চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ হোক -আদিত্ব্য কামাল

মতামত, 9 June 2022, 231 বার পড়া হয়েছে,

তেল নিয়ে তেলেসমাতির পর এবার চাল নিয়ে চলছে চালবাজি। বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন পর্যায়ে চালের দাম বাড়ানোর বিষয়টি বহুল আলোচিত। কৃষি খাতে দেশের সাম্প্রতিক সাফল্যের পরিসংখ্যানের সঙ্গে ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত কৃষক আর বাজারদরের কাছে হার মানা সাধারণ মানুষের বাস্তবতায় ফারাক অনেক। বাজারে চালের দাম বাড়লে সাধারণ ভোক্তারা চাপে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাম বাড়ার সুফল কৃষকরা পায় না। কৃষকের কাছ থেকে স্থানীয় ফড়িয়া, চালকল মালিক, আড়তদার, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতা অন্তত এই পাঁচটি স্তর পেরিয়ে তবেই চাল সাধারণ ভোক্তার কাছে পৌঁছায়।

নানা স্তরের ব্যবসায়ীরা পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগ করে ধান-চালের সরবরাহ ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখবেন এবং যৌক্তিক মুনাফা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে বাজার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চাহিদা-জোগানের স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করতে পারেন এবং কৃষক ও ভোক্তাদের জিম্মি করে ফেলতে পারেন। চালের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে তাই সরকারকেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হয়। উদ্বেগের বিষয় হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান উৎপাদন হলেও ধান-চালের বাজার বারবার অস্থির হয়ে উঠছে এবং কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি সাধারণ ভোক্তারাও বেশি দামে চাল কিনছেন।

সারা দেশে ধান ও চালের অবৈধ মজুদ খুঁজে বের করতে ‘গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে’ মাঠে নামছে খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন তদারক সংস্থা।

বুধবার একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট ও বাবুবাজার এলাকায় চালের আড়তে অভিযান চালায় খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় চাল মজুদকারী বিভিন্ন গুদামে লাইসেন্স আছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়। তবে অভিযান শুরুর খবর পেয়ে পালিয়ে যান সেখানকার চাল ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাল যে দামে ব্যবসায়ীরা কেনেন, সেখান থেকে দোকান পর্যন্ত আসতে প্রতি কেজিতে তাদের আরও দুই টাকা খরচ পড়ে।

পরে এক টাকা (প্রতি কেজি) লাভে সেই চাল বিক্রি করেন তারা। যদিও মূল্য তালিকায় প্রতি কেজিতে ১০-১২ টাকা বেশি দেখা গেছে। আবার খাদ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি ‘অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যা করণীয় তার সবই করা হবে’। সরকারের এই কঠোর অবস্থানের পরেই জানা গেল, ধান ও চালের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে মাঠে নামছে আটটি টিম। একদল ব্যক্তি বা কোম্পানি সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে পরস্পরের স্বার্থ সুরক্ষায় একত্রে কাজ করে সিন্ডিকেট তৈরি করে। ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে এ দেশের জনসাধারণ নিত্যপণ্য ক্রয়ে উচ্চমূল্যের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যের জন্য ব্যবসায়ীদের রয়েছে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেশনের ফলে সেসব নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে জনসাধারণ উচ্চমূল্যের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গত এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম কমেনি। বরং পণ্যভেদে দাম বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বরাবরের মতোই গতানুগতিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাজারে মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে সব ব্যবস্থা। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিলে আর কমাতে চান না। এ ক্ষেত্রে দুটি কারণ রয়েছে, এক. বাজার মনিটরিং নেই, দুই. বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। মাঝেমধ্যে কিছু মোবাইল কোর্ট বের হয়। কিন্তু এটা বাজারে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। নিত্যপণ্যে দর নিয়ন্ত্রণে তদারকি জোরদার করার বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা যেন বিভিন্ন পণ্য নিয়ে একচেটিয়া প্রভাব না ফেলতে পারেন, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে। নিজেদের সক্ষমতা থাকলে অসাধু চক্র সুযোগ নিতে পারবে না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের এম বি রাইস মিলের মালিক মোবারক চেয়ারম্যান বলেন, বড় বড় কোম্পানিরা কৃষকদের উৎপাদিত ধানের একটা বড় অংশ কিনে নিয়ে যান। ওরা যে টাকায় কিনে নেয়, আমরা সেই টাকায় কিনতে পারি না। পরবর্তী সময়ে তারাই নিজেদের মনমতো দামে বাজারে চাল বিক্রি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

‘অনেকে নিজের জমি এখন আর চাষ করেন না। বর্গা দেওয়ার লোকও এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। যাদের পরিবারের লোকজন বিদেশে কাজ করছেন। তাদের পাঠানো টাকাতে দেশে পরিবারগুলো দিন কাটাচ্ছে। তারা এখন আর কষ্ট করে চাষাবাদ করছে না। এদেরকে বাধ্যতামূলক নিজের জমি চাষ করাতে হবে। অন্যথায় সেই জমি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে সরকারিভাবে বছরে তিনটা ফসলের চাষ করাতে হবে’- এমনটাই জানান সিটি রাইস মিলের বেলায়েত হোসেন।

পাশাপাশি তিনি বলেন, সরকার যেভাবে ন্যায্যমূল্যে সার বা বীজ দিচ্ছে- সেভাবে সেচের জন্য, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্যও সহজ কিস্তিতে এবং অল্প দামে কৃষকদের মেশিন সরবরাহ করলে তারা নিজেদের জমিতে চাষাবাদে উৎসাহী হবেন। সরাসরি সরকারিভাবে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কৃষক তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পান। কোম্পানিরা যাতে ইচ্ছেমত দামে ধান কিনতে না পারেন- সেজন্য একটা সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ ও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে।

বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে সেটি কমার উদাহরণ নেই। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। নিয়মিত বাজার তদারকি ও অভিযান পরিচালনার বিষয়টি সরকারের তরফে নিশ্চিত করা জরুরি। বড় আমদানিকারকদের সিন্ডিকেট কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকে। মুক্তবাজারে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাজারের ওপর সরকারের নজর থাকতে হবে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষকে ঠকাবে। সরকার এটা হতে দিতে পারে না। দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর মধ্য দিয়ে জনভোগান্তি তৈরি করা এই ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে এটা নিশ্চিত করা জরুরি।

এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য নিয়ে চালবাজি রুখতে না পারলে চালের দাম অদূর ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল।

চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে বাজারে ধানের দাম বাড়তি থাকার যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা নেহাত খোