ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী ভাদুঘরের বান্নি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, 29 April 2023, 184 বার পড়া হয়েছে,
আদিত্ব্য কামাল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী ভাদুঘরের বান্নি (বারুণী) মেলা। প্রতি বছর ১৪ বৈশাখ এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বাঙ্গালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষ্যে মেলা বা লোক জমায়েতের। সম্রাট আকবর নতুন খাজনা আদায়ে ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখ মাসের ১ তারিখ ক্ষেত্র বিশেষে তারিখ পরিবর্তন করে বিভিন্ন এলাকায় খাজনা আদায় করা হতো। দূরদূরান্ত থেকে আসা লোকজনের খাওয়া দাওয়ার সুবিধার্থে আনুসাঙ্গিক বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসত ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে এই জমায়েতটাই একটা উৎসবের রূপ লাভ করে মেলাতে পরিণত হয়।
বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজকীয় বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠান যেখানে অনেক লোকের সমাগম হতো এ সকল স্থানেই কালক্রমে মেলা জমে উঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বিভিন্ন মাজারের উরশ শরীফ কে কেন্দ্র করে ২/৩ দিন আবার কোন কোন স্থানে সপ্তাহ ব্যাপী মেলা উদযাপিত হয়ে আসছে। সুদূর প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা আমাদের চৈত্র মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী শতভিষা নক্ষত্র যুক্ত হলে যে বারুনী যোগ হয় এবং সেই যোগে গঙ্গাস্নানের নাম বারুনী স্নান। সরাইল এর ধিতপুরেও এ ধরনের বারুনী স্নান অনুষ্ঠিত হয় বলে গবেষক লুৎফুর রহমান তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ভাদুঘরের বান্নী ১৪ বৈশাখ প্রতি বৎসর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বারুনী স্নান নামক যে ধর্মীয় আচারকে উপলক্ষ্য করে ভাদুঘরের বান্নী হয়েছে তা আসলে কতটুকু বারুনী স্নানকে কেন্দ্র করে হয়েছে তা প্রশ্ন যুক্ত। অনেকে মনে করেন ভাদুঘরের মেলা খাজনা আদায়কে উপলক্ষ্য করেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকতে পারে। তবে যে কোন উপলক্ষ্যেই মেলার প্রচলনটি শুরু হোক না কেন একথা আজ অনস্বীকার্য বর্তমান সময়েও এই মেলার আয়োজনে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি এবং সকল ধর্মীয় লোকজনের এক মহামিলনে রূপান্তরিত হয়েছে এই মেলা। মেলা উপলক্ষ্যে ভাদুঘর এবং আশেপাশে গ্রামসমূহে এক উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে। দূর দূরান্ত থেকে সকল গ্রামের অধিবাসীদের আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে মেয়েরা নাইওরী ও পুত্র বধুদের আত্মীয় স্বজনদের অন্ততঃ এক সপ্তাহ আগেই নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ঠিক কত বছর আগে থেকে এই বান্নি’র শুরু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কেউ জানাতে পারেনি। তবে এই বান্নিতে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মাঝে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। দিনব্যাপী এই গ্রাম্য মেলাতে বিপুল সংখ্যাক মানুষ সমাগম হয়।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর এই বান্নিকে কেন্দ্র করে ভাদুঘর এলাকার প্রায় বাড়িতে চলে উৎসবের আমেজ। বান্নিকে উপলক্ষে দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরা বেড়াতে আসেন। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় পিঠা। অতিথিদের জন্যে ঘরে ঘরে রান্নায় বিশেষ আয়োজন করা হয়। তিতাস নদীর পাড় বিভিন্ন স্টলের ব্যানারে হয়ে উঠে রঙিন।

শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) হিন্দু ধর্মালম্বীদের পূণ্য স্নানানের মধ্য দিয়ে মেলা শুরু হয়। মেলায় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। এরমধ্য মাটির তৈরি গরু, হাতি, ঘোড়া, উট, বক, পুতুল ইত্যাদি মাটির তৈরী খেলনা শিশুদের জন্য বিক্রি করতে সাজিয়ে বসেছিলেন দোকানিরা। দেশীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ছাড়াও গৃহস্থলির সামগ্রীর অনেক জিনিস উঠেছে। এছাড়াও গ্রাম বাংলার বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দোকান বসানো হয়। মেলা চত্ত্বরে শিশুদের জন্য নাগরদোলা সহ বিভিন্ন খেলনা স্থাপন করা হয়।

মেলায় আসা রফিকুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, মূলত বৈশাখ মাসেই জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হলেও, ভাদুঘরের বান্নির ঐতিহ্য রয়েছে।  ছোট বেলায় দেখেছি পরিবারের সদস্যরা বান্নিতে আসতেন। বুঝতে শেখার পর, আমাদের বাবা দাদাদের সাথে এই মেলায় আসতাম। এখন আমরা আসি প্রতিবছর। তবে মেলার সেই জৌলুস আর নেই।
মেলায় ঘুরতে আসা কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে এ বান্নি মেলা দেখে আসছি। আমাদের নানা মামাদের সঙ্গে এ মেলায় আসতাম। তবে কালের আর্বতে ও আধুনিক জীবনযাপনের কারণে বর্তমানে লোকজ সংস্কৃতি এই ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর উৎকর্ষতা আগের মত নেই। এই মেলায় মাটির জিনিসপত্র ছিল মূল আকর্ষণ। কিন্তু তা এখন দিন দিন বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
মেলায় পণ্য সামগ্রী কিনতে আসা স্কুলছাত্র জিয়াদুল করিম বর্নব বলেন, ‘আমার আম্মুর নানা বাড়ি ভাদুঘরে। ওনার মুখে বৈশাখ মাসের এই বান্নি মেলার কথা শুনেছি। তবে এই প্রথম আসার আনন্দটাই অন্য রকম।
কবির উদ্দিন নামের একজন বিক্রেতা বলেন, ‘সকাল থেকে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো হচ্ছে। তবে আগের মত মাটির জিনিসপত্রের দোকান কম। প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের কারণে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেছে। গ্রাম অঞ্চলের বান্নি মেলা বলতেই মাটির জিনিসপত্র। কিন্তু আর কয়েক বছর পর মাটির জিনিস বলতে কিছুই থাকবে না।

আতিকুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, আগে মেলায় বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকে-লোকারণ্য হয়ে যেত। বাস-ট্রাকে ভরে মানুষ আসতে দেখেছি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সকালে স্নানের পর অধিকাংশই চলে যান। এবার বিকালের দিকে জমজমাট ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিক জীবন যাপনের কারনে লোকজ সংঙ্কৃতির এই ঐতিহ্যবাহী মেলার উৎকর্ষতা আগের মত নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহরাব আল হোসাইন জানান, ঐতিহ্যবাহী এই বান্নিকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন ছিল। দিনব্যাপী মেলাতে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন দিকে দায়িত্ব পালন করছে।