মো. রুহুল আমিন : জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ বিভিন্ন পেশা বেছে নেন। কেউ চালান উড়ো জাহাজ, কেউবা মার্সিডিস, কেউবা করেন ভিক্ষা, আবার কেউবা ফলান সোনার ফসল, আবার কেউবা অন্য পেশা নিয়ে বেঁচে আছেন। পেশা নিয়ে কেউ হয়েছেন সফল আবার একই পেশা নিয়ে কেউবা ব্যর্থ হয়ে নিজের কপাল বা কর্মকে দোষেন। বিচিত্র রং আর ঢংয়ের পেশা নিয়ে মানুষ জীবন পার করে দেন যা চলে আসছে আদিকাল থেকে চলবে মানব সভ্যতার শেষদিনতক। এক একজন এক এক পেশায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে জীবন-জীবিকা ধারণ করেন। তেমনি একজন মানুষ চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের পাথৈর গ্রামের বাসিন্দা মো: আনিসুর রহমান (৩৮)। যিনি মোটর সাইকেলে যাত্রী আনা-নেয়া করে জীবন-জীবিকা চালান। গত দুই বছর থেকে তিনি এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। টেইলারিং কাজ করতেন জীবনের শুরুতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড় ভাই ঢাকায় কাপড়ের ব্যবসা করেন, মেঝো ভাই স্থানীয় বাজারে চা-পান ও সিগারেট বিক্রি করে সংসার চালান।
আনিসুর রহমানের পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও ১ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। বড় সন্তান মেয়ে তানজিনা আক্তার(১৪) স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেঝো সন্তান ছেলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়েন আর ছোট সন্তান মেয়ে বয়স সাড়ে চার বছর। নিজে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। দেশে-বিদেশে মানুষের সাথে চলতে গিয়ে তিনি লেখা-পড়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি চান সন্তানদের লেখা-পড়া শিখাতে। কিন্তু সন্তাদের লেখা-পড়া করানোর সেই আর্থিক সংগতি তার নাই।
২০০৯ সালে তিনি পরিবারের অর্থনৈতিক ধন্যদশা ফিরাতে দুবাই পাড়ি জমান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ভাগ্য ফিরানোর সেই সোনার হরিণ তার কপালে জুটেনি। যার হাত ধরে নিজের জমানো ও ঋণের টাকা মিলিয়ে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দিয়ে দুবাই পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। বিদেশে পাঠানো সেই ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের কথা বিশ্বাস করায় কপাল পুড়েছে আনিসুর রহমানের। মাত্র তিন মাসের মধ্যে খালি হাতে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে তাঁকে। খালি হাতে দেশে ফিরে এসে জ্ঞান শূণ্য আনিস স্থানীয় বাজারে ভাড়া নেয়া একটি ঘরে ‘আনিসুর রহমান টেইলারিং এন্ড ক্লথ স্টোর’ নামের একটি দোকান স্থাপন করেন তিনি। নিজের হাতেই কাজ করতেন আনিস। করোনাকালে মানুষের রুজি-রোজকার কমে যাওয়ায় এখন তেমন কেউ কাপড় সেলাই করতে আসেন না। তাছাড়া ইদানিং চোখেও সমস্যা দেখা দেওয়ায় ভালো করে দেখেন না তিনি। তাই শাহরাস্তি উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে মটর সাইকেলে যাত্রী পারাপার করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। তার মটর সাইকেলের যাত্রী হন পরিচিতজন। পারাপারের যাত্রীরা খুশি হয়ে ভাড়া বাবদ যা দেন তাতেই তিনি তুষ্ট থাকেন। এক প্রশ্নের জবাবে আনিস জানান, ভাড়া নিয়ে এপর্যন্ত কেউ তার সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেন নি। তার কারন হিসাবে তিনি ব্যাখ্যা করেন আমার মটর সাইকেলে পারাপারের যাত্রীরা সবাই জানেন আমি যাত্রী পারাপার করেই সংসার চালাই, তাছাড়া আমার সন্তাদের পড়া-লেখার খরচও আমি একাজ করে যা আয় করি তাদিয়ে চালাই। তাই কেউ আমাকে কখনো ঠকায় না। সবাই ন্যায্য ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়াও দিয়ে থাকে আমাকে। আমি চেয়ে কখনো যাত্রীদের নিকট হতে ন্যায্য ভাড়ার বেশি ভাড়া নেইনা। একাজ করে তিনি দৈনিক আয় করেন, ৫০০-৭০০ টাকা যা দিয়ে সংসার চলে তার।
