দীর্ঘ ঐ সময়ের মরণজয়ী যুদ্ধে অনেক নারী হারিয়েছেন তাদের কলিজার টুকরো ধনকে। অনেক ভাগ্যবিড়ম্বিতা রমণী হারিয়েছেন তাদের প্রিয়তম স্বামীকে। অনেক ভাগ্যাহত পুত্র ও কন্যা হারিয়েছেন তাদের স্নেহময় পিতা-মাতাকে। তাদের কান্না আর আর চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল।
এরপরেই এ জাতির প্রতি মহান আল্লাহ দিয়েছেন রহমতের দৃষ্টি। আমরা বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে এনেছি ১৬ ডিসেম্বরে। গড়েছি পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। হয়েছি অনন্য। পেয়েছি শ্রেষ্ঠ বীরের খেতাব। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অহংকার। গৌরবের মহান বিজয় গাঁথা।
আমাদের এই বিজয় এবং স্বাধীনতা অর্জন সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সর্বপ্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক দের বিরুদ্ধে। ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশের টানা দুশো বছরের অপশাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন উলামায়ে কেরাম।
হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলবী সর্বপ্রথম ভারতকে দারুল হরব –শত্রু কবলিত বলে ঘোষণা করেছিলেন। তার এ ঘোষণা গোটা ভারতবর্ষে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ব্রিটিশদের উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বালাকোটের প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন মাওলানা সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও মাওলানা ইসমাইল শহীদ।
কেননা পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিপুণ ছলে বলে কৌশলে শোষণ করতে চায় পূর্ব বাংলাকে। জুলুম নির্যাতনের পাশাপাশি তারা মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতেও ড্রাকুলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তদানীন্তন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্বেও উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ।
১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত ভাষার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২৬ শেষ জানুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী খাজা নিজামুদ্দিন জিন্নাহর করা ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলে সরকার ও ছাত্র সমাজের মাঝে তুমুল প্রতিবাদ-লড়াই শুরু হয়। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার মানুষ।
সরকারের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্র সমাজ। ওই মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, সফিক, জব্বার সহ আরো অনেকে। শহীদদের তাজা রক্তের উপর দিয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মূলত এ শহীদদের আত্মত্যাগ পরবর্তী আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তোলে। যার পরিসমাপ্তি হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যায়ের নেতা এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এজন্য বারবার তার সামনে বাধার প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। হামলা মামলা করা হয়েছিল। তবুও দমে যাননি তিনি। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিয়োগ অর্জন করা সত্ত্বেও তাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠন নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভট্টোর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা বিফলে যাওয়ার পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় হামলা চালায়।
বাংলার ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালি সৈনিক থেকে শুরু করে অগণিত নিরীহ, অসহায় মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল তারা। ট্যাংক, কামান সহ আধুনিক মারনা অস্ত্র নিয়ে বাঙালি নিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছিল তারা। বাংলার সবুজ শ্যামল মাটি সিক্ত হয়েছিল নিরস্র বাঙালির লাল রক্তে। নদীর স্বচ্ছ জল ধারায় মিলেমিশে একাকার হয়েছিল রক্তধারা।
ওরা হাজার হাজার মা বোনের ওপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজের তছনছ করেছে বাংলার জনপদ। জল্লাদ বাহিনী নাটকীয় তাণ্ডব থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়েছে কোটি কোটি মানুষ । কিন্তু আনন্দ এবং গৌরবের বিষয় হলো দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই জল্লাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণজয়ী যুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার দেশপ্রেমিক ।
সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রামে। ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী সাহিত্যিক, ডাক্তার প্রকৌশলী, কৃষক শ্রমিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ব্রতি হয়েছিলেন বাঙালি সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। দেশপ্রেমের পবিত্র চেতনা উজ্জীবিত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের গৌরব অর্জন করেছে মুক্তি সেনার দল। পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। লাল সবুজের এক পতাকা।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণই হল মুক্তিযুদ্ধের শক্তির প্রধান উৎস।
১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি মোট ১১০৮ টি শব্দ উচ্চারণ করেন। মিনিটে গড়ে ৪৮থেকে ৫০ টি শব্দ বের হয় তার মুখ দিয়ে। বক্তব্যের শেষে তার তেজদীপ্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয়, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তার দুই একটি লাইন বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। তাই শুনুন, এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানে থাকুন আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান।
বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ-অব্যাহত থাকুক। স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে প্রচার করেছিলেন। এমনকি ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন । এর ফলে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল মানুষ। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। এবং সফল ও হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর আমরা যেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম তেমনটা এখনো পাইনি। বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক মুক্তি সাময়িক পেলেও আমরা আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো পাইনি। ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে কিন্তু জনজীবনে এখনো আসেনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান এখনো অনিশ্চিত। বরং এর বিপরীতে দুর্নীতির রূপ দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। সুতরাং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুষম বন্টন।
১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসটি আনন্দের সঙ্গে আমরা উদযাপন করি নানা ভাবে। আমরা ভেসে বেড়াই আনন্দের বেলায় । আমাদের দেশের সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পত পত করে ওড়ে আমাদের লাল সবুজের পতাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রোগ্রাম।
রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম সরকারি বেসরকারি টিভি চ্যানেল গ্রহণ করে নানা উদ্যোগ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিশেষ আয়োজন। শহর গ্রামের গাড়িতে বাড়িতে ওরে লাল সবুজের বিজয় নিশান। আমরা সবাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বীর শহীদদের। প্রাণভরে দোয়া করি তাদের জন্য। মূলত বিজয়ের আনন্দে উজ্জীবিত হয়েই এবং দায়িত্ববোধ থেকেই এই আনন্দ উদযাপন করি। বিশ্বকে আবার নতুন করে জানিয়ে দেই আমাদের গৌরবের গল্প ভান্ডার।
বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আমরা এখনো কেউ পাইনি। অথচ আমরাই প্রতিকূলও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। এর জন্য ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছে। উদাস্তু হয়েছে এক কোটি মানুষ।
তাই এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মশাল করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। হতাশা- নিরাশা ঠেলে প্রত্যয়ে ও উৎসাহে বুক বেঁধে এগিয়ে যাওয়ার। সেই লক্ষ্যে সকলের কাজ করতে হবে। আমাদের আরো অনেক দূর যেতে হবে। তবেই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা আমাদের জীবনে অর্থবহ হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।