বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ -জাকারিয়া জাকির

মতামত, 13 April 2023, 107 বার পড়া হয়েছে,
পহেলা বৈশাখ বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত। বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গতানুগতিক জীবনধারার মধ্যে নববর্ষ নিয়ে আসে নতুন সুর, নতুন উদ্দীপনা। পুরোনো দিনের গ্লানি জরাকে মুছে দিয়ে একরাশ হাসি, আনন্দ আর গান দিয়ে ভুলিয়ে দিয়ে যায় নববর্ষ। প্রাচীনকাল থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি বাঙালির আনন্দময় উৎসব হিসেবে সুপরিচিত। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালির জাতীয় উৎসব।
বাঙালি উৎসব ও আনন্দপ্রিয় জাতি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা উপলক্ষ্যে তারা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। সেসবের মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে আবির্ভূত হয় বাংলা নববর্ষ যার স্বাদ, গন্ধ ও আবেদন অন্যান্য উৎসব হতে একেবারেই আলাদা।
নববর্ষ বিশ্বের প্রায় সব জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের একটি অনিবার্য অংশ। বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিরা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রথা, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্ববৃহৎ সর্বজনীন উৎসব। এই দিনে বাঙালি পুরানো বছরের ব্যর্থতা, হতাশা, ভুলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় মহা আনন্দে, সমৃদ্ধি ও সুখী জীবনের আশায়।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে সব মানুষ, সব বাঙালি সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে সমগ্র জাতি একই হৃদয়াবেগে একটি মোহনায় মিলিত হয়ে পালন করে এই সর্বজনীন উৎসব। চিরায়ত বাঙালিত্বের অহংকার আর সংস্কৃতির উদার আহ্বানে জাগরুক হয়ে নাচে-গানে, গল্পে-আড্ডায়, আহারে-বিহারে চলে নতুন বছরকে বরণ করার পালা। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালিদের জীবনে সবচেয়ে বড় সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব।

এর মাধ্যমে জাতি তার স্বকীয়তা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার শক্তি সঞ্চয় করে; সচেষ্ট হয় আত্মপরিচয় ও শিকড়ের সন্ধানে। এরূপ নববর্ষই বাঙালি জাতিকে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে আবদ্ধ করেছিল, শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করে স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল।

নববর্ষ বিদায়ী বছরের গ্লানি মুছে দিয়ে বাঙালি জীবনে ওড়ায় নতুনের কেতন, চেতনায় বাজায় মহামিলনের সুর। সব ভেদাভেদ ভুলে সব বাঙালিকে দাঁড় করায় এক সম্প্রীতির মোহনায়। নববর্ষের আগমনী ধ্বনি শুনলেই সমগ্রজাতি নতুনের আহ্বানে জেগে ওঠে। গ্রামের জীর্ণ-কুটির হতে বিলাসবহুল ভবন কিংবা দূর প্রবাসের মেগাসিটি- সর্বত্রই প্রবাহিত হয় আনন্দের নবধারা।

আবহমান বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার মূলে রয়েছে এক অসাধারণ অনুষঙ্গ; সেটি হল বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাংলা বর্ষবিদায় ও বরণের অনুষ্ঠানমালা তাই আমাদের সেই ঐতিহাসিক চেতনাকে প্রোজ্জ্বল করে। স্বদেশ মানস রচনায় বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য সর্বোপরী ইতিহাসের আলোকে রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ চিন্তা-চেতনাকে পরিহার করে আধুনিক ও প্রাগ্রসরঅভিধায় জাতিসত্ত্বাকে যথাযথ প্রতিভাতকরার  সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি বাংলা নববর্ষকে দান করেছে অনবদ্য মাঙ্গলিক যাত্রাপথ।

তবে বাঙালির নববর্ষ সব বাঙালির কাছে একভাবে আসেনি। কারো কাছে এসেছে খরা হয়ে, কারো কাছে খাজনা দেওয়ার সময় হিসেবে, কারো কাছে বকেয়া আদায়ের হালখাতা হিসেবে, কারো কাছে মহাজনের সুদরূপে আবার কারো কাছে এসেছে উৎসব হিসেবে।

উল্লেখ্য যে, হিজরি সনকে উপেক্ষা নয় বরং হিজরি ৯৬৩ সালকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে শুধু ফসল তোলার সময়কে সৌরবর্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে সূর্যকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে সৌরবর্ষ অথবা ফসলি বর্ষ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্রাট আকবরের শাসনকালে সৌরবর্ষ (বঙ্গাব্দ) ও চন্দ্রবর্ষকে (হিজরি) একক মাত্রায় নির্ধারণ করা হয়।

সম্রাট আকবরের রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ উদযাপনের দিন ধার্য করা হয়।

বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের নিতে হবে ইতিহাসের আশ্রয়। ভারততত্ত্ববিদ আল বিরুনি কিতাব’ উল হিন্দ’-এ (রচনাকাল আনুমানিক ১৩৩০ খ্রি:) ভারতবর্ষের যে সব অব্দের  (শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ) নাম উল্লেখ করেছেন তাতে বঙ্গাব্দ নেই। বঙ্গাব্দ চালু হয় এর অনেক পরে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। সম্রাট আকবরের রাজজ্যোতিষী আমীর ফতে উল্লাহ সিরাজীর প্রচেষ্টায় এই নতুন অব্দের প্রচলন হয়।

