ভালোবাসা দিবস ও ইতিহাসের বিস্মৃতি🔳 এইচ.এম. সিরাজ

মতামত, 15 February 2023, 111 বার পড়া হয়েছে,
১৪ ফেব্রুয়ারি, বর্তমান সময়কার বহুল আলোচিত ভালোবাসা দিবস। অবশ্য দিবসটির যেমন একটি ‘অর্থনীতি’ আছে, ঠিক তেমনিভাবেই রয়েছে দিবসটির একটি ‘রাজনীতি’। আর সেই রাজনীতির ঢামাডোলেই যেনো চাপা পড়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশে দিবসটির আসল ঐতিহাসিকতা।ইতিহাস থেকেই হয়তো আশির দশকের গোড়ার দিককার সেই ঘটনার পাতাটিই ছিড়েই গেছে! সময়ের আবর্তে আমরা কেবলই যেনো হয়ে যাচ্ছি বিস্মৃত। সেই ‘কাবুলিওয়ালা’ যুগের মা-মাসিদের মুখে শোনা ‘ঘুমপাড়ানি গান’ যেমনি করে কালের স্রোতে হারিয়ে যেতো, অনেকটা তেমনিভাবেই পশ্চিমা জগত থেকে আমদানিকৃত ‘ভালোবাসা দিবস’র গড্ডালিকা প্রবাহে বাঙালির ঐতিহাসিক সত্যটাও যেনো আজকে বিলুপ্তপ্রায়। আমরা সভ্যতার সাথে তাল মিলাতে গিয়েই ভালোবাসার ধোয়ায় ঢেকে দিচ্ছি আমাদেরই হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে!
আজকাল ভালোবাসা দিবসে-ই চাপা পড়ে গেলো ছাত্র আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবহুলতা। তখন ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ। রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ওই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষণাকৃত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। সেই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। শুরু হয় ব্যাপকতর আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দিদের মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী, গণমুখী বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবীতে ছাত্র জমায়েত ডাকে। শিক্ষা ভবনে অবস্থান ধর্মঘট পালনের উদ্দেশ্যে সকাল ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কলা ভবন’র সামনে থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বের হয় মিছিলটি। সচিবালয় অভিমুখী মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মেয়েরা। সাহসিকতার সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। মিছিলটি হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালেই পুলিশ দেয় ব্যারিকেড। এরই এক পর্যায়ে মিছিলে ‘রায়ট কার’ ঢুকিয়ে ছিটাতে থাকে রঙ্গিন গরম পানি। এর পরপরই চালায় বেপরোয়া লাঠিচার্জ আর নির্বিচার গুলিবর্ষণ। গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। তারপরও গুলিবিদ্ধ জয়নালকে মারা হয় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও আহতদের নিয়ে আসতে চাইলেও ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। সেদিনকে জয়নাল ছাড়াও জাফর, আইয়ুব, মোজাম্মেল, দিপালী সাহাসহ নিহত হন অন্তত ১০ জন। নিখোঁজ হন আরও অনেকে। পরবর্তীতে নিহতদের লাশ নিয়েও মিছিল করেন ছাত্ররা।একপর্যায়ে পু্লিশ তল্লাশী চালিয়ে নিহতদের লাশও নিয়ে নেয়। বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক হল ছাড়তে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থীদেরকে। শুরু হয় পাইকারিহারে ধরপাকর। কেবল সরকারি হিসেবমতেই এক হাজার ৩৩১ জন ছাত্রকে করা হয়েছিলো গ্রেপ্তার। কিন্তু বাস্তবে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিলো আরও ম্যালা বেশি। পরবর্তীতে এদের মধ্যে অনেকেরই আর খোঁজটিও মেলেনি। রাজধানী ঢাকা ছাড়া বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছিলো সেই আন্দোলন। সেখানকার মেডিক্যাল এবং অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিলেও পুলিশ ব্যাপকতর লাঠিচার্জ আর এলোপাথারি গুলি চালায়। এতে নিহত হন কাঞ্চন।
সবচে’ মজার ব্যাপার হলো ভয়ঙ্কর এই ঘটনার আগে বাংলাদেশে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ কিংবা ‘ভালোবাসা দিবস’ কদ্যপিও পালন হয়নি। সেই থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দেশের ছাত্র সমাজ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবেই পালন করে আসছিলো। তবে দু:খজনক হলেও এটাই সত্যি যে, এক দশক পার না-হতেই এদেশের মানুষের কাছে বিস্মৃত হতে থাকে জয়নাল, জাফর, দিপালী সাহা প্রমুখদের নাম। পরবর্তীতে ‘ভালোবাসা দিবস’র আবরণে ঢাকা পড়তে থাকে ছাত্র আন্দোলনে নির্মম ওই হত্যার ঘটনা তথা রক্তের আখরে লেখা গৌরবময় সংগ্রামের সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন- এর সম্পাদক পাশ্চাত্যের রীতি-নীতিতে অভ্যস্ত শফিক রেহমান যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে এদেশেও ‘ভালোবাসা দিবস’র প্রচলন করেন। তিনার উদ্যোগেই ঐতিহাসিক দিনটি পরিণত হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ এবং বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে।
এক সময়কার ছাত্রনেতা-ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসেন এক স্মৃতিচারণায় বলেন, “জয়নাল ছাড়াও পরে মোজাম্মেল আইয়ুব নামের আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিলো। সেই ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারির পর এটাই ছিলো ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ছাত্রবিক্ষোভের এবং নিপীড়নের সবচেয়ে বড় ঘটনা। অথচ এরশাদ সরকার ভয়ঙ্করতম দিনটিকে ভুলিয়ে দিতে পরের বছর থেকে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মকে জানতেই দেওয়া হয়নি নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক গীতিআরা নাসরিন বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন,
 “ভালোবাসা দিবস নিয়ে নানা রকম প্রচার আছে। কিন্তু এখনো দিবসটি বাংলাদেশে সেইভাবে পালন করা হয় না। কারণ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ছোট বাচ্চারাও যেভাবে কার্ড বানায়, ফুল বা চকলেট দিয়ে উদযাপন করেন, বাংলাদেশে সেটা হয় না। বরং একে কেন্দ্র করে নানা রকম বাণিজ্য গড়ে ওঠেছে। ভালোবাসা দিবসের একটা অর্থনীতি আছে ঠিকই। তবে এর একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে।”
নানান ঘটন-অঘটন পটিয়শিতা থেকে এটা সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসটিকে ঘিরে যতোটা না অর্থনীতি বিদ্যমান, তার চেয়েও অধিকতর ‘রাজনৈতিক’ হিসেবও নিহিত।ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালনের আগে এই ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবেই পালন করা হতো। কিন্তু সময়ের আবর্তে সেটা আর তেমন দেখা-ই যায় না। ইতিহাসের বিস্মৃতি আমাদেরকে বাঁকে বাঁকে কেবল ঘুরিয়েই দেয়। ভুলিয়ে দেয়, বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় অনেককিছুই। ঠিক এমনিভাবে চেতনা লালন করার বদলে আমদানিকৃত সংস্কৃতিচর্চায় বিভোর হতে থাকলে বঙ্গ সংস্কৃতির কি হালত হতে পারে সেটিও মাথায় রাখা দরকার।
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- The Daily Prajabandhu,
গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব