মিথ্যা অপবাদ দেওয়া জঘন্য অপরাধ

অপরাধ, 26 March 2022, 672 বার পড়া হয়েছে,

অন্যের নামে মিথ্যা দোষারোপ করা জঘন্য গোনাহ। কারও সম্মানহানি করার অধিকার অন্যের নেই। অহেতুক মানুষকে দোষারোপ করা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে আজ। কিছু পাপের কোনো কাফফারা হয় না। কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া তেমনই একটি পাপ। তাই কথা বলার সময় সতর্ক থাকা দরকার। ইসলামে মিথ্যা দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। এটা ঘৃণিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরশাদ হচ্ছে, তোমরা মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাকো। (সুরা হজ : ৩০)।

অপবাদ দেওয়ার ক্ষতি

মিথ্যা অপবাদে মানুষের সম্মানহানি ঘটে। কাউকে দোষারোপ করা, কারও নামে বদনাম বা দুর্নাম ছড়ানো তো দূরের কথা, কারও সম্পর্কে কিছু প্রমাণ ছাড়া বলাও বৈধ নয়। অপবাদ দেওয়ার প্রবণতা এক মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের সুসম্পর্কে চিড় ধরায়। সামাজিক ও জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যে কারণে ইসলামে অপবাদ দেওয়ার প্রবণতাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। ইসলামি দৃষ্টিতে অপর মুসলমানকে অপবাদ দেওয়া কবিরা গোনাহ। এরশাদ হচ্ছে, যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। (সুরা আহজাব : ৫৮)।

চক্রান্ত ও অপপ্রচার ফেরেশতারা রেকর্ড করে

সমাজে একজন অন্যজনের পেছনে লেগে থাকে। অকারণে অহেতুক অপবাদ, অপপ্রচার ও নানা চক্রান্তে মেতে থাকে। অথচ ইসলাম এগুলোকে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। এসব ফেরেশতারা রেকর্ড করে রাখে। এরশাদ হচ্ছে, দুঃখকষ্টের পর যখন সত্য অস্বীকারকারীদের কিছুটা অনুগ্রহ আস্বাদনের সুযোগ দেওয়া হয়, তখনই ওরা আমার বাণীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। হে নবী! ওদের বলো, আল্লাহ পরিকল্পিত কৌশল অবলম্বনে তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী। তোমাদের চক্রান্ত ও অপপ্রচারের পূর্ণ বিবরণ ফেরেশতারা রেকর্ড করছে। (সুরা ইউনুস : ২১)।

অপবাদ কাউকে কলঙ্কিত করতে পারে না

নিন্দা ও হিংসার অনলে পুড়ে ফুঁসে ওঠে কিছু অবুঝ অসতর্ক লোক। যারা মনে করে, অপবাদ দিয়ে অমুকের গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ব। অথচ এতে যে উল্টো তার বদনাম হয়, সেটা সে কল্পনাও করতে পারে না। বিপরীতে অপবাদগ্রস্ত ব্যক্তির গোনাহ মাফ হয়। এরশাদ হচ্ছে, চরিত্রহীনা নারী চরিত্রহীন পুরুষের যোগ্য আর চরিত্রহীন পুরুষ চরিত্রহীনা নারীর যোগ্য। চরিত্রবতী নারী চরিত্রবান পুরুষের যোগ্য আর চরিত্রবান পুরুষ চরিত্রবতী নারীর যোগ্য। কোনো মিথ্যা অপবাদই চরিত্রবানদের কলঙ্কিত করতে পারে না। এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবনোপকরণ। (সুরা নুর : ২৬)।

অপবাদ রটনাকারীর শাস্তি ভয়াবহ

অপবাদ রটনাকারী সাময়িক পার পেয়ে গেলেও আখেরে তার ধরা অনিবার্য। এরশাদ হচ্ছে, যারা চরিত্রহীনতার মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তো তোমাদেরই একটি দল। (কিন্তু এই অপবাদে যাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে) তারা যেন নিজেদের জন্য বিষয়টিকে ক্ষতিকর মনে না করে; বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। (অপবাদ রটনাকারী) প্রত্যেককেই এ পাপের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এদের মধ্যে যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন আজাব। (সুরা নুর : ১১)।

অপবাদদাতা সত্যত্যাগী

স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে নিজের স্বার্থের জন্য গল্পগুজব-আড্ডায় অন্যের দোষচর্চা, দুর্নাম, মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার প্রবণতা খুব বেড়েছে। জানাশোনা-পরিচয় নেই, তবু একজনকে যাচ্ছেতাই বলা হচ্ছে। যিনি বলছেন, তার পাপবোধ নেই। যারা শুনছেন, তারাও কিছু বলেন না। এসব কাজ কখনোই প্রশান্তি দেয় না। বরং জীবনে নেমে আসে অশান্তির মহড়া। একটা কথা শুনেই যাচাইহীন ধারণা করে ছড়ানো উচিত নয়। এমন কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। প্রচলিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন এর প্রথম কারণ। মানুষ একটা কথা শুনে এর সত্যায়ন না করে ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এভাবে একটা ভিত্তিহীন কথা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। এরশাদ হচ্ছে, কোনো পূতচরিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কেউ ব্যভিচারের অপবাদ দিয়ে যদি চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপবাদ রটনাকারীকে শাস্তি হিসেবে আশিটি বেত মারবে। আর কোনোদিন তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরা সত্যত্যাগী। (সুরা নুর : ৪)।

