যুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি -জাকারিয়া জাকির

মতামত, 26 February 2022, 666 বার পড়া হয়েছে,
এই পৃথিবীর রূপ আসলে ভীষণ সুন্দর। সৃষ্টিকর্তা তার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে এই পৃথিবীকে অপরূপ প্রকৃতি দ্বারা সাজিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সাধারন চোখে বিশ্বের এই অপরূপ রূপ ধরা দেয় না। তার কারণ মানুষের অহংকারী সভ্যতা দ্বারা এ বিশ্বকে কলুষিত করেছি আমরাই। অহংকারী মানবজাতির তেমনি একটি ভয়ঙ্কর সৃষ্টি হল যুদ্ধ।
লোভ, হিংসা, দ্বেষ এই সবই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু সেই সকল আবেগ গুলিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই মান আর হুশ নিয়ে মানুষের জন্ম। কিন্তু মানুষ নিজের সেই মনুষত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে সেই সুদূর অতীতকাল থেকে নিজেদের দানবীয় আবেগের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের মধ্যে লিপ্ত হয়েছে যুদ্ধে।
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ সংঘবদ্ধ সামাজিক জীবনে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সে যুদ্ধ ছিল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। মানুষ সে লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল বলেই আজ বিশ্বসভ্যতা গৌরবময় শিখরে আরোহণ করেছে। আজও বিশ্বের সর্বত্র যুদ্ধের দামামা বাজতে শোনা যায়। আজকের দিনে মানুষের যুদ্ধ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে নয়, যুদ্ধ হয় মানুষকে ধ্বংস করার জন্যেই। যুদ্ধের এ উন্মত্ত আয়োজন বিশ্বশান্তিকে করেছে বিপর্যস্ত, উন্নয়নের গতিকে করেছে স্তিমিত।

অতি প্রাচীনকাল থেকে একদিকে যেমন চলেছে সভ্যতা নির্মাণের প্রচেষ্টা, তেমনি চলেছে সভ্যতা বিধ্বংসী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধের হোলিখেলা। ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছে যুদ্ধে। নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডারের যুদ্ধংদেহী মনোবৃত্তির কারণে সভ্যতার গতি গেছে থমকে। চলতি শতাব্দীর শুরুতে প্রথম মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়া। প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার ক্ষত না শুকাতেই চল্লিশের দশকে বিশ্ববাসীকে জড়িয়ে পড়তে হয় আরেকটি মহাযুদ্ধে। এরপরেও ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া, লেবানন, এঙ্গোলা, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি স্থানে সংঘটিত হয়েছে বর্বর যুদ্ধ। অতি সম্প্রতি ইরান-ইরাক, ইরাক-কুয়েত, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ ছাড়াও রুয়ান্ডা, জায়ার, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, বসনিয়া, কাশ্মীর, চেচনিয়া প্রভৃতি স্থানে জাতিগত সংঘাত এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরাচ্ছে। সম্প্রতি সিরিয়ায় সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে চলছে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ, যা ঐ দেশের জনগণের শান্তি বিনষ্ট করছে।

মানব চরিত্রের পশু প্রবৃত্তির প্রাবল্যে অধিকাংশ সময় মানুষ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠেছে। হিংসা, বিদ্বেষ, সম্পদের অসীম লোভ, প্রভাব বিস্তারের লালসা, ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক স্বার্থপরতা যুগে যুগে যুদ্ধের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে। তবে একথা সত্য, অদূরদর্শী রাষ্ট্রনেতাদের চরম দায়িত্বহীনতার কারণে সংঘটিত যুদ্ধে সাধারণ মানুষ কোনোদিনই অংশ নেয় নি, শান্তিপ্রিয় জনগণ যুদ্ধের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে মাত্র।

