ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বৃদ্ধা মাকে তালাবদ্ধের খবর সঠিক নয় সেনাবাহিনীকে ভুল তথ্য দিয়েছিল প্রতারক দলিল লেখক ছেলে 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, 25 August 2024, 22 বার পড়া হয়েছে,
মোঃ নিয়ামুল ইসলাম আকঞ্জি,ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা মাকে তার আট জন ছেলে সন্তান মিলে তিনমাস ঘরে আটকে রাখার যে খবরটি ভাইরাল হয়েছিল– সেটি সঠিক নয়। মানসিক বিকারগ্রস্ত ওই বৃদ্ধাকে ফুঁসলিয়ে তার এক ছেলে সকল ভাইদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে এ মিথ্যা নাটক সাজিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুধু নাটক সাজানোই নয়, মাকে আটকে রাখার মতো লোমহর্ষক মিথ্যা তথ্য সেনাবাহিনীকে দিয়ে সে তার বাকি আটজন ভাইকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করে। পরে আসল ঘটনা জানতে পেরে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভিকটিমদেরকে থানায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে সেনাবাহিনী।
মিথ্যা নাটক সাজানোর কারিগর মুখলেছেুর রহমান পেশায় একজন দলিল লেখক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার গোকর্ণঘাট গ্রামের বাসিন্দা মুখলেছ তার এলাকার লোকজনের কাছে একজন ’প্রতারক’ হিসেবেও চিহ্নিত। অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করতে জাল দলিল তৈরির বহু অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সাম্প্রতিক সময়ে নিজের অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে ব্যবহার করে ভাইদের সম্পত্তি নিজের আয়ত্বে নিতে এ ন্যাক্কারজনক কান্ড ঘটায় মুখলেছ। পরে বাকি আট ভাই মিলে সেনাবাহিনীর কাছে মুখলেছ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়। এছাড়া গোকর্ণ ঘাট বাজারে স্থানীয়রা মুখলেছকে উত্তম-মাধ্যম দেয়।
এদিকে অভিযোগের সূত্র ধরে মুখলেছের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারুক আহমেদকে দায়িত্ব দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু অভিযুক্ত মুখলেছ কাউন্সিলরের ডাকে সাড়া না দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গোকর্ণঘাট গ্রামের বাসিন্দা কাঠ ব্যবসায়ি প্রয়াত আব্দু মিয়ার ৯ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মুখলেছ দ্বিতীয় ছেলে সন্তান। ৯ ছেলের মধ্যে পাঁচজনই সৌদি আরব, দুবাই ও লেবানন প্রবাসী। দেশে থাকা বাকি ৩ ছেলে শহরে দোকান পরিচালনা করেন। দেশে-বিদেশে অবস্থান নিয়ে রোজগার করা সবার নগদ টাকা মুখলেছের কাছে জমা থাকতো। বাবার মৃত্যুর পর থেকে ঘরের কর্তার দায়িত্ব পালনকারি মুখলেছ সেই সুযোগে নগদ প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি ভাইদের ক্রয়সূ্ত্রে মালিকানাধীন দোকানঘর, পুকুর-জমি ও বাড়ির জায়গাসহ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ভূসম্পদ নিজের নামে দলিল করে নেন। একজন দলিল লেখক হওয়ায় সহজেই এসব  প্রতারণামূলক কাজ সম্পাদন করে ফেলেন মুখলেছ।
এদিকে, সম্পত্তি আত্মসাতের ঘটনা জানাজানি হলে অন্য আট ভাই মিলে এটির ফায়সালা করতে এলাকার সালিশকারকদের দ্বারস্থ হন। সালিশকারকরা বিষয়টি মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়ার কারণে মুখলেছ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া বাসায় চলে যান। ভাড়া বাসায় থাকাবস্থায় মুখলেছ বৃদ্ধা মাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় নিয়ে মাকে ভুল বুঝিয়ে অন্য ছেলেদের বিরুদ্ধে তার কথামতো স্বাক্ষ্য দিতে রাজি করায়।
মুখলেছের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১৫ আগস্ট সকালে একটি রিক্সা দিয়ে তার মাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। ওই বাড়িতে প্রবেশের রাস্তায় স্থাপনকৃত সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজে দেখা যায়, ১০:৫৯ মিনিটে বৃদ্ধা জাহারা খাতুনের রিক্সা বাড়িতে পৌঁছায়। এর ঠিক সাত মিনিট পর মুখলেছ সেনাসদস্যদের নিয়ে ওই বাড়িতে যান। এসময় মুখলেছের স্ত্রী এবং শ্বশুর বাড়ির কয়েকজনও তার সঙ্গে ছিলেন। মুখলেছ তার নিজ বসতঘরে ঢুকে দলিলপত্রাদি ও স্বর্নালংকার নিজের দখলে নিয়ে নেয়। সেনাসদস্যরা যখন ওই বাড়িতে প্রবেশ করে তখন বৃদ্ধা জাহারা খাতুন আঙিনায় বসা ছিলেন। সেনাবাহিনীদের দেখামাত্রই জাহারা খাতুন মুখেলেছের শেখানো কথামতো বড় ছেলেসহ অন্য ছেলেদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে থাকে। এরই মধ্যে বড় ছেলে রুবেল মিয়া বাড়িতে আসলে সেনা সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলা পরিষদের অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। এরপর অন্য ছেলেদের খবর দিয়ে সেনা ক্যাম্পে আসতে বলা হয়।
পরে স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে জাহারা’র বাকি সাত ছেলে সেনা ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হয়। এরপর সেনা সদস্যরা সব ভাইদেরকে শাসিয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ায় এবং পারিবারিক বিরোধটির মীমাংসা করতে কাউন্সিলরকে দায়িত্ব দেয়।
এদিকে, এরই মধ্যে মুখলেছ সকল ভাইদের সেনা ক্যাম্পে হাজির হওয়ার ছবি দিয়ে নিজের মাকে তালাবদ্ধ করে রাখার ভুয়া খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে। পরে এ খবরটি ভাইরাল হয়ে পড়ে।এই নিয় কয়েকটি গণমাধ্যমেও মুখরোচক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এলাকাবাসী ও প্রতিবেশীরা বলছেন, আট ছেলের একান্নবর্তী সংসারে বেশ আদর-যত্নেই ছিলেন বৃদ্ধা জাহারা। মানসিকভাবে অসুস্থ জাহারাকে সেবা দিতে কোন কার্পন্য করেনি তার সন্তানেরা। অথচ মুখলেছ সম্পদের লোভে মাকে নিয়ে অন্য ভাইদের সঙ্গে ছলচাতুরি করে। মিথ্যা ও সাজানো এ ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় বেশ সমালোচনার সৃষ্টি হয়। একজন প্রতারক মুখলেছের জন্য ওই পরিবারটিসহ পুরো এলাকার সুনাম ক্ষুন্ন হয়। এই সুনাম ফিরে পেতে মুখলেছকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মুখলেছ মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,‘আমাদের বাড়িতে সেনাবাহিনী যাওয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার মা-ই এ ব্যাপারে স্বাক্ষী দিয়েছেন। আমি ভাইদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করিনি বরং দীর্ঘ বছর যাবৎ সংসারের দায়িত্ব পালন করেছি। এখন সবাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সাত নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারুক আহমেদ বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টিকে মীমাংসা করতে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপর আমি অভিযুক্ত মুখলেছ এবং তার বাকি আট ভাইকে নিয়ে সালিশ করার উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু মুখলেছ আমার ডাকে কোন সাড়া না দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।