বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা যাচ্ছে না। দুর্দমনীয় হয়ে উঠা এসব গ্যাং নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিশোরদের বয়স বিবেচনয়ায় আইনের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে ছেলে-মেয়েদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িয়ে রয়েছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ফলে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করা হলেও সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংশোধনাগারে পাঠানো হলেও কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে পুনরায় তারা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
কিশোর ও তরুণ সমাজের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা যে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, তার প্রমাণ ইদানীং পত্রপত্রিকায় ‘কিশোর গ্যাং’-এর অপরাধ বিষয়ে প্রায়ই খবর। অপরাধের ধরনও দিন দিন পালটে যাচ্ছে। গ্যাং কালচার, যেমন ‘ব্যান্ডেজ গ্রুপের’ ‘মোল্লা রাব্বি’ ‘স্টার বন্ড’ বিস্তারের কারণে এক গ্রুপের ছেলেদের অন্য গ্রুপের ছেলেদের রামদা দিয়ে কোপাতে দেখা যায়। কোপানোর পর রামদা হাতে নিয়ে হিন্দি ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ গানের তালে নেচে উল্লাস করে এমন ঘটনাও ঘটছে।
সম্প্রতি সময়ে টিকটকের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে রাতারাতি খ্যতি এবং পরবর্তীতে টিকটককে কেন্দ্র করে ধর্ষণ, মাদক এমনকি নারী পাচারের মতো অপরাধে কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। বর্তমান সময়ে আলোচিত কিছু ঘটনা স্বভাবতই মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিশোর অপরাধী টিকটকার অপুর রাতারাতি মডেল বনে যাওয়া এবং মিডিয়াতে কাজ করা কতটুকু যুক্তিসংগত? পাঠকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি একজন অপরাধীকে সমাজ ভালো কিছু করবার সুযোগ দেবে না? অবশ্যই দেবে, তবে রাতারাতি টিকটকের মাধ্যমে খ্যতি পাওয়া একজন অপরাধী কিশোরকে যখন মিডিয়ার মতো জায়গায় কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়, তখন স্বাভাবিক সমাজের আরও ১০ জন কিশোর তাকে অনুসরণ করার পথ বেছে নেবে। এর মাধম্যে টিকটকের নেতিবাচক দিকটিকে আরও প্রচার করা হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটকের ভিডিও বা টিকটক লাইকিকে কেন্দ্র করেও নতুন করে গ্যাং গড়ে উঠছে। টিকটকের নায়িকা বানানোর টোপ দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধও হচ্ছে অহরহ। এক তরুণীকে পাচার করে ভারতে নিয়ে যৌন নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সেই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশি এক যুবকসহ পাঁচজনকে আটক করেছিল কেরালা পুলিশ। কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদেও। তারা অনায়াসে খুন, ড্রাগ, পর্নোগ্রাফি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি অপরাধে ইতোমধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে।
দ্বি-মত হবার কোনো সুযোগ নেই যে, করোনাকালীন সময়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের ঘরে বসে সময় কাটাতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের বিনোদনের কথা চিন্তা করে হাতে তুলে দিচ্ছে স্মার্টফোন, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ। কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসের খাতিরে বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে কিশোর-কিশোরীরা খুব সহজেই ইউটিউব, টিকটক, লাইকি, ফেইসবুক, বিভিন্ন গেইম এমনকি পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় আবার বাবা-মা সন্তানের প্রাইভেসির কথা চিন্তা করে আলাদা কক্ষ দিয়ে থাকে। তবে তারা কী করে, তা সঠিকভাবে তদারকি করেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সাইডগুলোতে কিশোররা ভয়ঙ্করভাবে আসক্ত হয়ে এবং অনেক সময় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হতে প্ররোচিত হচ্ছে। কিশোরদের ভিতর ডেভিয়েন্ট বিহেভিয়ার দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলছে। পরিবার, আর খুব সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাবা-মার কিছু দায়িত্বহীনতা শিশু-কিশোরদের অপরাধমুখী করে তুলছে। সিনিয়র-জুনিয়র’ নিয়ে বিরোধের জের ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটে। এমনকি এ বছরের সিনিয়রের সামনে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অনলাইন গেম পাবজির মাধ্যমে অন্য কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করে এবং শেষে ব্ল্যাকমেল করার মতো অপরাধেও ঝানু হয়ে উঠেছে তারা।
আমি যখন এসএসসি পাস করেছি, তখন আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। এখন যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে তারা ১৮ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আমাদের মনে হয়, ১৮ বছরের এ সময়সীমা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। এ-কথা থেকে বোঝা যায়, এখন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি এবং কম বয়সে পড়াশোনা শুরু করার ফলে শিশু-কিশোররা ১৮ বছরের আগেই ম্যাচিউরড হয়ে উঠছে। আক্ষরিক অর্থে তাই দেখা যাচ্ছে। তাদের বোধশক্তি আগের সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এর ফলে, তারা দ্রুত যেমন সবকিছু শিখতে পারছে, তেমনি অনেকে অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠা এবং তাতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা পরিবারকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। একজন মানুষ তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে পরিবারের সাথে। উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে বেশিরভাগ কিশোর অপরাধী পরিবারের সংলগ্নে বড় হয়। তাহলে বলাই বাহুল্য যে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে হয়তো পরিবার ব্যর্থ হচ্ছে তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানে। বাবা মায়ের ভিতর অন্তর্দ্বন্দ্ব, ডিভোর্স অথবা পরিবারের কেউ অপরাধ কর্মকান্ডে যুক্ত থাকা অনেক সময় একজন কিশোরকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। দারিদ্র্য বা অভাব-অনটন যে কিশোর অপরাধের আর একটি কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার খাতিরে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কিশোররা চুরি, পকেটমার, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। কিশোর অপরাধ সংঘটনে পরিবেশের দায় এড়ানোর মতো নয়। পরিবার থেকে বের হয়ে একটি শিশু যখন ভয়ংকর পরিবেশের সম্মুখীন হয় তখন পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীন হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকে আমরা একটা চরণের সাথে সবাই পরিচিত ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে।’ শুরু থেকেই অর্থ উপার্জন করা আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বেঁধে দেয়া হয়। একজন কিশোর যখন দেখতে পায় তার স্কুল বা কলেজের মেধাবী ছেলেটা বার বার চেষ্টা করেও ভালো চাকরি পাচ্ছে না অন্যদিকে এলাকার কোনো বড়ভাই নামে মাত্র পড়াশোনা করে ক্ষমতাধর দলের ছত্রছায়ায় নানান অপরাধ কার্যক্রম করে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক। তখন সে দ্বিতীয় রাস্তাটাকেই লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেবে।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের জন্য কিশোর গ্যাং ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে এদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করলেও তাতে খুব একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ও কিভাবে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে? এ নিয়ে সমাজবিদরা বেশ কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেছেন। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষার অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক শাসন-বারণের অভাব এবং অভিভাবকদের উদাসীনতা ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়াকে মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি এসব গ্যাং গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতাও রয়েছে। নেপথ্যে থেকে কিশোরদের ব্যবহার করে তাদের অপকর্ম হাসিল করছে। কিশোর গ্যাং তাদের কাছে নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোররা সামাজিক ও পারিবারিক শাসন-বারণ এড়িয়ে পৃষ্ঠপোষকদের প্রশ্রয়ে দুর্বিনীত হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অর্থলোভ ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা এবং হিরোইজম বিশেষভাবে কাজ করছে। আইনের তোয়াক্কা না করে যেকোনো অপরাধ করতে তারা দ্বিধাবোধ করছে না। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। এতে খুন-খারাবির মতো ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা ঘটছে। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতদের পরিবারগুলোও সন্তানদের সঠিকভাবে খেয়াল রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, এ ব্যাপারে বেখেয়াল হয়ে রয়েছে। সমাজের অভিভাবক শ্রেণীও দায়িত্ব পালন না করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এখন ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। যে কিশোর-তরুণ দেশের ভবিষ্যত, দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা উৎকণ্ঠার বিষয়। ভবিষ্যত প্রজন্মই যদি উৎচ্ছন্যে কিংবা গোল্লায় যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু থাকে না। বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে এক-দুজনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যথেষ্ট। এ বিবেচনায়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত অসংখ্য বিপদগামী কিশোরের উৎপাত সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও ত্রাস সৃষ্টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত ও নির্মূল করা না যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য গ্রেফতার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করে ঠিকই, তবে তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। যেহেতু কিশোরদের অপরাধের ক্ষেত্রে সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তাই এক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক কর্মকান্ড শুরু করতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিভাবক শ্রেণীর সাথে সমন্বয় করে কিভাবে কিশোরদের সুপথে পরিচালিত করা যায়, এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত বৈঠক করতে হবে। যে কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত, তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ সন্তানের চলাফেরা ও আচার-আচরণের পরিবর্তনের দিকে তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশু-কিশোরদের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
যখন কোনো কিশোর অপরাধ সংঘটন করে তখন তাকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে ক্রম বর্ধমান অপরাধের তুলনায় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক কম। সারাদেশে মাত্র তিনটি সংশোধন কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল অপরাধীদের ভালো হতে শিক্ষা দেয়া, বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দেয়া, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব সংশোধন কেন্দ্রে তারা বিভিন্ন মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। যার মূল কারণ কর্মচারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব এবং জবাবদিহির অভাব। আরও উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন অপরাধীদের একসাথে রাখার ফলে পরবর্তীতে এর নেতিবাচক বিভিন্ন প্রভাব পড়ে তাদের উপর। সংশোধন কেন্দ্র থেকে মুক্তির পর এসব ছোট অপরাধী চুরি, পকেটমার দেখা যায় বড় অপরাধে খুন, ধর্ষণ লিপ্ত হয়ে পড়ছে।
শিক্ষাহার ও মান বেড়েছে, অধিকাংশ পরিবারে বাবা-মা উভয়েই উচ্চশিক্ষিত; তারপরও শিশু-কিশোরদের আচরণে এত অধঃপতন কেন? কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কি কিশোররাই দায়ী? এ জন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা। অপরাধ বিজ্ঞানে অপরাধের কারণ জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদি বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা হয়। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রেও এসব দৃষ্টিভঙ্গি প্রযোজ্য। সমাজবিজ্ঞান বলছে, পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধুবান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। একে বলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণ বিনষ্ট হয়েছে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলেও পাড়ার মুরব্বিরা শাসন করতেন। এখন মুরব্বিরাই তাদের ভয় পান। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের সঙ্গে অভিভাবকরা অনেক সময় তাল মেলাতে পারছেন না। সন্তান কী করে সময় কাটায়, ডিজিটাল ডিভাইসে কী করে তারা বুঝে উঠতে পারেন না। ভিডিও গেমস খেলতে খেলতে তাদের মধ্যে অস্ত্র চালানো শেখার ইচ্ছা জাগে। এরপরই জঙ্গিগোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে তারা ঘর ছাড়ে।
কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বেশি দায়ী তা মূলত পারিবারিক। বর্তমানে শহরগুলোতে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বাবা-মা উভয়েই বাসার বাইরে চাকরি, ব্যবসা তথা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকেন। ফলে, সন্তান-সন্ততি উপযুক্ত স্নেহ-শাসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা আচরণে বিদ্রোহী হয়ে যাচ্ছে। সংসারে অশান্তি, অভাব, বাব-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ বা পৃথক থাকাও সন্তানদের নেতিবাচক মানসিকতায় প্রভাব ফেলে এবং সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যদি সুষ্ঠুভাবে কিশোরের ব্যক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে তাহলে পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিশোর অপরাধী হয়ে উঠতে পারে।
আইনে অপরাধী সংশোধনের ব্যবস্থা থাকাই কি যথেষ্ট?
আইন যতই সংশোধনের ব্যবস্থা করুক, বিচার ব্যবস্থা যতই শিশুবান্ধব হোক, কোনো শিশু একবার অপরাধের পথে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই কোনো শিশু-কিশোর যেন অপরাধের পথে বা বিপথে যেতে না পারে তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এর জন্য মূল কারিগর হচ্ছে পরিবার। সব অপরাধীই কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। আগেই বলেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে থাকা চাই দীক্ষা এই দীক্ষা শিশুরা পায় পরিবার থেকে; সমাজ থেকে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তরুণ প্রজন্মকে নানাবিধ অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করার প্রধান কাজটি করতে হবে পরিবারকে। সন্তান যেন বাবা-মা’র যথেষ্ট সঙ্গ পায় তার প্রতি জোর দিতে হবে। তারা কী শোনে-দেখে, কার সঙ্গে মিশে, মোবাইল-ইন্টারনেট, অনলাইন গেমস, পর্নোগ্রাফি-মাদকাসক্ত হচ্ছে কি না এটা পরিবার ছাড়া কেউ আগে ধরতে পারবে না। একেবারে ছোট বয়স থেকেই শিশুকে বই পড়া, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা উচিত। কোনো সন্তান পথভ্রষ্ট হলে শুধু পরিবারের জন্য দুঃখের বা কষ্টের বিষয় তা নয় সে তো একটা সমাজের পরিবেশ নষ্ট করে, একজন আরও দশজনকে বিপথে নেয়, সর্বোপরি দেশের ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়ে।
আজকের কিশোর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের হাত ধরেই দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। কিশোর অপরাধের দায় রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা পরিবার, কেউই এড়াতে পারবে না। কিশোর সংশোধন কেন্দ্র বাড়িয়ে, দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মচারীদের মাধ্যমে কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দরিদ্র কিশোরদের যথাযথ কারিগরি শিক্ষা, প্রদান করতে হবে। সংশোধন কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদারকির ভিতরে রাখতে হবে। কিশোরদের জন্য সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে বিনোদনের ব্যবস্থা, শরীর চর্চা, ধর্মশিক্ষা, নৈতিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে তারা সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এবং একটি সুন্দর সমাজে সদস্য হিসেবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
– আদিত্ব্য কামাল, বার্তা সম্পাদক জনতার খবর।