নারী দিবস – কোহিনূর আক্তার প্রিয়া

জনতার কন্ঠ, 8 March 2022, 277 বার পড়া হয়েছে,

আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লিঙ্গ সমতার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে পালিত হয় এই দিনটি।

১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নামেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। পরে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ক্লারা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন।

এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আন্দোলন আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সাল থেকে একটি দিন নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। পরে ১৯১৪ সাল থেকে বেশকয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।

এখন নানা রকম দিবসের সমারোহ। ডিম দিবস, বিয়ার দিবস, সাবানের বুদবুদ দিবস, টয়লেট দিবস, প্রেমের প্রস্তাব (প্রপোজ) দিবস, ঘুম দিবস, আলিঙ্গন দিবস এমনই সব বিচিত্র দিবসের ভিড়ে নারী দিবস এখন যেন কিছুটা ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। অনেকে আবার নারীর জন্য কেন আলাদা দিবস, এই তর্কে এখনও মশগুল।

মার্চ মাসের আট তারিখ নারীর জন্য আলাদা একটি দিন হিসেবে পালন করা নিয়ে তর্ক নতুন কিছু নয়। অনেকে নারী দিবস পালনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আবার কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, ঘর হোক বা বাইরে, যেকোনও ক্ষেত্রে সমমর্যাদার জন্য লড়াই তো বছরভরই চালিয়ে যেতে হয় মেয়েদের। তবে আলাদা একটা দিনের গুরুত্ব কী? সেই লড়াইয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য বছরের সব দিনই হোক নারী দিবস। একটি বিশেষ দিন বরাদ্দ করে নারীর লড়াই মাপা যায় না। সমাজে সমানাধিকারের দাবিতে মেয়েদের কতখানি লড়াই চালাতে হয়, একদিনের আলোচনায় সেটা ধরা যাবে না। বৈষম্যের রূপ কতখানি প্রকট, তা সকলের টের পাওয়া প্রয়োজন। প্রতিদিনই হোক নারী দিবস।

তবে নারীর জন্য একটা আলাদা দিন উদযাপনের জন্য থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশেষভাবে সময় বরাদ্দ করা না থাকলে, বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ভুল হয়ে যায়। ফলে নারীদের জন্য বিশেষ একটা দিন নির্ধারণ করাই ভালো। এ কথা ঠিক যে, আধুনিক সমাজে বদলেছে নারীর ভূমিকা। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও কি বদলেছে নারীর মর্যাদা? পেয়েছে কি প্রাপ্য অধিকার? সেটা ভাবার জন্যও ব্যস্ত জীবনে একটা নির্দিষ্ট দিন দরকার।

খাতায়-কলমের অধিকারগুলো বাস্তবে কতখানি ভোগ করতে পারছে, নারী দিবস সেটা খতিয়ে দেখার দিন। নারীদের কাজের পরিধি, আর্থিক ব্যবস্থায় অনেক বদল এসেছে ঠিকই। পরিবর্তিত সেই পরিস্থিতিতে অধিকারের লড়াই মাপার দিনও তো নারী দিবস।

এ দিবসের বুনিয়াদি তাৎপর্যটা উপলব্ধি করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নারীকে সমানাধিকার পাওয়ার জন্য যে সুদীর্ঘ লড়াই লড়তে হয়েছে সেই ইতিহাস ভুলে গেলে চলে না। কখনও কাজের অধিকার, কখনও সমকাজে সমমজুরির অধিকার, কখনও সম্পত্তির অধিকার, কখনও ভোটাধিকার একের পর এক অধিকার নারীকে অর্জন করতে হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ৮ মার্চ তারিখটা সংগ্রামের সেই সুদীর্ঘ ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক তো বটেই। নানা সামাজিক নিগড়ের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম যে আজও চলছে, তাও অস্বীকার করা চলে না। অতএব, বছরে একটা দিন সংগ্রামের যাত্রাপথটাকে স্মরণ করার আন্তর্জাতিক আয়োজনটির প্রয়োজন নেই, এমন কথা বলা যায় না। নারী দিবস আসলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অবমানকর প্রথা-পদ্ধতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দিন, পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারী দিবস শুধু নারীর দিন নয়, সমস্ত পিতৃতন্ত্রবিরোধী মানুষের উদযাপনের দিন।

সমাজ এগোচ্ছে। নারীর-অধিকার ও মর্যাদাও সমাজে বাড়ছে। নারীবাদীদের মিছিল থেকে ‘৮ মার্চ দিচ্ছে ডাক, পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক’ ধ্বনিও বাড়ছে। কিন্তু কিছু লোকের নারী-বিদ্বেষও পাশাপাশি বাড়ছে। একদল তো ৮ মার্চ সমানুভূতির সর্ব দর্প চূর্ণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশ্যাল মিডিয়ায়, ‘মেয়েদের জন্য আস্ত একটা দিন কেন শুনি, অ্যাঁ? ছেলেরা কি কম খেটে মরে? ছেলেরাও অত্যাচারিত, বঞ্চিত! সংসারে ছেলেদের অবদান কি কম? তাহলে পুরুষের জন্য কোনও দিবস নেই কেন? আমাদেরও দিবস চাই’ ইত্যাদি বলে মাঠ গরম করে ফেলেন। কিন্তু একটা কথা তাদের বুঝতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে নারী এবং পুরুষের অনেক সমস্যা এক মনে হলেও তার ফল মেয়েদের জীবনে সব সময় বহুমাত্রিক। মেয়েদের এবং ছেলেদের অবস্থানে আজও অনেক ফারাক। অনেক মেয়েও ইদানীং গর্বভরে বলেন, ‘আমার নারীজন্ম ভীষণ সুখের। বাবা-মা আমায় ছেলের মতো পুত্রস্নেহে বড় করেছেন’। কিন্তু এই সোহাগীরা ভুলে যায় ব্যতিক্রম নিয়ম নয়। খুব মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গোটা প্রাণজগতে মেয়েরা প্রকৃতপক্ষে মেয়ে মাকড়সার মতো নিজের শরীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খাইয়ে মৃতদেহ হয়ে ঝুলের সঙ্গে ঝুলে থাকে। তারপরে কখনও কালবৈশাখী ঝড় এলে, সে মৃতদেহ উড়ে যায় নিরুদ্দেশে। কিন্তু এটা উপলব্ধি করতে পারে কয়জন?

আসলে এসব ছেলে-মেয়ের দোষ নেই। তাদের অনেকেই সম্ভবত দিনটির ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা জানেন না। আর পোশাকি উদযাপনের ঘটায় সে ইতিহাস গিয়েছে হারিয়ে। নারী দিবস এখন অনেক পোশাকের দোকানে ছাড়ের উৎসব! বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির গালভরা বিজ্ঞাপন!

নারী দিবস যখন মূলধারার ‘উৎসবে’ পরিণত হলো, রাষ্ট্র থেকে করপোরেট, সবাই যখন নারী দিবস নিয়ে মাতামাতি শুরু করল, তখন অধিকার আদায়ের ইতিহাস, নারীর বঞ্চনা, বৈষম্যের মতো ‘অস্বস্তিকর’ প্রশ্নকে সরিয়ে রাখা হলো। নারী দিবসের পেছনে যে মেয়েদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নটি আছে, সেটি সুচতুরভাবে সবাইকে ভুলিয়ে দেওয়া হলো। কারণ, মেয়েদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বঞ্চনা আজও কমেনি। আইন যা-ই বলুক, আজও নারী-পুরুষ সমান কাজে সমান মজুরি পায় না, মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ চাইতে আজও কুণ্ঠাবোধ করে, সম্প্রতি আমাদের দেশে অর্থকরী কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ পর্যন্ত কমতির দিকে। যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কোনও কিছুই স্বস্তিকর পর্যায়ে আসেনি। ৩০ বছর আগে মেয়েদের জীবনের যে সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে ৩০ পর আজও তা প্রাসঙ্গিক। মেয়েদের জন্য অদৃশ্য খাঁচা আজও ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। এত নারীশিক্ষা, সচেতনতার অনুষ্ঠান তবু নারী নিঃশঙ্ক নয়। মেয়েরা নির্যাতিত হবে, এটা ধ্রুবতারার মতো সত্য।

