মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে পিতার এরূপ আচরণ বেগম রোকেয়াকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অন্যান্য বিদ্যাশিক্ষা করার জন্য রােকেয়ার মন ছটফট করতে থাকে। তার বড় দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করার সুবাধে ভাইদের সহায়তায় তিনি বাড়িতে পড়াশোনার সুযোগ লাভ করেন। পিতা বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার ঘােরবিরােধী বলে রােকেয়া দিনের বেলায় পড়াশােনার সুযােগ পেতেন না। সেজন্য রাত্রিতে পিতা ঘুমালে ভাই সাবের বােনকে পড়াতেন এবং লিখতে শেখাতেন। এভাবে ভাইয়ের কাছে রােকেয়া গােপনে গােপনে লেখাপড়া শিখতে লাগলেন।
শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের দুর্দশা বেগম রোকেয়া নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। কারণ তিনি নিজেও নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে শৈশব কাটিয়েছিলেন। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারী স্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতার প্রতিবাদে বেগম রোকেয়াই প্রথম কণ্ঠস্বর। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের শুরুতে তিনি ছিলেন নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের প্রধান নেতা। মুসলিম সমাজের অন্ধকার যুগে নারী জাগরণে রোকেয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য, ব্যতিক্রমী। অবরোধের শৃঙ্খল ভেঙ্গে তিনি অসাধারণ সাহস, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে আসেন। বেগম রোকেয়াই প্রথমবারের মতো বাঙালি মুসলিম সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরেন এবং নারী স্বাধীনতার পক্ষে নিজের মতবাদ প্রচার করেন। নারীর সম অধিকারের জন্য যা যা করতে হয় সবই করেছেন মহীয়সী এই নারী।
‘ওঠো, জাগো’ -এ যেন বাংলার সমগ্র নারী জাতির প্রতি অনন্ত এক আলোর পথে যাত্রার আহবান। যে আলো থেকে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে নারীদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে ছলে, বলে, কৌশলে, পেশী শক্তির বল প্রয়োগসহ নানা উপায়ে। আজ থেকে ১১৬ বছর পূর্বে ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে অবরুদ্ধ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় যে সকল নারীরা কাল ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন বহুকাল, সেই সকল নারী জাতিকে শিক্ষা থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সকল অবরুদ্ধতাকে ভেদ করে এক মহা আলোর জগতে বেড়িয়ে আসার আহ্বান করেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন(১৮৮০-১৯৩২)। এমন এক কালজয়ী জাগরণের ডাক দিয়েই তিনি কিন্তু ক্ষান্ত হননি। নারী সমাজকে ঘর থেকে বের করে, শিক্ষায়, কর্মে উপযুক্ত করে তুলে, সংগঠিত করেছেন। হাতেকলমে ধরে ধরে শিখিয়েছেন। একদিকে নারীদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন অন্যদিকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলমের দ্বারা তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি মুসলিম নারী সমাজকে তাদের দুরবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সেই সময়ে নারীর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা, নারীসত্ত্বাকে চরমভাবে অপমান, নারীর শিক্ষা অধিকারকে নিষিদ্ধ করাসহ একদিকে যেমন পেশীশক্তির প্রয়োগ অন্যদিকে, ধর্মের দোহাই দিয়ে অবদমন করে রাখা হতো, বঞ্চিত করে রাখা হতো ন্যায্য অধিকার থেকে এমন কি প্রকৃতির মুক্ত আলো বাতাসের অধিকার থেকেও।
বেগম রোকেয়া শৈশবে অতি গোপনে, পর্দার আড়ালে থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন তা তাঁর হৃদয় ও মস্তিষ্ককে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করেছিল। তিনি সর্বান্তকরণে অনুধাবন করেছিলেন, ‘শিক্ষাই নতুন বিশ্বের চাবিকাঠি’ এবং শিক্ষাই পারে নারীকে অধঃস্তন ও দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত করতে। কেবলমাত্র শিক্ষিত করে তোলাই নয়, নারীর অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাবলম্বীও হতে হবে। সেই ইঙ্গিত তাঁর লেখনীতে স্পষ্ট- ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও নিজের অন্ন, বস্ত্র উপার্জন করুক’। সেই যুগেই তিনি এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যে শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরশীলতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য যেমন জরুরী তেমনি সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি সমাজে কঠোর মনোভাবাপন্ন, ধর্মবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর রচনাশৈলীর মাধ্যমে যে চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছিল, নারীর অধিকার এবং নারী মুক্তির প্রশ্নে তা ছিল অত্যন্ত মৌলিক, যৌক্তিক, আধুনিক এবং সর্বব্যাপী। তিনি একদিকে যেমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে পরোক্ষভাবে আঘাত করেছিলেন, অন্যদিকে প্রত্যক্ষভাবে নারীসমাজকে জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন। এই আহ্বানের মধ্যে দিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল নারীর ভাগ্যন্নোয়ন সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা। বিশ্বের নারী আন্দোলনে নারীর ভাগ্য পরিবর্তনের পূর্বশর্তই হচ্ছে- নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, ও আত্ম নির্ভরশীলতা। অন্ন-বস্ত্রের জন্য নারী যেন কাহারও গলগ্রহ না হয় নারীসমাজের কাছে এটাই ছিল তাঁর প্রত্যাশা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই ব্যাপক নারীসমাজের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ প্রকাশ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের রূপ ধারণ করে। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে নারী জাগরণের সূত্রপাত ঘটায়। সহস্র বছরের বঞ্চনা, অপমান এবং পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বহুমাত্রিক পন্থায় সমস্ত শক্তি দিয়ে পুরুষ যোদ্ধাদের পাশাপাশি থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল নারীরা। প্রকৃতপক্ষে সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল রোকেয়ার দেখানো পথ ধরে নারীসমাজে্র পূর্ণাজ্ঞ মুক্তির পথে যাত্রার।
আজ এই একুশ শতকে এসে বেগম রোকেয়ার প্রভাব রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যাক্তি জীবনে এতটাই সর্বব্যাপী যে, অবরুদ্ধ সমাজ থেকে বেড়িয়ে এসে নারীসমাজের সকল ক্ষেত্রে সাফল্যমণ্ডিত, গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের ঘটনা ছড়িয়ে পরেছে সারা বিশ্বে। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন, তাঁর আত্মত্যাগ, নিরন্তর প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে যায়নি। নারী ‘মানুষ’ এই কথাটি যে সমাজ স্বীকার করতেই চায়নি, সেই সমাজের আত্মবিস্মৃত নারীরা আজ স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। এমন কি হাজার বছরের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক প্রথা, সংস্কৃতি নারীর উত্থানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও নারী ক্রমান্বয়ে এসব প্রথা, সংস্কৃতিকে ভেদ করে নিজস্ব মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমান দিচ্ছে। সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের সুত্র ও শর্তের নানাবিধ প্রতিকূলতার মাঝেও নারীর উত্থান ও অগ্রযাত্রা আজ একটি অনিবার্য সত্য রূপ লাভ করেছে।
কাঁক ভোর থেকে শুরু করে হাজার হাজার নারী শ্রমিকের দৃপ্ত পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে শহরের রাজপথ অলিগলি। কৃষক নারীরা মাঠেঘাটে কাজ করেন, হাঁস মুরগী, গরুছাগল লালনপালন সহ নানা ধরণের কাজ করে সংসারের অবস্থা ফেরান। আর তাই বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীসমাজের বিশেষ ভূমিকা লক্ষণীয় তা আজ সর্বজনবিদিত। যে কারণে নারীর অগ্রযাত্রা, উন্নয়ন আজ ঈর্ষনীয় পর্যায়ে পৌঁচেছে। বিশ্ব বরেণ্য নোবেল বিজয়ী ডঃ অমর্ত্য সেন এদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় বিস্ময় প্রকাশ করে নারীকে ‘উন্নয়নের বাহক’ বলে অভিহিত করেছেন। এদেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে বিমান চালনা, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, কৃষি, শিল্প-কারখানা, পুলিশ, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, পাহাড়ের চূড়াতেও বাঙালি নারীর আজ দৃপ্ত পদচারনা। এমনকি আফ্রিকার গভীর জঙ্গল আমাজানেও এক বাঙালি বংশদ্ভুত তরুণী নারী পোঁছে গিয়ে সেখানে রাণীর মর্যাদায় বসবাস করছেন। শান্তি মিশনে গিয়ে নারীরা বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হচ্ছেন। তরুণ তরুণীরা একসাথে নাসায় কাজ করছে। এছাড়া মঙ্গল গ্রহে যাত্রার ঘোষণা দিয়েছেন এক বাঙালি তরুণী নারী। আজ এটাই প্রমানিত সত্য যে, নারীকে আর পুরুষতন্ত্রের দাসত্বের শেকলে বেঁধে রাখা যাবেনা। কারণ নারী-পুরুষ মিলেই গড়ে ওঠে একটি পরিবার, পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্র।
বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানীকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃত এবং ‘শান্তিবৃক্ষ’ পুরষ্কার প্রাপ্তি, কমনওয়েলথের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পদে আসীন হয়ে নারীসমাজের অবদান আজ বিশ্বের দরবারে বিশেষভাবে সমাদৃত হলেও প্রান্তিক নারী সমাজ আজও সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি বা উন্নয়নের মানদণ্ডে তাদের মূল্যায়ন করা হয়না। সম্পদ সম্পত্তিতে সমান অধিকার, নারী পুরুষের শ্রমমজুরী বৈষম্য আজ লক্ষণীয় মাত্রায় সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য ভূমিকা রাখছে। সেক্ষেত্রেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। কিন্তু নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেবলমাত্র পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষিত হলেই হবেনা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। যার ফলে আত্ম সচেতন বা অধিকার সচেতন না হবার কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যুগের পর যুগ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলেছে।
বর্তমানে দেশে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও উচ্চ শিক্ষার হার অনেক কম। পরিবারগুলো কন্যাশিশুর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ততটা সচেতন নন যতটা পুত্র সন্তানের প্রতি। বাল্যবিবাহ ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এর অন্যতম কারন। উচ্চ শিক্ষায় জ্ঞানের সৃষ্টিই সম্ভবত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস। শিক্ষা ব্যাতিত নারীর জীবনে অর্থনৈতিক সক্ষমতা আসতে পারেনা। আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছাড়া পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে নারীর জীবনের সার্বিক মুক্তিও সম্ভব নয়। নিজের, সমাজের এবং দেশের উপর অধিকার ও কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠায় আত্মশক্তির উত্থান ও সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।এই বোধকে জাগ্রত করা নারীর জীবনের জন্য আজ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বেগম রোকেয়ার ডাকে সারা দিয়ে দ্রুত ধাবমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু নারীর এই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে এক শ্রেণির দুষ্টু চক্র। শিক্ষায়, দীক্ষায়, খেলাধূলায়, প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জনে পুরুষের সাথে সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলছে, কিন্তু দেখা যায় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে হেনস্থা করতে, বা পেছনে টেনে ধরতে এক শ্রেণির পুরুষতান্ত্রিক শক্তি সর্বদা লিপ্ত রয়েছে। একজন নারী কেন নিকাহ রেজিস্টার হতে পারবেননা? একজন ইউ এন ও নারী হবার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুবরণ করলে তাঁদেরকে গার্ড অব অনার দিতে পারবেননা কেন? এমনকি এই যুগে আদালত প্রাঙ্গণে ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীকে বিবাহের ব্যবস্থা করে আপোষ মিমাংসা করার মত নজির সৃষ্টি হয়েছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দিনে দিনে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের ঔদ্ধত্য আচরণ দেখে স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। সম্প্রতি ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় হাফ পাস চাইলে, বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থীকে বাসের হেলপার ধর্ষণের হুমকি দেয়। চাকুরীর জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল কিন্তু তাঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি। টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণ ও ঘাড় মটকে হত্যা মামলায় ৪ জন্মের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন টাঙ্গাইলের আদালত। আমরা ভুলে যেতে পারিনা সোনাগাজির মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাতের শরীরে আগুণ ধরিয়ে দিলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বিচারের আকুতি জানিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরার দৃশ্য। এই ধরনের সহিংস, নৃশংস, নির্মম, অমানবিক ঘটনা ঘরে ঘরে, পথেঘাটে, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ঘটছে। জনগণের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মুখে দুই একটি ঘটনার বিচার হয় যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। এই কারণে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজরে রাখা উচিৎ।
বেগম রোকেয়া নারীকে জজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। অথচ কয়েকদিন আগে আমরা কি দেখতে পেলাম? বহুল আলোচিত বনানীর রেইনট্রি হোটেলে আপন জুয়েলার্সের মালিকের পুত্রের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলার সব আসামীকে খালাস দিয়ে রায়ের সময় ঢাকা ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার ধর্ষণের শিকার অভিযোগকারী তরুণীকেই দোষারোপ করলেন এবং রায়ের পর্যবেক্ষণে পুলিশকে পরামর্শ দিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে যেন মামলা না নেয়া হয়। তিনি এও বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দিয়ে আদালতের সময় নষ্ট করেছেন। অথচ হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য পারিপার্শিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর ভিত্তিতেই আসামীকে সাজা দেওয়া যেতে পারে। নারী অধিকারকর্মীরা বলেছেন, বিচারকের এই পর্যবেক্ষণ ধর্ষণের শিকার নারীর নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে ঠেলে দেবে তেমনি ধর্ষণকারীদের সুবিধা দেবে। উচ্চ আদালত বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছে।এবং নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিধান বাতিল হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় আইনমন্ত্রী। সম্প্রতি একজন সাংসদ মাননীয় প্রতিমন্ত্রীকে নারীর প্রতি অসম্মানজনক উক্তি করার অপরাধে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত অব্যাহত থাকবে আশা করছি।
আজও এই সমাজে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হাতুড়ীর আঘাতে থেঁতলে দেয়া হয়, কব্জি কেটে ফেলা হয়। ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পরে হত্যা করে লাশ এসিড ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। নারীর অগ্রযাত্রাকে দমন পীড়নের কৌশল হিসেবে এক শ্রেণীর মানুষ ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করে থাকে। প্রগতিশীল চিন্তা, চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য আমাদের দেশে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী শক্তি এদেশের মানুষের মেধাসহ সামগ্রিক অগ্রযাত্রার বিকাশকে ধ্বংস করতে তৎপর রয়েছে। যখনই নারীসমাজ জেগে ওঠে তাদেরকে কোণঠাসা করার জন্য নারী-পুরুষ সমস্বরে বাঁধা দেয়ার জন্য সোচ্চার হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি এবং বাস্তবতার নিরিখে প্রণীত আইন সমুহের মধ্যে যৌতুক নিরোধ আইন (১৯৮০), পারিবারিক আদালত আইন (১৯৮৫), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০) (সংশোধিত- ২০০৩), পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন (২০১০), মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন (২০১২), হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন (২০১২), প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন (২০১৩), DNA আইন (২০১৪) মহান জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়েছে। কেবলমাত্র আইন প্রণয়নই নারীর জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারবেনা। আর সেই কারণে প্রত্যেক নারীকে তাঁর ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে প্রয়োজনে আইনের দ্বারস্থ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। প্রথমে নিজের স্থানটি তৈরি করতে নিজেকেই লড়াই করতে হবে। যেখানে পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র আজও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি ধারণ করে এবং পুরুষতন্ত্রের দর্শনে বিশ্বাস করে, সেই কারণে নারী-পুরুষ এবং তরুণ সমাজের ঐক্যবদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমেই সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব।
শত সহস্র প্রতিবন্ধকতা এবং নানা সংকট মোকাবেলায় আমাদের বারবার রোকেয়ার কাছেই ফিরে যেতে হয়। আজ এই মহীয়সী নারী, নারী জাগরণের অগ্রদূত, পথ প্রদর্শককে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর দিনে গভীর শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় স্মরণ করছি। সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখতে আমাদের প্রতিদিনের চর্চায় বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করা উচিৎ। তাঁর দেখানো পথ ধরেই বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে তরুণ প্রজন্ম নানা চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হয়ে বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনছে। শান্তি মিশনে সফলতার সাথে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দেয়া এবং সাফ গেমস- ২০২২ এ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মত আরও বহু উদাহরণ এদেশের নারীদের জন্য বিদ্যমান রয়েছে।
যারা আজও জেগে জেগে ঘুমিয়ে আছেন তারা জেগে উঠুন। চোখ মেলে তাকান, দেখুন, আলোকিত জগত হাতছানি দিচ্ছে। নিজেকে মেয়ে মানুষ নয়, মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করুন। আশেপাশে অন্যায়, অবিচার, অসংগতি দেখলে প্রতিবাদ করুন, প্রতিরোধ গড়ুন। তবে, এর পাশাপাশি আজকের দিনে নারীর এই জয়যাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী অপশক্তিকে প্রতিহত করার জন্য সৃষ্টিশীল বিকশিত সম্ভাবনাময় সকল শক্তিকে সংগঠিত করে, সামনে এগিয়ে যেতে সচেতন সমাজের ঐক্যকে নতুন করে সুসংহত করাই আজ আমাদের একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম চ্যালেঞ্জ হোক।
প্রতিকূল সময় ও বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে লড়াই শৈশব থেকেই রােকেয়ার ভেতর জন্ম দিয়েছিল একজন আপসহীন সংগ্রামী নারীসত্তার। পুরুষশাসিত সমাজের বিধিনিষেধ তাকে এ চেতনায় উদ্দীপ্ত করে আত্মনির্ভরতার পথেই নারীজাতির প্রকৃত মুক্তি বা প্রগতি সম্ভব। ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে নারীর অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে রােকেয়া স্পষ্ট ধারণা পােষণ করতেন। তাই তিনি নারীসমাজের শাসনতান্ত্রিক অধিকার বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, পিতা ও অভিভাবকের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিতে অধিকার, জীবনােপায় অবলম্বনের অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে নানাভাবে দাবি উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সর্বাত্মক নারীমুক্তির প্রত্যক্ষ সংগ্রামই ছিল রােকেয়ার সংগ্রাম। তবে নারীমুক্তির নামে উগ্রতাকে তিনি কখনােই সমর্থন দেননি। এর প্রকাশ রয়েছে অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে । তিনি মূলত নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। অর্থাৎ সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যেই সংগ্রাম করেছেন। এ সাম্য তিনি যেমন কামনা করেছেন পরিবারে। তেমনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘মুক্তিফল’ প্রভৃতি রচনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্যে তিনি একান্তভাবে। উল্লেখ করেছেন পুরুষের সঙ্গে নারীর কল্যাণময় ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা। তাই তিনি পুরুষকে নারীর স্বামী নয় বরং অর্ধাঙ্গ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী যিনি সমাজ ও দেশের কল্যাণ দেখেছেন নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। আর তাই সমকালে তথাকথিত বনেদি মুসলিম পারিবারিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ছিল তার সংগ্রাম।
বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রপথিক রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেন । প্রকৃত নাম রােকেয়া খাতুন। স্বল্পায়ু। জীবনে তিনি সাহিত্যসাধনা ও বাস্তব কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে বাঙালি নারীর জীবনে সর্বপ্রথম আত্মমর্যাদা ও গৌরবের দীপ্ত মশাল প্রজ্জ্বলিত করে দিয়েছেন। সমাজের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী; অশিক্ষা ও কুসংস্কার তাঁর চেতনাকে সবসময় আঘাত করেছে। তাই এরই বিরুদ্ধে ছিল তাঁর আজীবন সংগ্রাম। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এ মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।
— কোহিনূর আক্তার প্রিয়া, বিশিষ্ট নারী সংগঠক ও সমাজসেবিক