মৃত্যু চিরন্তন সত্য। তাকে কেউ আটকাতে পারেনা। মৃত্যুকে মেনে নিয়েই মানুষ জন্মোৎসবে মেতে ওঠে। হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। মৃত্যুকে মেনে নিয়েই মানুষ প্রতিদিন বাঁচে এবং আরো বেশি বাঁচতে চায়। তারপর একদিন হঠাৎ করে চলে আসে সেই কাঙ্খিত মৃত্যু। কারো মৃত্যুতে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খীরা শোকাহত হয়। কারো শোক সামান্য দিনের জন্য, কারো শোক দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘায়িত হয়। প্রিয়জন হারানোর নিদারুণ কষ্ট নিয়ে কেউ তার বাকী জীবন কাটায়। কেউ জীবনের প্রতিটি পদক্ষপে প্রিয়জনের শূন্যতা অনুভব করে ভীষণভাবে। এরমাঝেই কিছু কিছু মৃত্যু এমনও আছে যার বেদনা সেই মানুষের নিজের আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন পেরিয়ে শোকের ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় শহরজুড়ে। তাদের শোক মিছিলে জড়ো হয় শতশত মানুষ। সে মৃত্যু অনাকাঙ্খিত, অনঅভিপ্রায়। সম্প্রতি এমন একটি মৃত্যু দেখল ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী।
গত ৮জুন হঠাৎ খবর আসে মৃত্যুর অমিয়সুধা পান করেছে শহরের সবার পরিচিত মুখ, সংগীতশিল্পী পার্থ সারথি গুহ। মাত্র ৪৩ বছরের টগবগে যুবক তিনি। লেখাপড়া শেষ করে, চাকরি-বাকরি জুগিয়ে সংসার গুছিয়ে নিয়েছেন আরো বেশ কিছুদিন আগে। তার ঘরে আছে ঘরনী, বাবা-মা, একমাত্র বোন, আর ফুটফুটে দুই পুত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রার্থ’দা সঙ্গীতকে ভালোবেসে যুক্ত হয়েছিলেন বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় গান পরিবেশন করে একটু একটু করে তিনি এগিয়ে চলছিলেন সফলতার পানে। বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। ঢাকায় থাকলেও ফেসবুকের কল্যাণে যুক্ত ছিলেন এলাকার সবার সাথে। নিজ শহরে ফিরলেই বন্ধুদের আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন তিনি।
কিন্তু এই বয়সে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু এসে হঠাৎ করে থামিয়ে দিল তার জীবন রথের চাকা। আর শোকে ভাসিয়ে গেল শহরের অগণিত মানুষকে। প্রার্থ’দা একজন গুণী মানুষ ছিলেন। সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল মানুষ ছিলেন। একজন ভালো মানুষ ছিলেন। অল্প সময়ে জয় করে নিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষের মন। তার এই অকাল চলে যাওয়া কাঁদিয়েছে সকলকে। বাবা-মা’র একমাত্র পুত্র সন্তান পার্থ’দা নিজেও ছিলেন দুই পুত্র সন্তানের জনক। তার ছোট পুত্রের বয়স বছর দু’য়েক হবে। জীবন-মৃত্যু কী জিনিস এখানো বোঝে না সে। আর দশ দিনের মত প্রতিদিন বাবার জন্য অপেক্ষা করে কাটে তার সময়। যে অপেক্ষা আর কখনো শেষ হবে না। বড় ছেলেটির বয়স ৮ বছর। মৃত্যু মানে চোখের আড়াল; মৃত্যু মানে আর ফিরে না আসা, এটা বুঝলেও তার অবুজ হৃদয় তা মানতে চায় না। এখনো তার মনের গভীরে উঁকি দেয় এই বুজি বাবা ফিরে আসলো, বাড়ীর বাইরে থেকে নাম ধরে ডাকলো। কিছু মাজাদার খাবার, কিছু খেলনা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে ‘আরে বোকা আমিতো কোথাও যায়নি’। তোমার সাথে লুকোচুরি খেলছিলাম মাত্র। বাবার সঙ্গে তার খুনসুটি, দুষ্টুমি আর মধুর আবদার গুলো এখনো তরতাজা স্মৃতি হয়ে ভাসে। বাবাকে করা কিছু প্রশ্নের উত্তর তার জানা হবে না কখনোই।
অকালে স্বামীকে হারিয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রী কিভাবে পার করবেন বাকি জীবন। রঙিন পোশাক ফেলে সাদা শাড়িতে দুঃখের সায়র পারি দিবেন কার ভরসায়। কিভাবে মানুষ করবেন পিতৃহীন অবুজ নাবালক ছেলে দুটো; সে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতিমুহূর্তে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। পার্থদা’র মমতাময়ী মা শহরের পরিচিতজন, বিশিষ্ট নারীনেত্রী তিনি। সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেও তাঁর ব্যাপক বিচরণ। সারাজীবন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে নিজেকে সর্বদা বিলিয়ে দিয়েছেন যেই নারী, সেই মমতাময়ী মা’র চোখে আজ দুঃখের পারাবার, বিষাদের কালোমেঘ। একমাত্র