যুদ্ধ মানবতাকে পদদলিত করে। যুদ্ধ মানে রক্তপাত, যুদ্ধ মানেই ধ্বংসলীলা। যুগে যুগে যুদ্ধের তাণ্ডব মানুষের ভাগ্যকে করেছে বিড়ম্বিত, সভ্যতাকে করেছে বিপন্ন। হিরোশিমা ও নাগাসাকি আজও বিশ্ববিবেককে বিচলিত করে। যুদ্ধের কারণে কত নিরপরাধ মানুষ যে অকালমৃত্যুর শিকার হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কত স্বামী হারিয়েছে প্রিয়তমার মুখ, কত স্ত্রী হারিয়েছে প্রাণপ্রিয় স্বামী। আর কত মায়ের বুক শূন্য হয়েছে তারও কোনো লেখাজোখা নেই। বিশ্বের উন্নয়নধারাকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে দেয় নি যুদ্ধ। যে বিপুল সম্পদ যুদ্ধের রসদ ও অস্ত্র সংগ্রহে ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে এই ভূপৃষ্ঠ সোনার প্রলেপে ঢেকে দেওয়া যেত। যুদ্ধ মানুষে মানুষে, দেশে-দেশে ও জাতিতে-জাতিতে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে, বৃদ্ধি করে উত্তেজনা।

সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্তির দিশা খুঁজেছে। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কখনোই যুদ্ধের পক্ষে ছিল না। মানুষ চায় শান্তি ও সমৃদ্ধি। জীবন-বিকাশের পথকে সুন্দর করার প্রয়াসে মানুষ সর্বদাই শান্তির পক্ষে। ধর্মপ্রচারক, সংস্কারক ও মানবতাবাদী মহামানবেরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করে গেছেন। মহানবি (সাঃ) নবুয়ত লাভের আগেই যুদ্ধময় আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তি সংঘ ‘হিলফুল ফুযুল। শ্রী চৈতন্য, কবীর প্রমুখ ধর্মগুরু শান্তির পক্ষে কাজ করেছেন। বড় বড় কবি, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সমাজকর্মী যুদ্ধের দামামা থামিয়ে শাস্তির অমিয় বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নিজেদের শ্রম ও মেধাকে নিবেদন করেছেন।

মাত্র দু’যুগের ব্যবধানে দুটি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বব্যাপী জেগে ওঠে শান্তি বাদী চেতনা। রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মীরা বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে একটি বিশ্বসংস্থার চিন্তা-ভাবনা করেন। অবশেষে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয়’ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ বা জাতিসংঘ। বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা একশ তিরানব্বই- যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের কলহ-বিবাদ মেটানো ছাড়াও আগ্রাসী শক্তির দমনে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালন করছে । ন্যাটো , জিসিসি, কমনওয়েলথ, ইইউ, আসিয়ান প্রভৃতি সংস্থা বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে বর্তমানে প্রশ্ন উঠেছে। মূলত জাতিসংঘ বর্তমান বিশ্বের সংঘাত নিরসনে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবানন, সোমালিয়া, কাশ্মীর প্রভৃতি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা ব্যর্থতায় ভরা। জাতিসংঘ এখন বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের আজ্ঞাবহ এক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ফলে বৃহত্তর শক্তিগুলোর ইচ্ছামতো তাকে ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সক্রিয় উপস্থিতি সত্ত্বেও উপদলীয় সংঘাত লেগেই আছে। ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর ইসরাইলী বাহিনীর নৃশংস দমন – নিপীড়ন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। পাকিস্তান ও ভারতের মতো দুটি প্রতিবেশী দেশ পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। তাদের হাতে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। এক্ষেত্রে উত্তেজনা প্রশমনে কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

স্বার্থান্বেষী মহল ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধের ইন্ধনদাতা। বৃহত্তর শক্তিগুলো তাদের অস্ত্রের বাজারকে সম্প্রসারিত রাখার লক্ষ্যে একমুখে শান্তির কথা বলছে, অন্যমুখে যুদ্ধের আগুনে তেল ঢালছে। তা সত্ত্বেও বিশ্ব মানবতা আজ সেই দিনটির প্রতীক্ষায় রয়েছে, যেদিন দুনিয়ার আকাশ-বাতাস থেকে থেমে যাবে যুদ্ধের দামামা।