প্রসঙ্গ ‘কিশোর গ্যাং’ -জাকারিয়া জাকির

মতামত, 24 January 2022, 501 বার পড়া হয়েছে,
নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। একে অপরের ক্ষমতা দেখাতে কয়েকজন মিলে পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন নামে গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মাদক ও প্রেম নিয়ে বিরোধের জেরে তারা অহরহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থের বিনিময়ে অর্থদাতার প্রতিপক্ষের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে উঠতি বয়সী ছেলেরা। এমনকি কিছু অর্থের বিনিময়ে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।

আমাদের সমাজে নতুন সংকটের নাম কিশোর! বিস্ময়কর হলেও সত্যি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট হেলথ’ একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, কৈশোর এখন শুরু হয় ১০ বছর বয়সে।

যে কৈশোর দশ বছর থেকে শুরু হয়, সেই বয়স এখন আমাদের কাছে আতঙ্ক! পত্রিকার পাতা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গলির মোড় থেকে চায়ের দোকান, গণপরিবহন থেকে টকশো সব জায়গায় ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িতদের বয়স হচ্ছে ১০-১৭ বছর। আমি বেশ কয়েকমাস ধরে এই বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছি। বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন কিশোরের সঙ্গে কথাও বলেছি। যারা একসময় দুরন্ত কৈশোর পার করে এখন তরুণ তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। কিশোরদের সমস্যাটা আসলে কী? হঠাৎ করে ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে মাতামাতি করার কী আছে? এই সমস্যাটা কি হঠাৎই এসেছে?

আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরের কথা। যে আদনান ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’-এর সংঘাতের বলি হয়েছিল। একজন মা’ই বোঝেন তার সন্তান হারানোর দুঃখ। একজন বাবা বোঝেন তার মানিক হারানোর কষ্ট। সেই কষ্ট, সেই দুঃখ যে কতটা তীব্র তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আমরা এইভাবে কোনও মায়ের বুক খালি দেখতে চাই না।

এই ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামের কিশোর গ্যাংয়ের কাজ কী ছিল? তারা মূলত পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে জড়িত ছিল। একটু ভালো করে লক্ষ করুন, এই তিন ধরনের কাজ করার সময় কি কোনও অভিভাবকের কাছে তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য যায়নি? এই দুটি গ্রুপের অভিভাবকরা কি একবারও তাদের সন্তানদের জিজ্ঞেস করেননি, তারা সারাদিন কী করছে? কোথায় ছিল? কে কে তাদের বন্ধু? হয়তো নেননি। আর নেননি বলেই নিছক একটি কথার জের ধরে তারা আরেকজন কিশোরকে খুন করছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, আপনার সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সন্তানকে সময় দেওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মায়ের অবস্থান তুলে ধরা। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন খুবই জরুরি। এই বন্ধন যত হালকা হবে, সন্তান তত বাইরের দিকে ছুটবে, বাইরের কলুষিত বিষবাষ্প গ্রহণ করবে। তখন আর তাকে ফেরানোর কোনও রাস্তা থাকবে না।

আমরা নিশ্চয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের ইতিহাস জানি। তারপরও আরেকবার গল্পটা শুনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডের তরুণ এবং তাদের গ্যাংগুলো মারামারি আর ছুরি নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় প্রায়ই তারা ঝগড়া করতো, মারামারি করতো। এতে করে সাধারণ পথচারীরা তাদের যন্ত্রণায় অতীষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ বুদ্ধি করে একটা পরিকল্পনা করলেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় তারা বস্তিবাসী যুবকদের জন্য খেলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিলেন। তরুণ যুবকরা ধীরে ধীরে খেলা ও বিনোদনের জায়গাগুলোয় আসতে শুরু করলো। এতে করে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি বাদ দিয়ে খেলাতে বেশি সময় দেওয়া শুরু করলো। ঝগড়া, মারামারি, ছুরি সন্ত্রাসের জায়গা দখল করে নিলো ফুটবল। সেই সময় ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি নামের দুটি ক্লাব। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবলের অন্যতম শক্তিশালী দুটি ক্লাব। যে ক্লাবে অসংখ্য নামিদামি ফুটবলার তৈরি হয়।

এবার ফিরে আসি সেই কথোপকথনে। সেই কিশোররা কথাপকথনের এক পর্যায়ে আমাকে প্রশ্ন করে, আপনারা আমাদের জন্য কী করেছেন? সব পত্রপত্রিকায় খালি একই ধরনের শিরোনাম। ‘কিশোর গ্যাং বাড়ছে’, ‘মাদকে আচ্ছন্ন কিশোর গ্যাং’, ‘গ্যাং কালচারে নষ্ট হচ্ছে সমাজ’, ‘ঢাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়’ ইত্যাদি। কেন এইসব কিশোর গ্যাং বাড়ছে, তা কি আপনারা খুঁজে বের করেছেন? জনসংখ্যার হিসাবে যেখানে ঢাকায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠ থাকার কথা ছিল, সেখানে দুই সিটি করপোরেশনে আছে মাত্র ২৩৫টি খেলার মাঠ, অর্থাৎ মাঠের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ১০০। তাহলে ছেলেমেয়েরা যাবে কোথায়? খেলার মাঠ নেই, পাঠাগার নেই, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই কোথাও। শুধু পড়াশোনার কথা বলে কিশোরদের আটকে রাখতে পারবেন? যেসব স্কুলে আমরা পড়াশোনা করি, সেসব স্কুলের বেশিরভাগেরই কোনও মাঠ নেই। তাহলে আমরা কোথায় খেলবো?

একটি বাচ্চা অসৎ পথে যাওয়ার পেছনে তার অভিভাবকের দায় অবশ্যই আছে, এটি আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করি না। কিন্তু সে বাচ্চা যে মাঠে খেলতে পারছে না, পাঠাগারে যেতে পারছে না, কোথাও তার আড্ডার জায়গা নেই, তা কেউ বলছে? বলছে না। একজন কিশোর পড়াশোনার বাইরে বাকি সময়টা কী করবে? স্কুলে যা আছে, তা হলো প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে কত ভালো করছে, কে কার চেয়ে কত ভালো করবে এই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মানসিকতায় আমরা ক্লান্ত।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, এসব কিশোর আসলেই ভালো কিছু করতে চাইছে, ভালো কিছু জানতে চাইছে, ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে চাইছে কিন্তু তাদের করার সুযোগটা কোথায়? বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটিতে মাঠ আছে ২৩৫টি। কিন্তু এই মাঠগুলোর মধ্যে মাত্র ৪২টি মাঠে আছে সাধারণের প্রবেশ অধিকার। প্রতিষ্ঠানের অধিকারে মাঠ দখলে আছে ১৪১টি আর কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, যা ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কলোনির মানুষদের জন্য সংরক্ষিত। এর বাইরে ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি, যেখানে সুযোগ আছে খেলাধুলা করার। আর ১৬টি মাঠ দখল করে আছে কোনও না কোন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান।

এই যদি হয় শুধু একটি সিটি করপোরেশনের অবস্থা, তাহলে বাকিগুলোর কী অবস্থা? শুধু মাঠ নয়, পাঠাগারের অবস্থা আরও করুণ। একসময় ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৩টি পাঠাগার ছিল। বর্তমানে তা কমতে কমতে সাতটিতে এসে ঠেকেছে। এই সাতটিও নিয়মিত খোলা হয় না। নতুন বই কেনা হয় না বহুদিন।

শুধু ঢাকা সিটির পাঠাগারের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকি সিটি করপোরেশনের পাঠাগারগুলোর কী অবস্থা? যে প্রশ্ন নিয়ে আমি কিশোরদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেম সেই প্রশ্নের উত্তর তো আমি নিজেই পেয়ে যাচ্ছি। একজন কিশোর যদি কোথাও তার অবসর ফলপ্রসূভাবে কাটাতে না পারে, সে তো মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক গ্রুপ বা গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত হবে, এইটাই স্বাভাবিক।

আমরা সবাই বলছি ‘কিশোর গ্যাং’র অপরাধের কথা। তাদের বখে যাওয়ার কথা। কিন্তু কেন একজন কিশোর বখে যাচ্ছে, এটি আমরা ক’জন ভাবছি? সেই কিশোররা যদি এইভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিতো, তবে আমরাই কী ভাবতাম?

কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আরেকটি কারণ হলো, সমাজের অন্য সব অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া। আমরা বারে বারে বলছি মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। কিন্তু কেন কমেছে? মানবিক মূল্যবোধ হঠাৎ করে কমে গেছে বিষয়টা তাও নয়। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পেছনে অনেক ছোট ছোট ঘটনা দীর্ঘসময় ধরে ঘটতে থাকে। একদিনে কিশোর অপরাধ বড় আকার ধারণ করেনি। যে সমাজে ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না, ইভটিভিং-এর শাস্তি হয় না, মাদক সম্রাট দেশদরদি আখ্যা পায় সেই সমাজে অপরাধ বাড়বেই এইটা স্বাভাবিক। এটি আমার কথা নয়। এটি নিউটনের তৃতীয় সূত্র—‘প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ সেই সূত্র অনুযায়ী কিশোররা এসব দেখছে, জানছে। তারাও ভাবছে, এখানে অপরাধ করলে শাস্তি হয় না। এটা ভেবে তারাও অপরাধে জেনে অথবা না জেনে জড়িয়ে পড়ছে।

আরেকটি বিষয় সবচেয়ে শঙ্কার, তা হলো কিশোরদের সংশোধনাগার। যেসব কিশোরের সংশোধনাগারে নেওয়া হচ্ছে, তাদের জন্য কি সঠিক ব্যবস্থাপনা আছে? বিষয়টা যেন এমন না হয়, একজন কিশোর সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে এসে আরও খারাপ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই বিষয় নিয়ে আমাদের সবারই ভাবতে হবে।

যে কথাটা আমি আগেই বলেছিলাম যেকোনও অপরাধ একদিনে সংঘটিত হয়নি। সেই অপরাধের পেছনে অনেক বড়সময়েয় কোনও ছোট ছোট ঘটনা রয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি, কিশোর অপরাধ কমিয়ে নির্মূল করা সম্ভব। কিশোর গ্যাং থেকে ফিরিয়ে এনে কিশোরদের শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এরজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের সদিচ্ছারও প্রয়োজন। ঘর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ সব জায়গায় কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে গান-নাচ-বাদ্যযন্ত্র শেখানো, আবৃত্তি, গল্প শোনা, গল্প বলা, গল্প বানানো, শব্দের খেলা, ছবি জোড়া দেওয়া, শারীরিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। প্রতিযোগিতা নয়, তারা কতটা সৃজনশীলভাবে তা শিখতে পেরেছে তা দেখা প্রয়োজন।

শিশু-কিশোরদের মোবাইল হাতে না দিয়ে বই পড়ায় উৎসাহী করে তুলতে হবে। তাদের নিয়েই মঞ্চনাটক, পথনাটকসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।

যদি একটি শিশু, শিশু বয়স থেকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, খেলাধূলা, থিয়েটার, সংগীত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকে, যদি তার মনস্তাত্ত্বিক জায়গা বুঝে তাকে গড়ে তোলা হয়, তবে তার কৈশোর ভালো কাটবে, আর কৈশোর ভালো কাটলে তার তারুণ্য হবে সবচেয়ে ফলপ্রসূ। এভাবে সুদীর্ঘ পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে কিশোরদের আলাদা করে গড়ে তুলতে হবে, তবেই কিশোর অপরাধ কমে যাবে। না হয় উত্তপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে যেখানে, সেখানে আর আমাদের কিশোরদের শক্তি হারিয়ে যাবে অতলে।

আমাদের দেশে শিশুদের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায়, এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।

জাকারিয়া জাকির, নির্বাহী সম্পাদক ‘জনতার খবর’