টাকার অভাবে জ্বরে আক্রান্ত দুই শিশু সন্তানকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি তারা। বাড়ির পাশের একটি ফার্মেসি থেকে ৩০ টাকা দিয়ে নাপা সিরাপ এনে খাওয়ান। সেই সিরাপ খাওয়ানোর পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে শিশু ইয়াছিন ও মোরসালিন। পরে তাদের দুজনেরই মৃত্যু হয়।
দুই শিশুর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিনেও জ্বর না কমায় গত ১০ মার্চ বিকালে ছোট ছেলে মোরসালিন তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে মা লিমা বেগমকে। তখন মা তাকে আশ্বাস দেয়, চাল কল থেকে কাজের টাকা পাওয়ার পর ভালো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবে। পরে মায়ের কাছ থেকে ৩০ টাকা নিয়ে দুই শিশুর দাদি লিলুফা বেগম পাশের সড়ক বাজারের মা ফার্মেসি থেকে এক বোতল নাপা সিরাপ কিনে আনেন। এরপর সেই সিরাপ আধা চামচ করে ইয়াছিন ও মোরসালিনকে খাওয়ানো হয়। এর কিছুক্ষণ পরই শিশুদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে।
কাঁদতে কাঁদতে দুই শিশুর মা লিমা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ওই দিন আমার ছেলে বলল, ‘আম্মা আমাকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিবা না?’ আমি তখন বলেছি, ভালো ডাক্তারের কাছে এখন নিতে পারব না, আমার কাছে এখন টাকা নেই। আপাতত দুই ভাইকে একটা নাপা সিরাপ এনে খাওয়াই। সিরাপ খাওয়ানোর ১৫-২০ মিনিট পরই দুজনের মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে ডাক্তাররা অক্সিজেন দিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।
লিমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার জানান- আপনার ছেলেরা সম্পূর্ণ সুস্থ। বাড়িতে নিয়ে টক আর পানি খাওয়ান বেশি করে। কিন্তু বাড়িতে আনার পথেই আমার এক ছেলে মারা যায়। বাড়িতে এসে আরেকজনের মৃত্যু হয়।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডাক্তাররা তাহলে কী দেখল? আমার ছেলেগুলোকে একটু চিকিৎসাও তারা দিল না কেন?
এদিকে নাপা সিরাপ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠার পর থেকে সপরিবারে গা-ঢাকা দিয়েছেন দুর্গাপুর গ্রামের সড়ক বাজারের মা ফার্মেসির মালিক মো. মঈন উদ্দিন।
রোববার দুপুরে দুর্গাপুরের পার্শ্ববর্তী তাজপুর গ্রামে মঈন উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।
ফার্মেসি পরিচালনার জন্য ওষুধ প্রশাসন থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়ার পাশাপাশি ন্যূনতম সি-গ্রেডের ফার্মাসিস্ট কোর্স করা একজন ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন হয়। তবে মা ফার্মেসিতে এগুলো ছিল কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হোসাইন মো. ইমরান বলেন, আশুগঞ্জ উপজেলায় ‘মা ফার্মেসি’নামে ১৭টি লাইসেন্স আছে। এখন এর মধ্যে দুর্গাপুরের মা ফার্মেসির লাইসেন্স আছে কিনা সেটি স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কারণ মালিককে আমরা পাইনি। সেজন্য তার কাগজপত্র আছে কিনা সেটি যাচাই করতে পারছি না। এছাড়া কোনো ফার্মাসিস্ট ছিল কিনা সেটিও জানা যাচ্ছে না। তার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত তার ফার্মেসির বৈধতা সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
বর্তমানে দুর্গাপুর গ্রামের সড়ক বাজারে ৯টি ফার্মেসি আছে। এর মধ্যে কেবল ৩টি ফার্মেসি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ওষুধের অর্ডার দেন। বাকিরা কিশোরগঞ্জের ভৈরব এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকারি ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কেনেন বলে জানা গেছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের আশুগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র মেডিকেল প্রমোশন এক্সিকিউটিভ মোজাম্মেল হক বলেন, সব ফার্মেসির সঙ্গে আমাদের ব্যবসা নেই। আলোচিত এই মা ফার্মেসিও আমাদের কাছ থেকে ওষুধ নেয় না। আমাদের কাছ থেকে মাত্র ৩টি ফার্মেসি ওষুধ নেয়।
এদিকে আশুগঞ্জ উপজেলা ওষুধ খেয়ে দুই শিশুর মারা যাওয়ার আলোচিত ঘটনায় রোববার দুপুরে ঔষধ প্রশাসনের তদন্ত টিম উপজেলার দুর্গাপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে মোরসালিন এবং ইয়াসিনের মা, বাবা, দাদি এবং চাচার সাক্ষ্য নেন।
পরবর্তীতে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. আকিব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, যে সিরাপটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। একই ওষুধের অন্যান্য ব্যাচের ওষুধ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, শিশুদের স্বজনরা জানিয়েছেন- ওষুধ খাওয়ানোর পরই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ওষুধটিতে কী এমন উপাদান ছিল- যেটি খাওয়ার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে রিঅ্যাকশন করল- এটি আসলে রহস্যজনক বিষয়। এ রহস্য উদঘাটন করতে হয়তো সময় লাগবে।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি রোববার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল এবং আশুগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামে আসেন রাত ৮টায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটিতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহিউদ্দিনকে প্রধান করে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন- কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মীর মোবারক হোসাইন ও ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. রফিক-উস-ছালেহীন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটির প্রধান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহিউদ্দিন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হননি।