শ্রম আর বেতনের সমতা নিয়ে রাস্তায় নেমে দেড়শ বছর আগে যে মেয়েরা নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেছিল, অনেক ক্ষেত্রে তার সামান্য অংশও বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টে যে মেয়েটি ভোরের আগে উঠে কোনও এক মফস্বল শহরে ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়ে একবেলা শাক আর ভাত খেয়ে বাঁচে, তার কাছে নারী দিবস অর্থহীন। সে তো স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তাকে নারী দিবস কী দিতে পেরেছে? অনাহার, অন্ধকার, কখনওবা বাড়ি বয়ে আসা বাইকধারী পুরুষের ধর্ষণের হুমকি! প্রেমিক হতে চাওয়া পুরুষ যে মেয়ের গায়ে অ্যাসিড ছুঁড়ে তার মুখ পোড়ায়, তাকে নারী দিবস কী দিয়েছে? থানার সামান্য নিরাপত্তাটুকু দিতে পারেনি তাকে। উল্টে বেইল পাওয়া সেই পুরুষ রোজ তার বাড়িতে হুমকি দিচ্ছে। মুখ তো পুড়েছে, এ বার শরীরের পালা। ধর্ষণ!

তবুও নারী দিবস হয়। শাড়ি আর গয়নার ছটায় মঞ্চ আলো হয়। ‘উইমেন ইন লিডারশিপ’ করপোরেটের বড় মুখ, সমাজকর্মীরা, সমাজের গণমান্য নারীরা সম্মানিত হন। নিঃসন্দেহে তারা নিজেদের জায়গায় কৃতী। লড়াই তাদেরও আছে। তবে শুধু তাদেরই আছে। তারা ‘করে দেখাতে’ পেরেছেন। আর যারা দেখাতে পারছে না? কিন্তু নিয়ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের গায়ে মাটির গন্ধ, শ্রমের লড়াইকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য কি তবে অন্য কোনও দিবসের অপেক্ষায় আরও অনেক শতাব্দী পার হয়ে যাবে?

নারী দিবসের বিপরীতে পুরুষ দিবস পালনের দাবি তোলার মধ্যেই পুরুষদের কর্তব্য শেষ হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। সোচ্চার হতে হবে পুরুষদেরও। নারীর দাবি তো আসলে মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করারই দাবি। নারীর এই দাবি পুরুষের দাবিই বা হবে না কেন? পুরুষদেরও তো নিছক পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই বাঁচতে হবে। তারা যদি নারীর বাঁচার দাবির অংশ থেকে বেশিটা কেড়ে নেয়, তাহলে যে মনুষ্যত্বের মধ্যেই টান পড়বে এটা উপলব্ধি করতে হবে।

নারীকে নিয়ে ভাবতে গেলে, কথা বলতে গেলে কিম্বা লিখতে গেলে এখন আর আগের মতো বুকের মাঝে আবেগের নদী দুলে উঠে না। চোখের দেখা প্রাণের সখার কাব্যকলাও ফুটে উঠে না। নারী যেনো এই সমাজ, সংসার, সভ্যতা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির জন্য একরকম বিষফোঁড়া। ফলে সর্বত্রই নারী আজ উপেক্ষিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত তথা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার। নারী হাসলে এখন সুখের মুক্তো ফোটে না। আড়ালে আবডালে বলা হয় – কি বেহায়া রে মেয়েটি! নারী সাজলে এখন আর সে অপরূপা হয়ে উঠে না। পেছনে টিপ্পনী কাটা হয়- যে চেহারা ও বয়স তাতে আবার সাজুগুজু!

নারী কাঁদলে কারো মনে দুঃখের পাষান জমেও না। পাশ থেকে বলা হয়- আর কতকাল অভিনয়টা চালিয়ে যাবে! নারী স্বাধীন ভাবে বাঁচার পথ খুঁজতে পথে নামলে, কিম্বা পরিবার কর্তৃক লাঞ্ছনা গঞ্জনা থেকে মুক্তি পেতে গৃহত্যাগ করলে অপেক্ষায় বাতায়ন খোলা থাকে না। তার আপাদমস্তক কলঙ্কের কালিমা মাখিয়ে সংসার নতুন করে সেজে উঠার প্রশ্রয় পায়। নারী আত্মহত্যা করলে কিম্বা অপঘাতে তার মৃত্যু হলে চারপাশ যেনো নিঃশব্দ মুক্তির অক্সিজেনে ভরে উঠে। শুধু তাকে ঘিরে গুজবের ডালপালার আঁধার নামে।

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের পঙক্তিমালা ইদানিং মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। নারীরা যে ঘর সাজায়, বংশের লতিকায় গিট দেয়, সন্তানদের কোলে পিঠে করে মানুষ করে, স্বামীর বিশ্বস্ত প্রেমিকা, প্রেমময় প্রহরীর গুরুদায়িত্ব পালনে উদয়াস্ত পরিশ্রমে সংসার তরণীর গুণটেনে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এর কোনই স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ) হয়না।

সংসারে কন্যাশিশু জন্মের পর বোধবুদ্ধির উন্মেষের সাথে সাথে তার মগজে চাপিয়ে দেয়া হয় এভাবে চলোনা, ওখানে যেও না, এটা ধরো না, ওটা খেয়ো না- এমন হাজারো না–না। বাড়ির নারীরাই কন্যাশিশুদের অন্যতম শিক্ষাগুরু। বাবাদের শাসনে, ভাইদের একচক্ষু উদাসীনতায়, চাচাতো, ফুফাতো, পাড়াতো ভাইদের যৌন হয়রানির নাগপাশ কাটিয়ে অধিকাংশ কন্যাশিশুরা হাতে পায়ে বেড়ে উঠে। তখন তাদের উপর সংসারের ফুট ফরমায়েশের বোঝা দিনে দিনে চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমতঃ সংসারে মাকে সাহায্যের নামে, অতঃপর পরের ঘরে ( শ্বশুরবাড়ি ) গিয়ে যেনো কাজকর্ম করে সংসারে টিকে থাকতে পারে সেটার প্রশিক্ষণ নেওয়া কিশোরির জন্য আবশ্যিক হয়ে উঠে। এটাই নারীর ললাট লিখন।

‘আয় ছলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যায়
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।’
কবির এ আহ্বান কতভাগ শিশুকন্যার কপালে জোটে? নব্বই ভাগ কিশোরী বা নারীর আয়ে এখন সংসার চলে। এর বেশির ভাগ পোশাক শিল্পে, কুটির শিল্পে অথবা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে, মাঠে, ঘাটে, মানুষের বাড়িতে শ্রমে। নতুবা পরদেশে পাচার হওয়া নারীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ হয়। বিনে পরিশ্রমে তারা ঘরে বসে স্ফূর্তি করতে পারেনা। নারীকে জীবনভর চরম মূল্য দিয়ে সমাজ সংসারে টিকে থাকতে হয়।

নারীর জন্য নির্ভার, নিশ্চিন্ত, সম্মানজনক কর্মস্থল আজও গড়ে উঠেনি। বিবাহিত, সন্তানদের জননী নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে পরিবেশের মতো অবিবাহিত, কুমারী বা তালাকপ্রাপ্ত নারীর পরিবেশ নিরাপদ নয়। পুরুষকর্মীদের কর্তৃত্ববল, অর্থবলের কাছে নারীরা অসহায়, লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিত, নিগৃহীত। নারীর কর্মের পরিবেশের পাশাপাশি তাদের কর্মঘন্টা এবং মজুরীর (প্রাপ্য অর্থ) বৈষম্যও অমানবিক। পুরুষের তুলনায় নারীর বেতন ভাতা কম। পরিশ্রমের দিকদিয়েও শুভঙ্করের ফাঁকি। পুরুষ শ্রমিকের ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে চা পান, ধূমপানের অবসর-অবকাশ আছে, নারীর বেলায় সুদূরপরাহত। শিশুকে কর্মক্ষেত্রে রাখা, স্তন্যপান করানোর কোন পরিবেশ আজও অনেক প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেনি। অথচ সেই ১৮৫৭ সাল থেকে বেতনভাতার বৈষম্য দূরীকরণ, কর্মের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী, নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার জন্য আজ অবধি নারীদের আন্দোলন বা লড়াই চলে আসছে। প্রতি বছর ৮ মার্চে পালন করা হচ্ছে বিশ্বনারী দিবস।

নারী আন্দোলনের মূল লক্ষই ছিলো নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, কাজের স্বাস্থসম্মত পরিবেশ তৈরি করা, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা এবং নারী পুরুষের বেতন বৈষম্যের অবসান ঘটানো। আমরা এই দাবিগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে সরে এসেছি। নারীরা কর্মক্ষেত্রে কতটা বিব্রত, নিগৃহীত, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছে সেটা আমরা অনুসন্ধান করিনা। নারীর প্রতি প্রতিষ্ঠানের বস (মালিক), সহকর্মী, পুরুষ শ্রমিক কতটা অমানবিক, বেতন বৈষম্যের পাল্লাটা কতটা ভারসাম্যহীন, নারী কর্মীরা কতভাবে পুরুষদের স্বেচ্ছাচারী যৌন উৎপীড়নের শিকার এবং তাদের হাতের পুতুল সেই দিকগুলোর কোন হিসাব আমাদের হাতে নেই। যাওবা আছে তা কেবলই অনুমানমাত্র। আমরা কোন ভাবেই নারীদের কর্মক্ষেত্রের এমন অনিশ্চয়তা, অসম্ভ্রম, নিপীড়ন এবং নির্যাতনের অলি-গলি চোরাপথের সন্ধান করতে পারিনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগড়ে নিষ্পেষিত নারীরা যতোদিন না সচেতন হবে, সোচ্চার হবে এবং এই আন্দোলনের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে ততোদিন তারা কোন ভাবে সফল হতে পারবে না ।

এখনকার নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, বঞ্চনার করুণ ইতিহাস কি সেই শত শত বছর পূর্বের আইআয়ে জাহেলিয়াত এর চেয়ে ভালো? আমাদের এই আধুনিক শিক্ষিত সমাজে নারীরা মর্যাদায়, স্বাধীনতায়, চিন্তা ভাবনায়, নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার কি নারী সমাজের আছে? ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিনোদনে সর্বত্রই নারীর স্বকীয়তা ভূলুণ্ঠিত। কর্মক্ষেত্রে কয়জন নারী তার বস-সহ সহকর্মীদের মন জুগিয়ে চলা থেকে নিস্কৃতি পেয়েছেন বা পাচ্ছেন? নারী তাদের কাছে জ্ঞান গরিমায়, শারীরিক শক্তিতে সর্বপরি বেতনের দিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু। ঘরে যেমন তারা উপেক্ষিত, উৎপীড়িত থাকে তেমনি তারা বাইরেও একই পেরেশানিতে সময় অতিবাহিত করে।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে সমাজ সংসারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিল্প বানিজ্যে, সাহিত্য সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া সুস্পষ্ট হলেও, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নগর বন্দরে আধুনিকায়নের চাকচিক্য দৃশ্যমান হলেও নারীর উন্নয়নে, স্বাধীনতায়, নিরাপত্তায়, যথার্থ সম্মানে অংশিদারিত্বে কোন স্বীকৃতি নেই। শিক্ষা দীক্ষায় নারী কতটা এগিয়ে, কর্মক্ষেত্রে নারীর কর্তৃত্ব কতভাগ এবং নারীর সম্মান, সম্ভ্রমের নিরাপত্তা কতটা সুনিশ্চিত তার কোন রূপরেখা বা নীতিমালা আজও অলিখিত। পথে ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, সংসারে নারীর শ্লীলতা হানীতে প্রশাসনিক আইন প্রণয়ন তথা বিচারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কতটুকু নিশ্চত হয়েছে তার যেমন কোন দলিল নেই তেমনি আইন অমান্যের ফাইনের প্রমাণও নাই। আর সেকারণে নারী আজ একশ্রেণী মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে বিনোদনের ও তামাশার বস্তু। তাইতো নারীর হাসি, নারীর সাজ, নারীর ভালোথাকা, নারীর সৃজনশীলতা এবং স্বাধীন কর্মপরিধিকে নিয়ে কটাক্ষ করা হয়, তুচ্ছাতিতুচ্ছ হিসাবে গন্য করা হয়।

৮ মার্চ কেনো, কি, সেটাই আগে নারীদের অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। ১৮৫৭ সালের মতো তাদেরও রুখে দাঁড়াতে হবে, দাবী আদায়ে একজোট হতে হবে। সর্বপরি নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে শিক্ষা দীক্ষায় জ্ঞান গরিমায়। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র দিন এখন আর নেই। সামনের লোকে কতটা সম্মান করে, করতে বাধ্য হয় সেটাই মাথায় রাখতে হবে। তাহলেই বিশ্ব নারী দিবসের আন্দোলন, উদ্দেশ্য সফল হবে। এককে আলোকিত হয়ে কোনই লাভ নেই। বরং সকলের আলোকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসেই নারীরা উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ পাবে এবং তাতেই আন্তর্জাতিক বিশ্বনারী দিবসের মর্যাদা সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে।