আধাপাকা-কাঁচা বাড়িঘরগুলো যেনো পরিত্যাক্ত, খা খা করছে। এহেন অবস্থা শহরতলীর বিরাসার গ্রামের অধিকাংশের। দফায় দফায় হামলা-ভাঙচুর-লুটপাটের
ক্ষতচিহ্ন চারদিকে। যেনো যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা। অথচ বাস্তবিকতায় চলছে পবিত্র রমজান মাস। গোষ্ঠিগত আধিপত্যবাদকে পুঁজি করে জুয়া খেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কথিত ঐক্যজোট মহাজোটের তান্ডÍবের খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর এই অবস্থা প্রায় মাস গড়াচ্ছে। পৃথক চারটি মামলার ঘটনার দুই গোষ্ঠির দুই
প্রভাবশালীসহ এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অশান্ত বিরাসার এখনও শান্ত হয়নি। চার মামলায় আসামী করা হয় ২০০জনকে। এখনো এলাকায় পক্ষেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। এতে এলাকায় থম থমে অবস্থা বিরাজ করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রে সর্বক্ষনিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিন এলাকায় ঘুরে দৃষ্টিতে পড়ে অসংখ্য অমানবিকতার দৃশ্য। গ্রামটি প্রায় পুরুষশূণ্য। কদাচিৎ কাউকে নজরে পড়লেও যেনো ওরা হিংস্র জন্তুর তাড়া খাওয়া অসহায় দশায় এদিগসেদিক ছোটাছুটি করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত। বাড়ির মহিলারাও যেনো অজানা শঙ্কায় নিজের বাড়ি ছেড়ে এবাড়ি ওবাড়ি বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। নেই তাদের সাংসারিক নিত্যকর্ম, নেই পবিত্র রমজানে ইফতার-সেহরির জন্য ব্যস্ততা। এরই মাঝে ধরে-বেঁধে কারোর কাছে সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, ‘পাঁচ গোষ্ঠি ও তিন গোষ্ঠির ঐক্যজোট-মহাজোটের চিপায় পড়ে আমাদের কাম শ্যাষ। বড় গোষ্ঠি, হাজি বাড়ি, পোড়া বাড়ি এবং সাব বাড়ি এই পাঁচ গোষ্ঠি একাট্টা হয়ে বেঁধেছে ঐক্যজোট। অপরদিকে তিন গোষ্ঠি মিলে হয়েছে মহাজোট। তাদের অত্যাচারের
পাশাপাশি আছে পুলিশের দাবরানি। ধরতে পারলেই ১০/২০ হাজার আদায় করে ছাড়ে বলে স্থানীয়রা জানান।
মহিলাদেরকেও পুলিশের তাড়া খেয়ে থাকতে হচ্ছে বাড়ি পাহাড়া দেবার জন্য। কারণ, একটু সুযোগ পেলেই ফুলবাড়িয়া, শেরপুর, পোড়া বাড়ি এলাকা থেকে হামলাকারীরা ঝাপিয়ে পড়ে। ভাঙচুরের চাইতেও বেশি চালায় লুটপাট। এই উভয় সঙ্কটে পড়ে আমাদের অবস্থা কাহিল। প্রকাশ, একেতো গোষ্ঠিগত আধিপত্য বজায় রাখার ছুতো, তারউপর জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে গত ৩ মার্চ সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের বিরাসার গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বড় গোষ্ঠীর কাশেম মাস্টার ও
চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক বাবুল মিয়ার গোষ্ঠীর (ঐক্যজোট) আল-আমিনের সাথে একই এলাকার মহাজোটভূক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র মিজান আনসারীর গোষ্ঠী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তাজ মোহাম্মদ ইয়াছিন ও সৈয়দ আলী মিয়ার গোষ্ঠীর নূরুল্লাহ ও সুজনের প্রথমে কথা কাটাকাটি ও পরে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার জেরে পরদিন সোমবার উভয়পক্ষের লোকজনের মধ্যে হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এরই জেরে পরদিন মঙ্গলবার সকাল দিকে উভয়পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। টানা আড়াই ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশসহ উভয়পক্ষের অন্তত অর্শতাধিক মানুষ আহত হয়। দাঙ্গাবাজরা হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট চালায় উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৪০ টি বাড়িঘরে।
শুধু তাই নয়, এসময় ৪/৫টি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগও করা হয়। অসংখ্য ককটেলের বিষ্ফোরণে পুরো এলাকা হয়ে ওঠে প্রকম্পিত।
