রাসনের স্বরূপ উপলব্ধি করে তারা মুখ তুলে তাকাবে বিপন্ন দেশবাসীর দিকে, তারুণ্যের অবক্ষয়, মূল্যবোধের অধোপাত ঠেকাতে সোচ্চার হবে তারা যা-কিছু অসদাচার আর অন্ধতার বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই তারা আত্মপরিচয় জানবে আত্ম-জিজ্ঞাসার কষ্টিপাথরে ঘষে। অতঃপর নতুন প্রজন্মের মুখেই উচ্চারিত হবে-
স্বপ্নমাখা যে দিনটি ফিরে আসে বর্ষ শেষে ঘুরে
যে দিনে বিবাদ বিসম্বাদ সযতনে রাখি দূরে
মান-অভিমান শোক-তাপ যাই ভুলে
খুশির সেদিনে নৈবেদ্য সুগন্ধ ফুলে
বুকে বাজে সারাক্ষণ আবাহন গান
তাপ দাহে পুড়ি-তবু শান্তির সন্ধান,
মৃত্তিকার ভাঁজ খুলে পড়ি ভালোবাসা
যে মৃত্তিকা স্বপ্ন দেয়-জাগায় প্রত্যাশা;
ঈদের উৎসবে সবারে উদার আমন্ত্রণ বলি
সংকটে-দুর্যোগে যেন পাশাপাশি চলি।

বাঙালির ঈদ উৎসবের একটি জায়গায় পরিবর্তন নেই, সেটা বাঙালির আবেগ। যে আবেগে বাঙালি প্রাণের টানে উৎসবে স্বজনের সঙ্গে মিলিত হতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে যায় বারবার, আজও সে আবেগ নিয়েই তারা মাটির কাছে যাচ্ছে।

দু-চার দিন ঈদের ছুটিতে গ্রামে গিয়ে দুয়েক দিন লোকবাংলার আবহমান সংস্কৃতির আস্বাদ হয়তো নিয়েছে মানুষ, অতঃপর নগর যন্ত্রণায় পিষ্ট হতে ফিরে যাচ্ছে কংক্রিটের নগরে; আর বাংলার সাধারণ মানুষ পড়ে থাকছে অন্ধকারে; নগরের আলোকিত মানুষ জীবনযুদ্ধে চিড়াচ্যাপ্টা হয়ে বিস্মৃত হচ্ছে বাংলার আবহমান প্রকৃতিকে। এমন বাস্তবতায় বাঙালির আবেগ আর শেকড়ের প্রতি দুর্বার আকর্ষণের শক্তিকে বিবেচনায় রেখে নিজেদের অগ্রযাত্রার সোপানকে অর্থবহ করে তুলতে উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির রূপরেখা তৈরি করে নিতে হবে নিজেদেরই। সে রূপরেখায় ঈদ উৎসবের ধর্মীয় আয়োজন বাঙালি মুসলমানের জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেও সামাজিক আয়োজন হবে সর্বজনীন; যে আয়োজনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে অংশ নেবে আপামর বাঙালি জাতি। সমাজতাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিজীবীরা উদ্যোগী হলে একদিকে যেমন আমাদের সংস্কৃতি ঋদ্ধ হবে, অন্যদিকে বিশ্ব দরবারে বাঙালি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হবে! এ বিশ্বাসের স্বপ্ন বুকে নিয়েই ঈদ উৎসবের রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে। রূপান্তরিত সে উৎসবে আমরা সমবেত কণ্ঠে গাইব-‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো
খুশির ঈদ…।’