স্মৃতি হিরন্ময়

সোসাল মিডিয়া, 20 December 2021, 777 বার পড়া হয়েছে,

আমরা স্মৃতিযারা অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র, তাদের কাছে যে কয়জন শিক্ষক মগজে মননে গভীরতম আবেগের কাদামাটির সাথে মনের নিজস্ব আলোকিত বারান্দায় দাগ কেটে আছেন- তাদের স্বীয় আলোয়, কিংবা হিরন্ময় স্মৃতি সরোবরের গভীর জল থেকে যে মুখগুলো ভেসে ভেসে উঠে হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠা গাংশুশুকের মতো, তাদের মধ্যে ইসমাইল স্যার আমার অন্যতম প্রিয় স্যার। তাঁকে আমি লালন করি- আমার যাপিত জীবন চর্চায়।

অন্নদা স্কুল নিয়ে কিছু লিখতে গেলে তাকে বাদ দিয়ে আমি কিছু লিখতে পারি না। কারণ তিনি শুধু আমাকেই নয়- আমার মতো আরো অনেককেই তিনি পুত্রস্নেহের চোখে দেখতেন।

এই স্যারকে নিয়ে আমার জীবনের অন্যতম একটা হিরন্ময় স্মৃতি আজকে শেয়ার করবো। একবার রোজার মাস ছিলো। এবং তখন বৃষ্টির দিন। তিনি আমাকে বললেন, মাতিন আমি তোদের বাড়িতে কচি মুরগীর ঝোল দিয়ে চিটা পিঠা খাবো। আমি এই কথা শোনে বেশ অবাক হলাম। অবাক হলাম এজন্য যে, আজই আমি বুঝতে পারলাম স্যার আমাকে কতোটা ভালোবাসেন। এবং তিনি একজন সহজ সরল মানুষ এটাও আবার আমার কাছে আজ শতভাগ প্রমাণিত হলো।

যথারীতি আমি বাসায় আম্মাকে বলে সেই সময় ইসমাইল স্যার, আবেদ হোসাইন স্যার, হেলাল স্যার, কাদের স্যার, আবুবকর স্যারদেরকেও আমি নিমন্ত্রণ করলাম সাথে সালাম ভাই ও শাহিন ভাইকেও রাখলাম। তারাও রাজি হলেন এক সাথে ইফতার করার জন্য। দিনক্ষণ মতো স্যারদেরকে আমি যেদিন দাওয়াত দিলাম – তার দুদিন আগে থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। অনুষ্ঠানের দিন বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই নেই। দুপুরের পর বৃষ্টি আরো বেড়েছে। আমি আসর নামাজের আগেই বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই আমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্যারদেরকে নিয়ে আসার জন্য। এক এক করে স্যারদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতে লাগলাম। দুর্ভাগ্যবশত ইসমাইল স্যার অনুষ্ঠানের আগের তিনদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তিনি অনেকটাই শয্যাশায়ী। স্যার আমাকে দেখার পর বললেন- আমি যাবো। কিন্তু ঘর থেকে তিনি একা বের হতে পারছেন না। বাসার সবাই তাকে নিষেধ করছেন। অথচ তিনি নাছোরবান্ধা। তিনি আমার সাথেই আসবেন। আমি স্যারকে কাঁধে করে বাসা থেকে বের করে গাড়িতে নিয়ে তুললাম। তখোন বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। দুর থেকে ভেসে আসছে বজ্রের শব্দ। ইফতারের পূর্বে হওয়ায় একটা অলৌকিক নীরবতা আচ্ছন্ন করলো চারিদিক।

জেল রোডের আমাদের বাড়ির সামনে আসার পর দেখা গেলো যে, অনবরত বৃষ্টির কারণে বাসার সামনে হাঁটুপানি। স্যারের শরীর খুবই দুর্বল। আবার রোজা রেখেছেন। যারফলে তিনি খুবই দুর্বল ছিলেন। তিনি হেঁটেও যেতে পারছেন না। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাতিন ইফতারের সময় আর কতক্ষণ বাকি? জবাবে আমি বললাম, স্যার অনেক সময় আছে। স্যার বললেন, আমারে তাড়াতাড়ি তোমাদের বাসার ভিতরে নাও। আমি স্যারের সারল্যভরা মুখখানির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, জি¦ স্যার, ব্যবস্থা করছি।

আমি মুহূর্তেই আমার প্ল্যান পরিবর্তন করে ফেললাম। তারপর পাশের একটা ক্লিনিক থেকে একটা রোগী বহনকারী ট্রেচার বের করলাম। দুজনের সহযোগীতায় ওই ট্রেচারে শুইয়ে স্যারকে বাসায় নিয়ে গেলাম।

স্যার সবসময়ই হাতে ঘড়ি পরতেন। ঘড়ি দেখে সবাইকে ডেকে বললেন, এই সবাই মোনাজাত ধরেন। বলেই স্যার মোনাজাত করলেন। এক সময় মসজিদের মাইক থেকে ভেসে এলো আজানের সুমধুর সুর। নানাপদের ইফতারের স্বাদ নিতে নিতে আমি স্যারের শুভ্র পাজামা পাঞ্জাবি আর সাদা দাড়িসমেত নুরাণি চেহারাখানির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো তার সমস্ত শরীর হাসছে। অলৌকিক আলোর বন্যায় ভাসছে আমাদের ঘরখানা।

চলে যাবার সময় স্যারদের প্রত্যেককেই আমি আমার খুবই প্রিয় বাঁধাই করা একটি করে আরবি ক্যালিওগ্রাফি স্মারক উপহার দিলাম। স্যারদের মুখের সম্মিলিত সেই হাসিটি আমি আজো ভুলতে পারিনি। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর দোয়ায় আমি জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের দরজার চাবি হাতে পেলাম- তাঁদের সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। জীবিতদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

ড. মোঃ মাতিন আহমেদ।
সমন্বয়ক অন্নদা’ ৯৩ ব্যাচ।