পুত্রসন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর মায়ের ব্যথায় ব্যথাতুর হয়েছে শহরবাসী। কিন্তু তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানা আছে কার ? কার সাধ্য আছে সে শোকের সামান্যটুকু ভার নেয়ার। প্রার্থ’দার বাবা বাদল গুহ একজন গুণী মানুষ। পেশায় সাংবাদিক। ভদ্র, সজ্জন, পরোপকারী মানুষ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত তিনি। সেই ভালো লোকটির বুকে তার যুবক পুত্রের শবদেহের ভার কাঁদিয়েছে শহরবাসীকে। আর হেসে খেলে-দুষ্টমি করে, খুনসুটি করে এক সাথে বড় হওয়া আদুরে ছোট বোন কীভাবে ভুলতে পারবে বন্ধুসম ভাইয়ের ময়াবী মুখ।
মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার পর পার্থ’দার সঙ্গীত ভক্তগণ ফেসবুক লাইভের তার বিভিন্ন গানের অংশবিশেষ প্রচার করেছেন, নিজেদের সঙ্গে থাকা হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো শেয়ার করেছেন। কেউ কেউ নানান স্মৃতির কথা উল্লেখ করে শোক প্রকাশ করেছেন। দুপুরে ঢাকার হার্ট অ্যাটাক করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। ঐদিন রাতেই লাসবাহী এম্বুলেন্স ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকপাড়ায় এসে পৌছে। সেখানে পূর্ব থেকে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও ভক্ত-গুণগ্রাহীদের উপস্থিতিতে সেই বাড়িটি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। স্বজনের আহাজারিতে ভারি হয়ে যায় আকাশ-বাতাস। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে শবযাত্রার মিছিল চলতে থাকে বাড়ি থেকে শ্মশান পর্যন্ত। শ্মশানের ঘাটে থেমে আসে সেই জনস্রোত। ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় রাত ১১ টায়। নাবালক পুত্রের হাতে পিতার নিথর দেহে মুখাগ্নি দিতে দেখে একেকজনের কলিজা ফাঁটা কান্না চলে আসে। সে কান্নায় কান্নার রোল ছড়িয়ে যায় শান্ত নদী তিতাসের মুক্ত বাতাসে।
মৃত্যু দ্রুব সত্য। মৃত্যুকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনা। মৃত্যুকে কেউ ফেরাতে পারে না। মৃত্যু বয়স মানে না। সময় বোজে না। নতুনকে স্বাগত জানাতে পুরাতনের চলে যাওয়াই স্রষ্টার নিয়ম, পৃথিবীর রীতি। সেই রীতি মানতে বাধ্য আমরা সবাই। পরপারে ভালো থাকুক প্রার্থ’দা। এপারে ভালো থাকুক তার রেখো যাওয়া স্বজন। বাবারমত ভালো মানুষ হয়ে উঠুক তার পুত্রদ্বয়।
বিঃ দ্রঃ গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমার লিখিত “রাজকুমার ও তোতা পাখির গল্প” নামে একটি শিশুতোষ গল্প বই বের হয়। ফেসবুকে সে বইয়ের খবর পেয়ে প্রার্থ’দার মা, মানে আমাদের নন্দিতা আন্টি বইটি নিজের ও তার নাতির জন্য নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বইটি দিতে আমি গিয়েছিলাম তাঁদের বাড়িতে। তখন মা’র সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলো প্রার্থ’দার বড় ছেলেটি। বই প্রদান দৃশ্যের ফ্রেমে ছিলো প্রার্থ’দার মা, স্ত্রী ও পুত্র। মাত্র কয়েক মাসের ব্যাবধানে সুন্দর ফ্রেমের একটির ছবিতে আমার সাথে থাকা মানুষদের জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে নেমে আসবে তা ভাবতেই নিজের মনে ভীষণ এক খারাপলাগা কাজ করে। সেই খারাপলাগা থেকেই এই লেখারটির অবতারণা। এটি লিখতে আমাকে উৎসাহিত করার জন্য তিতাস বার্তার প্রকাশক ও সম্পাদক এম এম মতিন শানু ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আহা জীবন’……এই বাক্যটি মৃত্যুর মাত্র দু’দিন আগে নিজের একটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছিলেন প্রার্থ’দা। আর মারা যাওয়ার আগে আগের রাতে গেয়েছিলে জনপ্রিয় একটি গান। সেই গানের অংশবিশেষ দিয়ে শেষ করছি আজকের লেখা….আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে/মনে পড়লো তোমায়/অশ্রু ভরা দুটি চোখ/তুমি ব্যথার কাজল মেখে/লুকিয়েছিলে ঐ মুখ/বেদনাকে সাথী করে/পাখা মেলে দিয়েছো তুমি/কত দূরে যাবে বলো/কত দূরে যাবে বলো/তোমার পথের সাথী হবো আমি।——————এই পথের সাথী একদিন আমাদের সবাইকে হতে হবে।
লেখক: মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী, সভাপতি-কবির কলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।