আকবরের সিংহাসনে আরোহনের ২৫ দিন পর অর্থাৎ বুধবার ২৮ রবিউস সানি (১১ মার্চ) তারিখে ভুবন আলোককারী নতুন বর্ষের সূচনা হয়েছিল। এই দিনটি ছিল পারসিক বছরের নওরোজ। আবার সৌরবর্ষের চেয়ে চন্দ্রবর্ষ ১০/১২ দিন কম হবার ফলে কৃষকদের কৃষিকাজ সংক্রান্ত কাজে দিনক্ষণের সঠিক হিসাব রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে মোঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে আবুল ফজল ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফসলি সনের প্রবর্তন করেন যা বর্তমানে বাংলা সন হিসেবে প্রচলিত।

এতে ৯৬৩ হিজরী সনের মহররম মাসের ১ তারিখ থেকে বৈশাখী সনের প্রথম দিন গণনা শুরু হয়। অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সনের ১লা মহররম এবং ১লা বৈশাখ ৯৬৩ একই দিন ছিল। অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সনের সাথেই বঙ্গাব্দ যুক্ত হতে থাকে। আর চন্দ্রমাসভিত্তিক হিজরি সন ১২/১২ দিন হওয়ায় হিজরি সনের তুলনায় বিগত কয়েকশত বছরে বঙ্গাব্দ বেশ কম। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, বাংলা সন চালুর ভিত্তি হলো হিজরি সন। হিজরি সনের বর্তমান বয়স ১৪৪৩ বছর। বাংলা সনও হিজরি সনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১৪ বছর। এই পার্থক্যের কারণ হলো আরবি মাস কখনো ২৯ দিনে হয়ে থাকে।

এই পরিবর্তনের পরও প্রতি চার বছর অন্তর একদিন লিপইয়ার-এর হেরফের থেকে যায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বহু ভাষাবিদ, গবেষক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে পাকিস্তান আমলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল হতে বাংলাদেশে প্রচলিত নতুন ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা হয়। এতে প্রতি ইংরেজি লিপইয়ার বর্ষের বাংলা ফাল্গুন মাসে একদিন যোগ করে সমস্যাটির বিজ্ঞানসম্মত সমাধান করা হয়।

ধারণা করা হয়, মোঘল সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখ থেকে অর্থবছর গণনার প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন মূলত, রাজস্ব আহরণ তথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। পূর্বে চন্দ্রমাসের ভিত্তিতে প্রচলিত হিজরি সন এবং সৌরবর্ষ গণনার পদ্ধতি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় ও সাযুজ্য সাধনের তাৎপর্য ও যৌক্তিকতাকে বিচার-বিশ্লেষণের ভার তিনি তার নবরত্ন সভার সবচেয়ে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সদস্য মশহুর ইতিহাসবেত্তা আবুল ফজল (১৫৫১ – ১৬০২) এবং অর্থ ও রাজস্ব বিষয়ক সদস্য রাজা টোডরমলকে অর্পণ করেছিলেন।

তাদের নির্দেশনায় আকবরের রাজজ্যোতিষী ফতে উল্লাহ সিরাজী যে সমন্বিত প্রস্তাব প্রণয়ন করেন, তার ভিত্তিতে ফসলি সন নামে নতুন বর্ষ গণনার রীতি প্রবর্তিত হয় ৫৯৪ হিজরি সনের জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১৪ এপ্রিল সোমবার। প্রবর্তনের খ্রিস্টীয় সন ১৫৮৪ হলেও ফসলি সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সন ১৫৫৬ থেকেই এর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করা হয়। প্রজাদের উৎপাদিত ফসলের উপর কর বা রাজস্ব আরোপ এবং তা যথাসময়ে যথামৌসুমে সংগ্রহের সুবিধার্থেই মূলত ফসলি সনের প্রবর্তন করা হয়।

১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতের শাসনক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে খোদ ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায়। ওয়েস্ট মিনিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভায় পেশ করা হয় ৭ এপ্রিল ১৮৬০ সালে। অর্থবছরের ধারণাটি বাংলা সন অনুযায়ী রাখার পক্ষপাতি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫ – ১৮৬০)।

স্বনামধন্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের সচিব, অর্থ সচিব, ব্রিটিশ আইনসভার প্রভাবশালী সদস্য, ফ্রি ট্রেড আন্দোলনকর্মী, পেপার কারেন্সি প্রবর্তনের প্রবক্তা ছিলেন জেমস উইলসন। ভারতে ভাইসরয়দের কাউন্সিলে অর্থ-সদস্য (মন্ত্রী সমতুল্য) হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে কলকাতায় যোগদান করেন ১৮৫৯ সালের ২৯ নভেম্বর।