সংঘর্ষের খবর পেয়ে প্রথমে ওসি আসলাম হোসেনের নেতৃত্বে সদর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) বিল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ লাইন্স থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ব্যাপক লাঠিপেটা,কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট ছোড়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। সংঘর্ষ চলাকালে ঘটনাস্থল থেকে তিনটি ককটেল,একটি
বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগজিন এবং পাঁচ রাউন গুলি উদ্ধার করাসহ গুলি চালানোরত অবস্থায় বড় গোষ্ঠির নুরুল ইসলামের ছেলে মো. জসিম উদ্দিন (৩৫) সহ আটজন দাঙ্গাবাজকে পুলিশ আটক করেন। পরে তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। বিরাসার গ্রামের ঐক্যজোট এবং মহাজোট খ্যাত দাঙ্গাবাজদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পৃথক চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। চারটির মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে একটি, পুলিশ এ্যাসল্ট একটি এবং দুইপক্ষের লোকেরা বাদী হয়ে করেছেন অপর দু’টি মামলা। পৃথক চার মামলায় আসামী করা হয়েছে দু’শতাধিক লোককে। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ নাটাই উত্তর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান তাজ মোহাম্মদ ইয়াছিন, এবং বড় গোষ্ঠীর কাসেম মাস্টারে মেয়েসহ এখন পর্যন্ত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে সাবেক চেয়ারম্যান তাজ মোহাম্মদ ইয়াছিনসহ অনেকেই এখন জামিনে আছেন।
শহরতলী বিরাসার গ্রামের বাসিন্দা ও শহরের আনন্দবাজারের ব্যাবসায়ী মো: হারিজ মিয়া জানান, ‘আমার দুই-দুইটি বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট চালিয়েছে পাঁচ গোষ্ঠির লোকজন। তারা বাড়ির গেইট, দালানের দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। নিজের বাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন আমায় অন্যত্র থাকতে হচ্ছে।
কবরস্থান সংলগ্ন মুন্সী মার্কেটের ওষুধ বিক্রেতা নাসির উদ্দিন জানান, ‘২০ দিনেরও বেশি সময় ধরে পুরো এলাকাটা একরকম বিরান ভূমি। গভীর রাত পর্যন্ত এখানকার ব্যবসায়ীরা দোকান চালাতেন, আর এখন দিনের আলোতেও সবকিছু বন্ধ হয়ে থাকে।
অনেক সাধারণ মানুষ অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন।’ কবরস্থান পুকুরের দক্ষিণপাড়ের বাসিন্দা, কাঁচা মাল ব্যবসায়ী মো. শাহনুর মিয়া বলেন, ‘পাঁচ গোষ্ঠি আর তিন গোষ্ঠির চিপায় পড়ে আমাদের কাম শ্যাষ। বড় গোষ্ঠি, হাজি বাড়ি, পোড়া বাড়ি এবং সাব বাড়ি এই পাঁচ গোষ্ঠি জোট বেঁধেছে, তারা ঐক্যজোট। তাদের প্রতিপক্ষ সৈয়দ আলীর গোষ্ঠিসহ তিন গোষ্ঠি হয়েছে মহাজোট। এই ঐক্যজোট-মহাজোটের অত্যাচারের পাশাপাশি চলে পুলিশের দাবরানি। পুলিশ ধরলেই ১০/২০ হাজার। মহিলারাও ছাড় পাচ্ছে না। এই উভয় সঙ্কটে পড়ে আমাদের অবস্থা এখন কাহিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ আসলাম হোসেন বলেন, বিষয়টি সমধানের জন্য পুলিশের পক্ষে থেকে এবং দু’পক্ষের নেতাদের
পক্ষে থেকেও সমাধানের জন্য বিভিন্ন সময় আলোচনা হয় পরে তা ভেংঙ্গে যায়। এ ঘটনায় এলাকায় এখনো থম থমে অবস্থায় বিরাজ করছে।’ পুলিশ মামলায় যারা আসামী তাদের প্রতিনিয়ত গ্রেফতার করছি। এবং এলাকায় পুলিশের নজরদারি রয়েছে যাতে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটে । বিনা কারণে কোনো নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছেনা বলে তিনি জানান। এখন পর্যন্ত ৪ মামলায় প্রায় ৫০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে আমাদের এ অভিযান অবাহত আছে।
দ্রত বিষয়টি সমাধান করে এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে এমনটাই আশা করছেন সাধারন মানুষ।
