ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের উপর দফায় দফায় চলছে ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা। প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে নিরাপরাধ শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাসহ অগণিত মুক্তিকামী মুসলমান। পবিত্র ঈদের দিনেও রক্তখাদক ইসরাইলিরা নামাজরত মুসল্লীদের উপর কাপুরুষোচিত ও ন্যাক্যারজনক হামলা চালিয়েছে। শহিদ হয়েছে অনেক মা-বোন ও শিশু। কিন্তু কেন? কেনই বা এই জায়গাটি নিয়ে এত দ্বন্দ? বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন কেন মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
বায়তুল মুকাদ্দাস ও ইসরাইলি রাষ্ট্রের ইতিহাস : ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর তাঁর ছেলে হজরত ইসহাক (আ.)-এর সন্তান হজরত ইয়াকুব (আ.) ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে ‘আল-আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অতঃপর তাঁর ছেলে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বংশধর হজরত দাউদ (আ.)-এর সন্তান হজরত সুলাইমান (আ.) তা পুনঃনির্মাণ করেন। বায়তুল মুকাদ্দস আসলে হাজার হাজার বছর ধরে মুসলমানদের অধীনেই ছিল। কিন্তু ইংরেজেদের সহায়তায় ইহুদীরা ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের কাছ থেকে জোর করে এই পবিত্র মসজিদটি দখল করে নিয়েছে। এখনও ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলো। বর্তমান জেরুজালেমের পূর্ব নাম ছিল আল-কুদস যেখানে বায়তুল মুকাদ্দস মসজিদটি অবস্থিত। বায়তুল মুকাদ্দস মসজিদটির আর এক নাম হলো মাসজিদুল আকসা অর্থাত দূরবর্তী মসজিদ। কারণ এই মসজিদটি মক্কা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দ্বিতীয় খলিফাতুল মুসলিমিন ফারুকে আজম হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ গোটা ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরুপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (র.) পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা তৎকালীন তুরস্কের শাসক সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে বসতির অনুমতি চায়।
কিন্তু দূরদর্শী সুলতান তাদের এ দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবে রাজি হননি। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে; অল্প সময়ের মধ্যে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দাঙ্গা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এ সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়ানবাদী অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে মুসলমানদের প্রতি ইসরাইলিদের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে, যা অদ্যাবধি চলছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ইসরাইল ১৯৬৭ সালে ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে নেয়। এরপর থেকে সেখানকার মুসলিম জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসরাইলিরা একের পর এক মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকা জবরদখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে এবং হত্যা-গুম চালিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ ফিলিস্তিনিদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা ও সমর্থন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশও অদ্যবধী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বকিৃত দেয়নি।
মুসলমানের প্রথম কেবলা : বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ হলো মুসলমানের প্রথম কেবলা যার দিকে মুখ করে মুসলমানগণ নামাজ আদায় করতো। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ওহি লাভ ও নবুয়ত প্রকাশের সময় ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ই কিবলা ছিল। নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় ‘কাবা’ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। মদিনা শরিফে দুই কিবলার মসজিদও রয়েছে। ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘তাহবিলে কিবলা’ বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। এই থেকেই ইসলামের দ্বিতীয় কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত হয়।
কুরআন-হাদিসে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন : বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন যে বরকতময় এলাকা তা কুরআন-হাদিসের অনেক জায়গায় আলোচনায় এসেছে। পবিত্র কুরআনে বায়তুল আকসা মসজিদটির নাম সরাসরি এসেছে। পবিত্র কুরআনে কয়েক জায়গায় বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের আলোচনা স্থান পেয়েছে।