ইতিহাস সচেতন বিচক্ষণ অর্থনীতিবিদ উইলসন ভারতের আর্থ-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ৭ এপ্রিল ১৮৬০ উপস্থাপিত ভারত সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতাতেই ভারতে আধুনিক আয়কর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা থেকে রাজস্ব আদায়ের সূত্র উল্লেখ করলেও তিনি মূলত ব্রিটেনের আয়কর আইনের কাঠামোয় এদেশে আয়কর আরোপের রূপরেখা দেন। এপ্রিল মাস থেকে তার দেওয়া বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়-যার সাথে সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত বাংলা সনের যৌক্তিক সাদৃশ্য উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী, ভারতে আধুনিক আয়কর পদ্ধতি প্রবর্তনের মাত্র তিন মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে ভুগে ১১ আগস্ট ১৮৬০ সনে কলকাতাতেই মারা যান। পরবর্তী ৪ বছর বাজেট উপস্থাপন করা হয় যথাক্রমে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে। ১৮৬৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে আট বছর ১৩ এপ্রিল থেকে শুরুর বিধানটা কার্যকর হয়।

সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ প্রচলন করলেও নববর্ষ পালনের ইতিহাস বহু পুরনো। সর্ব প্রথম নববর্ষ পালিত হয় মেসোপটেমিরায় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে। খ্রিস্টীয় নববর্ষ চালু হয় জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। রাশিয়া, চীন, ইরান ও স্পেনে নববর্ষ পালিত হতো ঘটা করে। মুসলিম শাসকদের হাত ধরে ইরানের নওরোজ ভারতবর্ষে আসে। মোঘল আমলে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে নওরোজ উৎসবপালন করা হতো। এই নওরোজ উৎসবেই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নূরজাহানের প্রথম মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল।

তবে বাংলা নববর্ষ যেভাবেই আসুক না কেন এখন তা বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই পহেলা বৈশাখ এলেই সব বাঙালির প্রাণ বাংলা নববর্ষ বরণের আনন্দে আপনা আপনিই নেচে ওঠে। পহেলা বৈশাখ তাই পালিত হয় ব্যক্তিগত, ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, শ্রেণিগত অবস্থানের উর্ধ্বে উঠে ‘মানুষ মানুষের জন্য- এই বিশ্বাসকে সমাজ জীবনের সর্বত্রছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দালালদের রক্তচক্ষুউপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনের সময় থেকে ছায়ানট প্রবর্তনায় রমনার বটমূলে যে পহেলা বৈশাখ শুরু হলো-তা আজ গ্রাম-বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। তবে সামাজিক উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালন শুরু হয় ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।

পঞ্চাশের দশকে লেখক-শিল্পী-মজলিস ও পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঘরোয়াভাবে আবৃতি, সঙ্গীতানুষ্ঠান ও সাহিত্যসভার আয়োজন করত। সনজীদা খাতুনসহ অন্যান্যদের উদ্যোগে ছায়ানটের আয়োজনে কবিগুরুর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে বাংলা বছরের প্রথম দিন সকালে নববর্ষের আবাহন শুরু হয় রমনা অশ্বত্থতলায় ১৯৬৫ সালে।

পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চেতনার পালে যতই হাওয়া লেগেছে ততই উৎসবমূখর হয়েছে নববর্ষের আয়োজন। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধকরণসহ সাংস্কৃতিক নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করার পরও নববর্ষে লাগে নিত্য নতুন উদ্দীপনা। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার পহেলা বৈশাখকে জাতীয় পার্বণ হিসেবে ঘোষণা করেন।

এরপর ছায়ানট ছাড়াও রাজধানীতে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলা একাডেমি, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নজরুল ইনন্সিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বাংলা নববর্ষকে মহাউৎসবে পরিণত করেছে। বর্তমানে পল্লীর নিভৃত কুটির হতে শুরু করে গ্রামগঞ্জ, জেলা শহর, বিভাগীয় শহর ও রাজধানী শহরের সর্বত্র উছলে পড়ে বাংলা নববর্ষ পালনের আনন্দ।

বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য হলো বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। আর বাঙালিদের কাছে বাংলা নববর্ষ বরণ হলো একটি প্রাণের উৎসব। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। ইউনেস্কো আমাদের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মুল্যবেধের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বাস সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদান করে।

বাংলা নববর্ষ বাঙালিকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়। পুরোনোকে ভুলে গিয়ে নতুনকে গ্রহণের প্রেরণা দান করে। আমাদের জীবনে নবচেতনার সঞ্চার করে, পরিবর্তনের একটা বার্তা নিয়ে আসে নববর্ষ। আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে; জাতীয় জীবনে স্বকীয় চেতনা বিকাশে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষের এই চেতনাকে বুকে লালন করে চলেছে অবিরামভাবে। তাই বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে এত আনন্দ ও গৌরবের।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করে নববর্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সাংস্কৃতিক সৌধের ভিত আরও সুদৃঢ় করুক, নববর্ষের উদার আলোয় ও মঙ্গলবার্তায় জাতির ভাগ্যাকাশের সব অন্ধকার দূরীভূত হোক, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদী অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটুক, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াক, এটাই হোক বাংলা নববর্ষ-১৪৩০ এর প্রত্যয়।

জাকারিয়া জাকির,নির্বাহী সম্পাদক জনতার খবর