হে কবি, তুমি মোদের ক্ষমিও 🔳এইচ.এম. সিরাজ

মতামত, 27 August 2023, 186 বার পড়া হয়েছে,
কাজী নজরুল ইসলাম। একটি অনাবিস্কৃত মহাদেশ। কারণ, যিনি বাস্তবে মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডিটুকু পার না হয়েও যা রচনা করে গেছেন তা-ই পড়ানো হয় জাতীয় শিক্ষাক্রমের সর্বস্তরে। শুধু এটুকুনেই শেষ নয়, পৃথিবীর নানান বিশ্ববিদ্যালয়েই চালু করা হয়েছে ডক্টরেট ডিগ্রী। চলছে গবেষণা, তথাপিও নজরুলের বহুকিছুই থেকে যাচ্ছে উদঘাটনেরই বাকি। আর সেসব ক্ষেত্রে আমরা! কেবল যেনো মুখের কথা-কাগজের লেখাতেই সীমাবদ্ধ! আর এতে করেই যেনো আমরা দায়মুক্ত! আজও আমরা দিইনি-দিচ্ছিনা তাঁর প্রাপ্যতাও! হে কবি, তুমি মোদের ক্ষমিও।
দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, চেতনা আর মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ১২ ভাদ্র, মোতাবেক ২৭ আগস্ট। সে হিসেবে আজ কবি নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী। চার যুগেরও আগেকার আজকের এই দিনেই হয়তোবা চরমতম অভিমানেই তিনি চলে যান আমাদেরকে ছেড়ে। আর এমনটি তো তিনি নিজেই লিখে গেছেন-
     ‘বিশ্বাস করুন,আমি কবি হতে আসিনি-
     আমি নেতা হতে আসি নি।
     আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম,
     আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম।
     সে প্রেম পেলামনা বলে
আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে
নীরব অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।
                                                                   এর চাইতে কঠিন সত্যতা-বাস্তবতা কিই-বা হতে পারে! নানাবিধ আয়োজনে বিভিন্ন সংগঠন হয়তোবা দিবসটিকে পালন করবে। কিন্তু জাতীয়ভাবে তো নয়! কেননা, তিনি আজ অবধি রাষ্ট্রীয়ভাবে খেতাবপ্রাপ্ত নন আমাদের জাতীয় কবি! যদিওবা সকল দৈনিকেই ‘আজ জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী’ শিরোনামেই খবর ছাপা হয়। আমাদের এই দৈন্যতার কিংবা দ্বৈতনীতির হিসেবটুকু আমার দেমাগে আসে না।
জ্যৈষ্ঠে আগমন, ভাদ্রে প্রস্থান। এটাই হলো নজরুলের জীবন উপাখ্যান। চির সংগ্রামী নজরুল করে গেছেন আমাদেরকে-আমাদের সাহিত্যকে অধিকতর মাত্রাতেই সমৃদ্ধ। কিন্তু এসবের বিনিময়ে আমরা! হয়তো অনেক দিয়েছি, অথচ যা ছিলো তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য; তা দিইনি- আজও তা দিতে কেমন যেন অনীহা! আসলে আমরা তাঁকর কিছুই দিইনি। তিনি যা-ই পেয়েছেন, সেটুকুন নিজে আদায় করেই নিয়েছেন। পরিনামে আমাদেরকে দিয়ে গেছেন অকাতরে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে কবি নজরুলের জন্ম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর ডাক নাম দুখু মিয়া। মাত্র নয় বছর বয়সেই তিনি হন পিতৃহীন। ফলে শিক্ষাজীবনে আসে চরম থেকেও চরমতম বাধাগ্রস্থতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে মাত্রই দশ বছর বয়সে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক ও মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করতে হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। পরে একটি লেটো গানের দলে করেছিলেন যোগদান। আর সেখান থেকেই শুরু সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য সাধনা।
কৈশোর-যৌবন কালেই অর্থাৎ ১৯১৭খ্রিষ্টাব্দে নজরুল যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। নজরুল ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ একজন সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। সৈনিক জীবনে নজরুল যোগদান করেন প্রথম মহাযুদ্ধে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেবার পর নজরুল ইসলাম সৈনিক জীবন ত্যাগ করে করাচী সেনানিবাস থেকে কোলকাতায় চলে আসেন। এরপরই নজরুল নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা। আজন্মকালের স্বাধীনচেতা নজরুল অবতীর্ণ হন ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে।তাঁর মহাসৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ কবিতা আর ‘ধূমকেতু’র ন্যায় সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে ভীত নাড়িয়ে দেন ব্রিটিশ রাজের। ভয়ে ভীত হয়েই ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর করেন তাঁকে কারান্তরীন। কিন্তু এতেও সামান্যতমও দমাতে পারেনি নজরুলকে। জেলের প্রকোষ্ঠে বসেই কবি নজরুল তাঁর ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’র মতো সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে আরো অধিকই নড়বড়িয়ে দেন।
ইংরেজি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ। গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে কবি নজরুল আসেন কুমিল্লায়। সেখানে এসে ওঠেন সেন বাড়ির বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে। ভিক্টোরিয়া কলেজ অঙ্গনের পুকুরপাড়ের দক্ষিণ কোণে নিত্যই তরুণদের নিয়ে আড্ডা জমাতেন নজরুল। বেশ ক’টি কবিতাও লিখেন ওই আড্ডাস্থলে বসে। সেখানেই পরিচয়, এবং সে পরিচয় থেকেই আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দুলি ওরফে দোলনচাঁপা ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে একেবারে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন কবি নজরুল। অবশ্য এহেন ঘটনার আগেই আলী আকবর খানের ভাগ্নি নার্গিস আসার খানম ওরফে সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো কবি নজরুলের। কুমিল্লার অদূরবর্তী মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামের নার্গিস খানমের সাথে ‘আকদ’ সম্পন্ন হয় কবির। কিন্ত সেথায় তাদের বাসর সম্পন্নের আগেই নার্গিসকে রেখে নজরুল চলে যান কুমিল্লায়। এখানেও কবি নজরুল জয় করেন ধর্মীয় ভেদাভেদ।
ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত ভারতীয় জনগণ। এ দুয়ে গড়েছেন নজরুল নিবিড় এক সেতুবন্ধন। বাংলা কাব্যে তিনিই জন্ম দেন একটি নতুন ধারার। আর সেটি হলো ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন উৎকৃষ্ট শ্যামা সঙ্গীত, হিন্দু ভক্তিগীতি। প্রায় তিন হাজারেরও অধিক গান রচনার পাশাপাশি অধিকাংশের সুরকারও ছিলেন নজরুল নিজে। যেসব বর্তমানে নজরুলগীতি নামে বিশেষ জনপ্রিয়। এসবের মধ্য দিয়ে উভয় ধর্মের মানুষের ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছেন কবি নজরুল। তিনি নিজেই লিখেছেন-
 —
কেউ বলেন আমার বাণী জবন কেউ বলেন কাফের
কিন্তু আমি ওই দু’টোর কোনটাই না।
আমি কেবল হিন্দু-মুসলমানকে হ্যাণ্ডশেক করাতে চেয়েছি,
গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছি মাত্র।
তখনও ভারতবর্ষ ব্রিটিশ রাজ দ্বারাই হচ্ছিলো শাসিত। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ। আচমকাই অসুস্থ্য হয়ে পড়েন কবি নজরুল। এ অসুস্থতা থেকেই তিনি হয়ে পড়েন বাকরুদ্ধ। সে বছরের শেষদিকে, কবি হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্যও। সেই থেকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ। মাঝখানে বয়ে যায় মেলা সময়। পুরো পাকিস্তানী আমলটাই পার হয়ে যায়। সেদিন ছিলো বাহাত্তরের ২৪ মে। বাংলাদেশ তখন কেবলমাত্রই সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশ। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেছিলেন এক মহতি উদ্যোগ। তিনি ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আমরা হই গর্বিত, আমাদের কবি হিসেবে পাই নজরুলকে।
সেদিন ছিলো ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মানসূচক ‘ডি.লিট’ উপাধিতে ভূষিত করে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামেই সমধিক খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দুই বছরের মাথায়, ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে প্রদান করা হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। এর মধ্য দিয়েই নজরুলকে পুরোমাত্রায় আমাদের কবি হিসেবে ভাবতে পারি। সে বছরেরই ২১ ফেব্রুয়ারিতে কবি নজরুলকে ভূষিত করা হয় একুশে পদকে। একই বছরেই অসুস্থ কবিকে ভর্তি করানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (তখনকার পিজি হাসপাতাল)। সেখানেই চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সাড়ে তিন হাজার গানের গীতিকার কবি নজরুল। তাঁর এসব গান বাংলা সাহিত্যকেও করেছে অধিক সমৃদ্ধ। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই এসব গান পথ নির্দেশিকাসম। একটি গানে তিনি লিখেছিলেন,-
     ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
 যেন গোরে থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’।
কবির এই অন্তিম ইচ্ছাটিকে বিবেচনা করে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। তা হয়তোবা করা হয়েছে, কিন্তু আমরা তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকুই দিইনি। চারটি দশকতো পেরিয়েই গেলো। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও তাঁকে দিইনি ‘জাতীয় কবি’র খেতাব। কেবলই মুখে বলি আর কাগজে লিখি। আজ তোমার প্রয়াণ দিবসে আবারও ক্ষমাপ্রার্থী। হে কবি, তুমি মোদের ক্ষমিও।
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : serajhm@gmail.com