রিকশাচালক থেকে ড্যান্স ক্লাবের মালিক বনে যাওয়া কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল বিভিন্ন সময় শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করেছেন। ড্যান্স ক্লাবে নাচ-গান শেখানোর কথা বলে তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল করে প্রথমে তিনি তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন। এরপর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ভারতে পাচার করতেন। পাচার হতে যাওয়া ২৩ নারীকে সম্প্রতি র্যাব উদ্ধার করায় পাচার চক্রের হোতা কামরুল সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। কামরুলসহ চক্রটির ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। শনিবার সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
র্যাব জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও ও চুয়াডাঙ্গা থেকে পাচার হতে যাওয়া ২৩ নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ভারতে নারী পাচার চক্রের মূল হোতা কামরুল ইসলাম, রিপন মোল্লা, আসাদুজ্জামান সেলিম, নাইমুর রহমান, মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচার চক্রের সদস্য নূরনবী ভূঁইয়া রানা, আবুল বাশার, আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহিদ শিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও টোকনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানের সময় ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল ফোনসেট, বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার এবং দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন আরও বলেন, ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা কামরুলের ১৫-২০ জন সহযোগী রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি নারী পাচারে জড়িত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কম বয়সি মেয়েদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ও প্রলোভন দেখিয়ে চক্রটি ভারতে পাচার করে। নাচ শেখানোর নামে প্রথমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসত চক্রটি। এরপর তাদের বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত করত। পরবর্তী সময় বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পাশের দেশে পাচার করত। এভাবে চক্রটি তিন বছরে শতাধিক নারীকে পাশের দেশ ভারতে পাচার করেছে। তিনি আরও বলেন, ভারতের মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আকৃষ্ট করা হতো। মূলত পাশের দেশে অমানবিক ও অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হতো। চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।
সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পাচার হয়ে থাকে জানিয়ে র্যাবের মুখপাত্র মঈন জানান, এ চক্রের সঙ্গে ভারতের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। ওই দেশের সিন্ডিকেট সদস্যরা পাচার হওয়া নারীদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। এরপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহর-প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের বিক্রি করে দেয়। এরপর থেকে তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না।
র্যাব সূত্র জানায়, ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকার বাড্ডায় এসে রিকশাচালক হিসাবে জীবিকা শুরু করেন কামরুল। কিছু দিন পর একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যানচালক হিসাবে তিনি কাজ নেন। এরপর ড্যান্স গ্রুপের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন। ২০১৬ সালে এফডিসি ও বিভিন্ন শুটিং স্পটে তিনি আসা-যাওয়া শুরু করেন। এরপর তিনি হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ ছাড়া একজন মহীয়সী ‘মা’ জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে মেয়েকে পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন। এসব ঘটনা ভাইরাল হয়।
র্যাব জানায়, কামরুলের মাধ্যমে এক নারী ভারতে পাচারের ঘটনায় তার বোন বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পুলিশ কামরুলকে আটক করে। তিন মাস পর কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি পুনরায় নারী পাচারে জড়িয়ে পড়েন। সীমান্তবর্তী জেলার সেফ হাউজে প্রথমে নারীদের জড়ো করা হতো। এরপর সুবিধাজনক সময় পাচার চক্রের সদস্যরা নারীদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পাচার করত। এ চক্রের গ্রেফতার সদস্য রিপন, সেলিম ও শামীম অবৈধ কাজে মূল হোতা কামরুলকে সহায়তা করত বলে স্বীকার করেছে।
র্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, চক্রটি মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচার চক্রের সঙ্গেও জড়িত। গ্রেফতার কয়েকজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচার চক্রের ১০-১২ সদস্য এখনো দেশে সক্রিয় রয়েছে। ৫-৭ বছর ধরে চক্রটি সক্রিয়ভাবে নারী ও পুরুষ পাচার করে আসছিল। হাউজ কিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী কর্মীদের বিনা খরচে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে চক্রটি উঠতি বয়সি তরুণী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের প্রলুব্ধ করত। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হতো। এ পর্যন্ত চক্রটি ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা নূরনবী ভূঁইয়া রানা। তার সঙ্গে ড্যান্স কামরুলের সম্পর্ক রয়েছে।
১৯৯৬ সালে লক্ষ্মীপুরের একটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে নূরনবী ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নেন। এরপর ১৯৯৮ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে তিনি প্রবাসী শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। ওমানে থাকাকালে মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং মানব পাচারে তিনি জড়িয়ে পড়েন। ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে নূরনবী মানব পাচারের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন।