কিশোরদের নিয়ে গড়ে উঠছে অপরাধ সাম্রাজ্য -আদিত্ব্য কামাল

মতামত, 20 December 2022, 107 বার পড়া হয়েছে,

দেশজুড়ে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে উঠতি কিশোরদের গ্যাং কালচার। এই কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্কুল-পড়ুয়া কিশোরদের মধ্যকার সিনিয়র-জুনিয়রদের দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা, মাদক, নারী নির্যাতন এমনকি খুন-খারাবির প্রবণতা। কিশোর গ্যাং দ্বারা পরিচালিত অপরাধ যেন একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিতে যাচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে-বন্দরে উঠতি বয়সের ছেলেরা একত্রিত হয়ে চালিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের অসামাজিক তৎপরতা। বিভিন্ন নামে এলাকাভিত্তিক নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তুলেছে কিশোর গ্যাং। কখনো পাড়া, মহল্লায় স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব কিশোর গ্যাং। আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন ও বিপণনের স্বার্থে ওদের গ্রুপে গ্রুপে মারামারি-খুনাখুনি লেগেই আছে। তারা ঘটাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের মতো কর্মকাণ্ড। কিশোর গ্যাংয়ের কাছে রয়েছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি, এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। মুঠোফোন ব্যবহার করে এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে। যে বয়সে বই নিয়ে কিশোরদের স্কুলে যাওয়ার কথা ঠিক সেই বয়সে ছুরি, চাকু হাতে কিশোররা হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে উঠতি বয়সের কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। কিশোর অপরাধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজ ব্যবস্থায়।

দিনদিন নৈতীক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে কিশোর ও যুব সমাজ। বিশেষ করে স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীরা নানা অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পড়ছে সহসাই। এক শ্রেণীর বখাটে ও উচ্চ বিলাসী সঙ্গীর কারনেই এমনটি হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সেই সঙ্গে অভিভাবকদের উদাসীনতা, দায়ীত্বহীনতা এর জন্য অনেকটা দায়ী বলে মনে করছেন সচেতন মহল। বুঝে না বুঝে অনেক কোমল মতি কিশোর কিশোরী ইদানীং জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। ফলে পরিবার ও সমাজে ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা।

কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরূপে দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং এখনো বেড়েই চলেছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার লক্ষ্যে এখনই এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে এটি খুব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

এক্ষেত্রে কিশোরদের বয়সটা জানা বেশি জরুরি। কারা কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিচ্ছে বা কত বছর বয়সে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এদের বয়সসীমা ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। কী করে বুঝবেন যে এরা কিশোর গ্যাংরে সঙ্গে যুক্ত আছে? সাধারণত প্রতিটি গ্যাংয়ের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এমন একটি নির্দিষ্ট নাম ও লোগো থাকে। গ্যাং সদস্যদের মধ্যে সেই নাম ও লোগো শরীরে ট্যাটু করার অথবা দেয়ালে লিখনের প্রবণতা রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এবং সর্বদা আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাংয়ের প্রচার-প্রচারণার নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা গ্যাং সংগঠন নিয়ে গর্ববোধ করে এবং গ্যাং সদস্য হিসাবে পরিচিত হয়ে তৃপ্তি অনুভব করে। ক্ষেত্রবিশেষে গ্যাংয়ে একই রকমের জামাকাপড় পরার স্টাইল দেখা যায় এবং কেউ কেউ অথবা সবাই জুয়েলারি ও অলংকার পরিধান করে থাকে। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা অস্ত্র যেমন- ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে।

সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। একই কমিউনিটির ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে, তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যকে বঞ্চিতদের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা অনুভব করে। আবার কমিউনিটিতে যখন অস্ত্র ও বিশেষ করে মাদকের দৌরাত্ম্য থাকে তখন গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে এবং বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে অথবা ওই গ্যাংয়ের বিদ্রোহী, দলছুট বা বহিষ্কৃত সদস্যরা আরেকটি গ্যাং তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ কমিউনিটিতে যখন গ্যাংয়ে যোগদান করার অভ্যাস অথবা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন একজন অপরকে বা সিনিয়রকে দেখে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। কখনো ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে অনুকরণপ্রবণশীল কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। তখন সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায় কিশোররা। তাই পরিবারের করণীয়টা এখানে বড় হয়ে দাঁড়ায়।

পারিবারিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই এ সমস্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক/নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলেও কিশোররা এ পথে আসতে উৎসাহিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে অথবা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মাঝে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে।

শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। যেমন- দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে গ্যাং গড়ে তোলার প্রবণতা থাকে। ক্রমাগত শিক্ষকের বঞ্চনা, খারাপ ফলাফল, সহপাঠী দ্বারা বিদ্রুপের শিকার থেকে হতাশা তৈরি হতে পারে। হতাশা থেকে পরে গ্যাংয়ে যোগদানের প্রবণতা তৈরি হতে পারে। স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগ্রত হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা ইত্যাদি তৈরি হয়, যা থেকে গ্যাংয়ের উদ্ভব হতে পারে। বন্ধু-বান্ধবের যদি অপরাধপ্রবণতা থাকে বা তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে, মাদক সেবনের প্রবণতা থাকে বা মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এভাবে জড়িত হওয়ার কারণের মধ্যে আরও রয়েছে- ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা, দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব, হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা, অনুকরণপ্রবণতা, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি বা যৌন আসক্তি হওয়ার ক্ষেত্র ও সুযোগ তৈরি হওয়া।

মূলত ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার নির্মমতা জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়। ৬ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের উপর আদনান কবিরকে (১৪) সংঘবদ্ধ গ্যাং মারাত্মকভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। তখন তিনটি গ্যাংয়ের (ডিসকো বয়েস, বিগবস্ ও নাইনস্টার) মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আদনানকে ধারালো অস্ত্র ও হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করা হয়। ফলে আদনানের মৃত্যু হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে র‌্যাব-১, উত্তরা, ঢাকার একটি আভিযানিক দল উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়ক এলাকায় একটি অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর আদনান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৩ নম্বর আসামি এবং ডিসকো বয়েস গ্যাং গ্রুপের দলনেতাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরে মূল আসামি তালাচাবি রাজুকেও র‌্যাব গ্রেফতার করেছিল। আমরা জানি, র‌্যাবের হাতে এ সময় একের পর পর গ্যাং ধরা পড়েছে এবং তাদের ধরতে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করেছিল র‌্যাব। ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি র‌্যাব ২৭২ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। শুধু হত্যাকাণ্ডের পৃথক চারটি ঘটনায় মোট ২০ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর র‌্যাব ২০১৯ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সেবন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের সংশোধনাগারে প্রেরণ করেছিল, যা সে সময় দেশে আলোচনার শীর্ষে ছিল।

পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র বলছে, রাজধানীতে এখন অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজার। রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বৃহত্তর মিরপুর, পুরান ঢাকার লালবাগ ও হাজারীবাগ এলাকায়ই মূলত কিশোর গ্যাং ছড়ানো-ছিটানো (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮২১টি মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা ১ হাজার ১৯১। ঢাকার উত্তরায় ‘অপু ভাই’ নামে খ্যাত টিকটক ভিডিও নির্মাতা একটি রাস্তা অবরোধ করে ৭০-৮০ জন মিলে টিকটক ভিডিও তৈরি করছিল। সে সময় রবিন নামে একজন প্রকৌশলী গাড়ি নিয়ে রাস্তা পার হতে গেলে অপুসহ তার দল মিলে মারধর করে ওই ব্যক্তির মাথা ফাটিয়ে দেয়।

একটি কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়েছিলেন এমন একটি ছেলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, নাম এইচ এম তাহমিদ সিফাত, বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, কোনো এক সময় কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সে।

১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী গ্যাং কালচারে ব্যাপক সহিংসতা প্রবেশ করে। অনেক ক্ষেত্রেই কিশোর গ্যাংদের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় সমাজের কিছু বড়ভাইয়ের ছায়া থাকে। তবে দলগতভাবে ছায়া প্রদানের চেয়ে অনেকেই মনে করেন ব্যক্তি পর্যায়ে সেল্টার বা ছায়া প্রদানই বেশি হয়ে থাকে। তবে যারাই নিয়ন্ত্রক/পৃষ্ঠপোষক হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। সবারই উচিত প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে উঠতি বয়সে নজরে রাখা, তারা কী করছে না করছে সব সময় খোঁজখবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে সময় দেওয়া। কিশোর অপরাধ কমাতে হলে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টাতে হবে। অপরাধী হিসাবে না দেখে শিশু-কিশোরদের কৃতকর্মকে মানসিক স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা জরুরি। দেশের একটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সংক্ষিপ্ত গবেষণায় দেখা যায়, সেখানে থাকা ৫৭ শতাংশ শিশু-কিশোরের মানসিক সমস্যা রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকের কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডারের জন্য সুচিকিৎসার প্রয়োজন।

আমাদের দেশে পর্যাপ্ত কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নেই। গাজীপুরে দুটি এবং যশোরে একটি শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য। সব মিলিয়ে এ তিনটির ধারণক্ষমতা মাত্র ৬০০ জনের। এ কারণে আটক শিশুদের বড় একটি অংশ কারাগারেই থাকে, উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না তাদের। এতে দেখা যায়, আদালতের নির্দেশে কোনো কিশোরকে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কিছুদিন পর সে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিশোরদের মনন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেধা ও প্রতিভা বিকাশে শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ স্কাউটস, গণিত অলিম্পিয়াড, রোবটিকস্ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন যেমন- সংগীত, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, লেখালেখি, নাটক ইত্যাদিরও প্রায়োগিক অনুশীলন অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন করতে হলে কমিউনিটি লিডারশিপ শক্তিশালী করতে হবে, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে। কমিউনিটিতে সুস্থ বিনোদনও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সন্তানকে বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলির শিক্ষা দিতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে এবং একইসঙ্গে সন্তানের আচার-আচরণের ওপর খেয়াল রাখতে হবে যাতে পারিবারিক শিক্ষা সমুন্নত থাকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে- ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে কিনা; স্কুলে মাদক সেবন, র‌্যাগিং ইত্যাদি হচ্ছে কিনা।

দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কোনো ধরনের অপরাধ বড় রূপ নেওয়ার আগে অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে।

আঠারো শতকের শেষে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের জন্য স্যালফোর্ড ল্যাডস ক্লাব নামে ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিল গ্রোভস্ পরিবার, আজ যার বিশ্বব্যাপী পরিচয় ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নামে। রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল, যিনি স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পরিচিত, তার হাত ধরেই এ ক্লাব সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। এভাবে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিলে এবং উন্নয়নমূলক কাজের দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে বাংলাদেশেও কিশোর গ্যাং নামক দুঃস্বপ্নের আধিপত্য কমে যাবে বলে আশা করা যায়।

মানবজীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো কৈশোর ও তারুণ্য। এই বয়সের মানুষের মধ্যে থাকে অদম্য প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তি কিশোর ও তরুণদের সতত কিছু করতে উৎসাহী করে তোলে। এ প্রাণশক্তি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তাহলে এরা সমাজে অনেক গঠনমূলক কাজ করতে পারে। লক্ষ্যবিহীন মানবজীবন অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কেউ বলতে পারেন ডাকাত দলের সর্দার হওয়াও তো একটি লক্ষ্য। আমি সেই ধরনের লক্ষ্যের কথা বলছি না। যে লক্ষ্য মানুষকে কল্যাণের পথে ধাবিত করে সে রকমটিই হওয়া উচিত লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্য।

পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম, ধারালো অস্ত্র হাতে দলবেঁধে চলা, পথিমধ্যে প্রকাশ্যে কাউকে কুপিয়ে জখম করা তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এসব কিশোরের সামাজিক পরিচিতিই হলো এরা অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসেছে। যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থায় অসচ্ছলদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই, সেহেতু তারা দৃশ্যমান নয়। তাদের আমরা দৃশ্যমান রূপে দেখতে পাই যখন তারা রাজপথে প্রকাশ্যে কাউকে ধারালো অস্ত্রে দিয়ে কোপাতে থাকে। বন্দুক বা পিস্তল দিয়ে কাউকে হত্যা করা অথবা আহত করতে যে সাহস বা মনের জোর দরকার তার চেয়েও অনেকগুণ বিকৃত সাহসের প্রয়োজন হয় কাউকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে। একজন কিশোর যখন এই কর্মটি করে তার অধঃপতনের ইতিহাসটি অনেক দীর্ঘ হয়ে ওঠে। এ রকম অবস্থায় তাকে শুদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন বলতে হয়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের দেশে কিশোর অপরাধীদের জন্য যে সংশোধনাগার রয়েছে সেগুলো কিশোরদের অপরাধ থেকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় দেখা যায়, সংশোধনাগারের জীবন একজন কিশোরকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। কিশোর গ্যাংদের সঠিক পথে নেওয়ার পন্থা গ্রহণের আগে ভালো করে জানতে হবে আলোচ্য কিশোরটি এমন পথে কী জন্য পা বাড়িয়েছে। এটা জানা সম্ভব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষণার মাধ্যমে। আমাদের দেশে উচ্চতর পর্যায়ে সোসিওলোজি পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে।

আগামী প্রজন্মের কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ এবং কলুষমুক্ত ও সুস্থ সমাজ গঠনে এখন থেকেই এই বিষয়ে সবাইকে বিশেষ করে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎপর এবং যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। তাহলেই গ্যাং কালচারের এই বিপথগামী তরুণদের অপরাধমুক্ত রাখা সম্ভবপর হবে এবং আগামী প্রজন্ম রক্ষা পাবে এক অসুস্থ সমাজ থেকে। জীবনের অতি মূল্যবান অংশের নাম তারুণ্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার, উদ্যম ও গঠনের এ এক সতেজ অধ্যায়। আর তাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ-সমাজ। এরাই তো নতুন সূর্য- সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার। এই সূর্য ক্ষয় ও অবক্ষয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়ার মানে, সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। কাজেই আমাদের কিশোর-তরুণদের অবক্ষয়ের রাহুগ্রাসে পতিত হওয়া থেকে অবশ্যই ফেরাতে হবে।

-আদিত্ব্য কামাল,সম্পাদক- জনতার খবর