বাবার তেমন একটা জমি-জমা ছিলো না। পৈত্রিক সূত্রে যে জমি পেয়েছেন তার পরিমান দেড় গন্ডা বা নয় শতক হবে হয়তো। জমিজমা এখনো ভাগ হয়নি। সকল ভাইয়েরা মিলে এখন ঐজমি চাষ করেন।
নিজের স্ত্রী সন্তান সহ বাবার করা ঘরেই তার মেঝো ভাই সহ বসবাস করছেন। বাবা মৃত্যুর পূর্বে ঐ ঘরটি মেঝো ভাইকে দিয়ে গেছেন। নিজের কোন টাকা-পয়সা না থাকায় ঐ ঘরে কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে পুরো পরিবার নিয়ে তাঁকে। প্রসংগক্রমে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার গৃহহীন মানুষকে ঘর দিচ্ছেন। সেই ঘরের একটি বরাদ্দ পেতে তিনি শাহরাস্তি উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান বর্তমানে পরিষদের চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্ব পালনকারী ভাইস-চেয়ারম্যান কামরুন নাহার কাজলের মাধ্যমে আবেদন করেছেন। এখনো সরকারের বরাদ্দ দেয়া সেই ঘর পাননি। তবে, সহসা ঘর বরাদ্দ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আছেন তিনি।
দেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন দু’বেলা অন্ন সংস্থানের বাহিরে দেশ নিয়ে চিন্তা করার কোন সুযোগ ও সময় নাই তার। তিনি আরো বলেন, দেশ সম্পর্কে তাঁর কোন ভাবনাই নাই। স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে কিছু একটা করে ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার! কিন্ত কি করে তা করা যাবে তা তিনি বুঝতে পারেন না। আনিস মনে করেন, তার উপার্জনের টাকাটা সৎ পথের হোক। নিজের সৎ পথে উপার্জনের টাকার বেশি তিনি কখনো আশা করেন না। প্রয়োজনে তিনি উপোষ করবেন কিন্তু অসৎ পথের কোন টাকা তার অর্জিত উপার্জনে আসুক এমনটা তিনি কখনো আশা কনের না।
কথা বলতে বলতে এক সময় আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। একটি আধুনিক হোটেলে তাকে কিছু খাওয়াতে চাইলে তিনি রাজী হলেন না। অনেক বলার পর একপর্যায়ে রাজী হলেন। সামান্য কিছু মুখে দিয়ে একসময় তিনি চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতে বললাম, ভাড়া নিয়ে যান। প্রথমে সে বললো আমি আজ আপনার নিকট হতে ভাড়া নিবো না নিয়ত করেছি! আমি বললাম কেন? সে বললো আসলে আপনাকে দেয়ারমত আমারতো আর কিছু নেই, আমি বললাম, কেন আপনি আমাকে কিছু দিবেন? আনিস বললো আমি অনেক যাত্রী পারাপার করেছি কিন্তু আপনারমত এত খুটিয়ে খুটিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ আমার খবরা-খবর জানতে চায়নি। আমি কি করে আপনাকে খুশি করবো! অনেক জোরাজুরির পর সে তার ন্যায্য ভাড়ার টাকা নিয়ে সালাম বিনিময় শেষে বিদায় নিলো।
আমি আমার বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম আমাদের দেশের সব মানুষ যদি আনিসের মত হতো তবে এদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার দেশে রুপান্তরিত হতে পারতো। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষগুলো যদি কোনরকম একটা সরকারি চাকুরি বা কোন কাজের সুযোগ পায় তবে নিজেকে সেই অফিসের জমিদার বা মালিক ভাবতে শুরু করেন! তাছাড়া সরকারি কোন কাজ করার কেউ কোন সুযোগ পেলে সে কিভাবে যেনতেনভাবে ঐকাজ করে টাকা-পয়সা মেরে দিতে পারেন এমন ভাবনায় থাকে! এক্ষেত্রে আমাদের সেই শিক্ষত সমাজের উচিৎ মোটর সাইকেলে যাত্রী পারাপার করে সংসার চালানো আনিসুর রহমানের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া।
যে কেউ চাইলে তাঁর সাথে কথা বলতে পারেন। তার সাথে যোগাযোগ নম্বর : ০১৭১৯-৭২১১৪৯(এই নম্বরে বিকাশও করা যায়)।
লেখক : মোঃ রুহুল আমিন, সাংবাদিক, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী