আর এ রাস্তার সাথে ছায়ার মত এঁকেবেঁকে বয়ে যেত সম্প্রীতির সেতুবন্ধন যৌবনা অদের খাল। অদের খাল প্রাকৃতিক কোন খাল নয়। বৃটিশ আমলে এটিকে খনন করে এর নাব্যতা বৃদ্ধি করা হয়। এই খাল সৃষ্টির ইতিহাস আরো প্রাচীন। রাজমালা থেকে জানা যায়, সুরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট শেরশাহ(১৪৮৬ – ২২ মে, ১৫৪৫) সুবর্ণগ্রাম হতে পাঞ্জাব পর্যন্ত এক প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। শেরশাহ ছিলেন একজন মেধাবী রণকৌশলবিদ, দক্ষ প্রশাসক ও যোগ্য সেনানায়ক। তার নির্মিত রাস্তাটি একসময় রাজপথ বা রাজার রাস্তা নামেই পরিচিত ছিল। ১৫৪৫ সালে চান্দেল রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কালিঞ্জর দুর্গে বারুদের বিস্ফোরণে শের শাহ সুরির মৃত্যু হয়।[১] গোলাবারুদের আগুনে শেরশাহ পুড়ে যাওয়ার পর লোকমুখে এ রাস্তার নাম হয় পোড়া রাজার পথ/ পোড়া রাজার জাঙ্গাল। কেউ কেউ মনে করেন নিম্নভূমি থেকে উঁচু ও প্রশস্ত জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তাটিকে বৃটিশরা ইংরেজীতে জাঙ্গল(Jungle) বলত। সেই থেকে রাস্তাটির নাম পোড়া রাজার জাঙ্গাল। জাঙ্গাল শব্দের অর্থ পরিত্যক্ত। কালের প্রবাহে মুসলিম শাসনামলেই হয়তো এ রাস্তা ব্যবহার অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। একারণেও এর নাম পোড়া রাজার জাঙ্গাল হতে পারে। অভিধানে জাঙ্গাল শব্দের অর্থ -উচ্চ বাঁধ, অলি বা পথ। সংস্কৃতে জাঙ্গালকে জঙ্গাল বলা হয়, যার অর্থও বাঁধ। এই রাস্তা নির্মাণের সময় মাটি তোলার কারণে যে খাল /হ্রদ /খাদ সৃষ্টি হয় তারই নাম অদের খাল।
অন্য এক জনশ্রুতি মতে, ত্রিপুরার এক মহারাজা মাতৃস্তন্যের ঋণ শোধ করার জন্য মায়ের আদেশে একরাতের মধ্যে এই অদ খনন করেছিলেন। একই সঙ্গে অদের মাটি দিয়ে এই রাস্তাটিও নির্মাণ করেছিলেন। [২]
১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মাত্র পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন রাজত্বে তিনিই সর্বপ্রথমত ‘রুপিয়া নামক মুদ্রার প্রচলন করেন’ ‘ডাক ব্যবস্থা চালু করেন’ ‘পাট্টা’ (ভূমি স্বত্বের দলিল) ও ‘কবুলিয়াত’ (চুক্তি দলিল) প্রথা চালু করে জমির উপর প্রজার (রায়তের) মালিকানা সুনিশ্চিত করেন এবং কৃষিকার্যে উৎসাহ দানের জন্য কৃষকদের ঋণ দানের ব্যবস্থা করেন।[৩][৪] “গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড- মহাসড়ক (সড়ক-এ-আজম) শের শাহ সুরির অমর কীর্তি। বিগত চার শতাব্দী ধরে এই সড়ক “বিশ্বে অদ্বিতীয় এক জীবননদীর মতো” দাঁড়িয়ে রয়েছে।” [৫] তিন হাজার মাইল দীর্ঘ এই মহাসড়ক সোনারগাঁও থেকে আগ্রা, দিল্লি ও লাহোর হয়ে মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এর দুপাশে ছিল ছায়াদানকারী বৃক্ষশ্রেণি। উপনিবেশিক আমলে এই সড়ক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিতি লাভ করে। আজও ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই সড়ক অন্যতম প্রধান রাস্তা। এর ভারতীয় অংশটি বর্তমানে স্বর্ণ চতুর্ভূজ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পোড়া রাজার জাঙ্গাল এই রাস্তাটিও এক সময় গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সাথে সংযুক্ত ছিল বলে জানা যায়।
কৈলাস চন্দ্র সিংহের রাজমালা গ্রন্থে উল্লেখ আছে “প্রবল বিক্রম সম্রাট শেরশাহের শাসনামলে ত্রিপুরার অন্তর্গত অনেকগুলো পরগণা তাহার শাসনদন্ডের অধীনে ছিলো। শেরশাহ সুবর্ণগ্রাম হইতে পাঞ্জাব পর্যন্ত এক প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। মেঘনার পূর্বতীর হইতে বলদাখাল(বর্তমানে বরদাখাত পরগণা) ও নূর নগর পরগণার মধ্য দিয়া ত্রিপুরা পর্বতের পাদমূল পর্যন্ত যে রাজপথ নির্মিত হয়েছিল তাহার ভগ্নাবশেষ অদ্যাপি বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে।সর্বসাধারণে অদ্যাপি সেই রাজপথকে পুরা রাজার জাঙ্গাল বলিয়া থাকে।” [৬]
‘মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহ কসবার নিকটে কৈলার গড় নামক একটি দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ এর মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যে চারটি অভিযান চালিয়েছিলেন।ত্রিপুরার রাজা ধন্যমানিক্যের সঙ্গে তার কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। প্রথম দিকে কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও তিনি ত্রিপুরার একাংশ নিজ রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হন।[৬][৭] চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে বাংলা, ত্রিপুরা ও আরাকানের শাসকদের মধ্যে সংঘটিত ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধে ১৫১৬ সালের দিকে হোসেন শাহ চট্টগ্রাম দখল করতেও সক্ষম হন। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম হোসেনশাহী রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। অভিযানে সুবিধার জন্য হোসেন শাহ এই রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন কীনা তাও আজ গবেষণার দাবী রাখে।'[৭]
➤তথ্য ঋণ:
১। Catherine B. Asher (১৯৭৭)। “The mausoleum of Sher Shah Suri”। Artibus Asiae। Artibus Asiae Publishers। 39 (3/4): 273–298। ডিওআই:10.2307/3250169।
২। সম্প্রীতির সেতুবন্ধন কসবার অদের খাল/ আওয়ার কণ্ঠ
৩।Mughal Coinage ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ অক্টোবর ২০০২ তারিখে Reserve Bank of India RBI Monetary Museum,
৪।Rupee Public Domain এই নিবন্ধটি একটি প্রকাশন থেকে অন্তর্ভুক্ত পাঠ্য যা বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনে: চিসাম, হিউ, সম্পাদক (১৯১১)। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।
৫। A description of the road by Kipling, found both in his letters and in the novel “Kim”. He writes: “Look! Brahmins and chumars, bankers and tinkers, barbers and bunnias, pilgrims -and potters – all the world going and coming. It is to me as a river from which I am withdrawn like a log after a flood. And truly the Grand Trunk Road is a wonderful spectacle. It runs straight, bearing without crowding India’s traffic for fifteen hundred miles – such a river of life as nowhere else exists in the world.”
৬। রাজমালা -কৈলাস চন্দ্র সিংহ(পারুল সংস্করণ) প্রকাশকাল – ২০০৯ – কলকাতা।
৭। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ইতিকথা- এস এম শাহনূর
৮। সোনারগাঁ বিবরণী।। খাওয়াস খান
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক