অনলাইন গেম ও ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে তরুণ প্রজন্ম বিপথে

মতামত, 14 January 2022, 442 বার পড়া হয়েছে,
ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট এখন বেশ সহজলভ্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং স্মার্টফোনের সহজপ্রাপ্যতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহারে বাড়ছে বিভিন্ন অপরাধ। তরুণ-তরুণীরা বিগো, লাইকি-টিকটকের অশ্লীল ভিডিওতে নাচ, গান ও অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেদের ধূমপান ও সিসা গ্রহণ করার ভিডিও আপলোড করছেন। ‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ভয়ঙ্কর আসক্তি তৈরি করছে। ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। বর্তমানে এর প্রভাব খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এ আসক্তিকে সম্প্রতি ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিশুদের অনলাইন ভিডিও গেম নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। অনেক দেশই শিশুদের ভিডিও গেমসের ওপর মনিটরিং করছে।
যদিও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। শিশুদের অতিরিক্ত ভিডিও গেমস আসক্তি নিয়ে দেশের বিশেষজ্ঞরাও অনেকদিন থেকে চিন্তিত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ভিডিও গেম শিশুদের সামাজিকীকরণে বাধা দেয় এবং এর ফলে মেধা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া বর্তমানে অনেক শিশুর আচরণেও পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ভিডিও গেম খেলতে বাধা দিলে অনেক শিশু চিৎকার চেঁচামেচি করে, উচ্চস্বরে কথা বলে, রাগ দেখানো এবং অন্যান্য কাজে খুব বেশি মনোযোগ দিতে চায় না। গেম খেলতে না দেওয়া কিংবা এমবি কেনার টাকা না দেওয়ায় আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে দেশে।

অধিকাংশ ভিডিও গেমের কনটেন্ট যুদ্ধ, সংঘাত রক্তপাত নিয়ে, যা কোমলমতি শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায়। বর্তমানে শুধু শহর এলাকায় নয়, ভিডিও গেমসের দিকে ঝুঁকছে গ্রামের শিশু-কিশোররাও। ইদানীং মফস্বলের শিশু-কিশোররাও একত্রে বসে দলবেঁধে ভিডিও গেম খেলছে। খেলার মাঠ থাকা সত্ত্বেও ভিডিও গেমের দিকে ঝুঁকে পড়া শঙ্কার বৈকি! গ্রামের রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে কিংবা মহল্লার সব জায়গায় একই চিত্র! ঘরে কিংবা বাইরে তাদের আচরণেও যার প্রভাব স্পষ্ট। এতে করে সচেতন সব মহলই উদ্বিগ্ন শিশু-কিশোরদের নিয়ে।

মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের পর্দায় কিশোর-তরুণেরা ‘পাবজি’র মতো ভিডিওতে এতটাই মগ্ন থাকছে যে, বাস্তব পৃথিবী ভুলে তারা এক বিপজ্জনক নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা এবং হাতের নাগালের মধ্যে থাকা ইন্টারনেটের কারণেই এ গেমটির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এসব গেমে আসক্তির কারণে কিশোররা পারিবারিক, সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।

অতিরিক্ত হিংস্রতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে পাবজি গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। গেমটি বন্ধ করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালেও। হিংস্রতার কারণে এ গেমকে নিষিদ্ধ করেছে ইরাক ও জর্ডানের মতো দেশ। টেকনোলজির দেশ চীনেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে গেমটি। যদিও নেপালে পরবর্তীকালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশেও এটি নিষিদ্ধ করার পর আবারও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে হয়তো। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, জার্মানি এবং চীনে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আলাদা চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে এমন পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়তো আমাদেরও দরকার হবে।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গেমিং ডিজঅর্ডারের সঙ্গে অতি উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা এবং তীব্র মানসিক চাপের মতো মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের সঙ্গে গেমিং ডিজঅর্ডার হওয়ার প্রবণতা কখনো বেশি পাওয়া গেছে।
সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া বা সাইবার জগতের অপরাধে জড়িয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে।
ইন্টারনেট বা গেমের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে আচরণ পরিবর্তিত হয়ে যায়, আচরণে আগ্রাসী ভাব দেখা দেবে। অল্পতেই রেগে যাবে। কখনো নিজের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বা অপরকে আঘাত অথবা হত্যা করার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত না হলে, ইন্টারনেট সংযোগ বা ব্যক্তিগত মুঠোফোন নয়। সে নিজেকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, তা আগে বিবেচনা করতে হবে।
গ্যাজেট আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিন। সন্তানের সঙ্গে চুক্তিতে আসুন, যাতে নিয়মগুলো পালন করে। সময় মেনে চলতে উৎসাহিত করুন।
বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে রাখুন। শিশু যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে, সেদিকে গুরুত্ব দিন।
নিরাপত্তামূলক অনেক সফটওয়্যার আছে। সেগুলো ব্যবহার করুন, যাতে আপনার বাসার সংযোগ থেকে কোনো নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা না যায়। এ বিষয়ে আপনার ইন্টারনেট সংযোগদাতা বা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
সন্তান প্রযুক্তিতে অতি দক্ষ এই ভেবে আত্মতৃপ্তি পাবেন না। তার বয়সটি প্রযুক্তির উপযোগী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।
শিশুকে গুণগত সময় দিন। মা-বাবা নিজেরাও যদি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। পরিবারের সবাই মিলে বাসায় ক্যারম, লুডু, দাবা, মনোপলি ইত্যাদি খেলার চর্চা করুন। নিয়ম করে সবাই মিলে বেড়াতে যান। মাঠের খেলার প্রতি উৎসাহ দিন।
ইন্টারনেট বা গেম আসক্তি কিন্তু মাদকাসক্তির মতোই একটি সমস্যা। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই আসক্তি দূর করুন।

অনলাইন গেমের আসক্তি বাড়ায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার মানসিকতা কমে যাচ্ছে; পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চাও হচ্ছে না তাদের। ইলেকট্রনিক ডিভাইসঘটিত অনলাইন গেমের এ আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল মাদক’! আর ভিডিও গেমে আসক্তির জন্য সৃষ্ট মানসিক সমস্যাকে বলা হচ্ছে গেমিং ডিজঅর্ডার। কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে দ্রুত নজর দিতে হবে। তা না হলে হুমকির মুখে পড়বে শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশ; সংকটে পড়বে নতুন প্রজন্ম। সরকারের উচিত, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। অভিভাবকদের দরকার বাড়তি সচেতনতা। সামাজিকভাবে একটা আন্দোলন হোক, সমাজের সব সচেতন মানুষ এতে ভূমিকা রাখুক, শিশু-কিশোররা ভিডিও গেমসের আসক্তি থেকে বের হয়ে খেলার মাঠে ফিরুক কিংবা নানা রকম বইয়ের জগতে নিজেদের আবিষ্কার করুক-এটাই হোক আমাদের চাওয়া।

জাকারিয়া জাকির, নির্বাহী সম্পাদক ‘জনতার খবর’