অপবাদের পরিণাম আখেরে

ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। জীবনের সব পর্যায়ে বিপর্যস্ত ও সমস্যাগ্রস্ত করতে এ পাপটিই যথেষ্ট। মানব ইতিহাসের পরিক্রমায় এ সত্যটিই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত বহু জাতি জ্ঞান-গরিমা, সম্পদ-সমৃদ্ধি, কৃষ্টি-কালচারে আকাশচুম্বী সফলতা অর্জন করলেও এ কারণে তারা সমূলে ধ্বংস হয়েছে। সমাজে নানাভাবে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। একজন অপরজনকে ঘায়েল করার জন্য মানবতাবিরোধী কাজটি অহরহ করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে হয়তো সাময়িক লাভবান বা আনন্দিত হওয়া যায়; কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণাম দুনিয়ায় যেমন রয়েছে, তেমনি আখেরাতেও রয়েছে কঠিন শাস্তি। এসব থেকে বিরত থাকতে এরশাদ হচ্ছে, মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাকো এবং মিথ্যা কথা পরিহার করো। (সুরা হজ : ৩০)।

মিথ্যা অপবাদ দেওয়া বড় জুলুম

কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটানোর মাধ্যমে ব্যক্তির ওপর জুলুম করা হয়। যার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। এ বিপর্যয় কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির ওপর আসে না, বরং সবাই এর ভুক্তভোগী হয়। রাসুল (সা.) মুসলমানদেরকে মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। কারণ আল্লাহতায়ালা মজলুমের দোয়া কখনও ফেরত দেন না। এরশাদ হচ্ছে, তোমরা ফেতনাকে ভয় করো, যা তোমাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে শুধু জালেমদের ওপরই আপতিত হবে না। জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। (সুরা আনফাল : ২৫)।

মিথ্যা অপবাদকারী হতভাগা

সাময়িক আনন্দ, প্রাচুর্য বা পদোন্নতি পেলেও মিথ্যা অপবাদকারীর চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই। সে দুনিয়াতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আখেরাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সব অপরাধের বোঝা বহন করবে। একপর্যায়ে নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা কি জানো, গরিব কে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘যার সম্পদ নেই, সে।’ তিনি বললেন, ‘গরিব হলো সে, যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছে, লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদের সেদিন তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (জামিউত তিরমিজি : ২৪১৮)।

বানোয়াট অভিযোগকারীর স্থান জাহান্নাম

কেউ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো বানোয়াট অভিযোগ করলে তা অভিযোগকারীর জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো বানোয়াট অভিযোগ আনল, সে যেন নিজেই নিজের স্থান জাহান্নামে করে নিল।’ (বোখারি :৩৫০৮)।

মিথ্যা রটনাকারীর ওপর আল্লাহর গজব

কোনো ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বললে সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর অন্যের ব্যাপারে বললে সে অনেককে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং নিজেও তার শিকার হয়। তাই মিথ্যা রটনাকারীর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব অনিবার্য হয়ে যায়। এরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই যারা গো-বাছুরকে (উপাস্য হিসেবে) গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আক্রান্ত করবে তাদের রবের পক্ষ থেকে গজব ও লাঞ্ছনা। এভাবেই আমি মিথ্যা রটনাকারীদের প্রতিফল দিই। (সুরা আরাফ : ১৫২)।

মিথ্যা রটনাকারী ব্যর্থ হয়

মিথ্যা কখনও সত্যে পরিণত হয় না। মিথ্যারোপ করে সাময়িক সাফল্য পাওয়া গেলেও চূড়ান্তভাবে সফল হওয়া যায় না। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সাময়িকভাবে কাউকে হেয় বা পাকড়াও করা যায় বটে; তবে প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা অপবাদ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। এরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে, সে-ই ব্যর্থ হয়। (সুরা তহা : ৬১)।

অপবাদ ক্ষণস্থায়ী

মানুষের জীবন দুনিয়াতেই শেষ নয়। আখেরাতের অনন্ত জীবনই মানুষের প্রকৃত বা আসল জীবন। সেখানেই তাকে চিরকাল অবস্থান করতে হবে। সত্য চিরস্থায়ী আর অপবাদ সবসময় ক্ষণস্থায়ী। এর স্থায়িত্ব একান্তই সাময়িক। পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এরশাদ হচ্ছে, দেখো, তারা কীভাবে মিথ্যা বলেছে নিজেদের ওপর! তারা যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের থেকে হারিয়ে গেল। (সুরা আনআম : ২৪)।