যেমন: এক. ইসরা ও মিরাজের ভূমি : আল্লাহ তায়ালা বলেন, পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাত্রে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল-মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা বনী ইসরাইল:১)। জেরুজালেম হলো ইসরা বা রসুলুল্লাহর (সা.) রাত্রিকালীন ভ্রমণের সর্বশেষ জমিন। এখানে তিনি সকল নবীর নামাজের ইমামতি করেন। তার পর তিনি এখান থেকে ঊর্ধ্ব আকাশে ভ্রমণ করেন। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা যেন প্রমান করেন, বিশ্ব ধর্মীয় নেতৃত্ব ইহুদীদের কাছ থেকে নতুন রসুল, নতুন কিতাব ও নতুন উম্মতের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এখানে যদি ফিলিস্তিনিদের গুরুত্ব না থাকত, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীকে মক্কা থেকেই সরাসরি ঊর্ধ্ব আকাশে ভ্রমণ করাতেন।
দুই. নবুয়াত ও বরকতময় অঞ্চল : কুরআনের কয়েকটি স্থানে মহান আল্লাহ তায়ালা ফিলিস্তিনকে বরকতময়, পূণ্যময় ভূখন্ড বলেছেন।
১. ‘যার আশপাশে আমি বরকত নাজিল করেছি।’ (সূরা বনী ইসরাইল:১)।
২. ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনার সময়- ‘আর আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই ভূখ-ে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য।’( সুরা আম্বিয়া:৭১)
৩. মুসা (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনায়, যখন ফিরাউনের কবল থেকে মুসা (আ.) ও বান ইসরাইলকে উদ্ধার করে আনা হয় এবং ফেরাউন ও তার সৈন্যদলকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে সম্প্রদায়কে দূর্বল মনে করা হতো, তাদের আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি; এবং বনি ইসরাইল সমন্ধে আপনার প্রতিপালকের শুভ বাণী সত্যে পরিণত হলো, যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। (সূরা আ’রাফ: ১৩৭)
৪. হজরত সুলায়মান (আ.)-এর ঘটনায়। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে রাজ্য দান করেছিলেন এবং সব কিছুকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর সুলায়মানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; সে তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সেই ভূখ-ের দিকে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমিই সম্যক অবগত।’ (সুরা আম্বিয়া:৮১)
৫. সাবা-এর ঘটনায় আল্লাহ তায়ালা তাদের কীভাবে সুখ-শান্তিতে রেখেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওদের ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ওইসব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং ওদেরকে বলেছিলাম ‘তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ কর দিনে ও রাতে।’ (সূরা সাবা:১৮)। তাফসিরে রুহুল মাআনীতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই জনপদ বলতে শামকে বুঝানো হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, এ জনপদ হলো, বায়তুল মুকাদ্দাস। প্রাচীন শামদেশ হলো বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন।
তিন. তৃতীয় সম্মানিত শহর : হাদিসের আলোকে প্রমানিত যে, তিনটি শহর সম্মানিত; মক্কা, মদিনা ও ফিলিস্তিন বা বায়তুল মুকাদ্দাস। সহিহ বুখারিও মুসলিমে হজরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত রসুল (সা.) বলেন, তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো (জায়গা ইবাদাতের) উদ্দেশ্যে ভ্রমণে বের হওয়া যাবে না- মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা এবং আমার এই মসজিদ। অন্য হাদিসে এসেছে, মসজিদুল আকসায় ১ রাকাত নামাজ আদায় অন্যান্য মসজিদের তুলনায় ৫০০ গুণ, মসজিদুল হারাম এবং মসজিদুন নববী ব্যতীত (বুখারি, মুসলিম)। আর এক হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, ‘কাবা শরিফ তথা মাসজিদুল হারামে নামাজে এক লাখ গুণ সওয়াব, মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে নামাজে পঞ্চাশ হাজার গুণ সওয়াব, বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজে পঁচিশ হাজার গুণ সওয়াব।
চার. অসংখ্য নবীর মাজার যেখানে : বাযতুল মোকাদ্দাসের পবিত্র চত্তরে ঘুমিয়ে আছেন অসংখ্য নবী-রসুল (আ.)। ইতহাস থেকে জানা যায়, নবী ইব্রাহিম (আ.), মুসা (আ.), দাউদ (আ.), সুলাইমান (আ.), জাকারিয়া (আ.) সহ শতশত নবীর কবর মোবারক রয়েছে এই বায়তুল মোকাদ্দাসের আশেপাশে। পূর্বের বড় বড় সকল নবীই নাকি অছিয়ত করে গিয়েছিলেন তাদের কবরকে বায়তুল মোকাদ্দাসের পবিত্র অঙ্গনে করার জন্য। বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এ পবিত্র নাম শুধু একটি স্থানের সঙ্গে জড়িত নয় বরং এ নাম সব মুসলমানের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মুসলিমদের সব দল, উপদল, মাজহাব এ ব্যাপারে একমত যে, ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস, মসজিদে আকসা এবং সমগ্র ফিলিস্তিনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য অনেক উচ্চ। এর সংরক্ষণ, পবিত্রতা রক্ষা করা শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়; বরং সব মুসলিমের ওপর দায়িত্ব। ঐতিহাসিকভাবেই এটি মুসলমানদের পবিত্র স্থান। মুসলমানরা তাদের পবিত্র ভূমি, প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ দ্রুত ফিরে পাক- এটাই আমাদের কামনা।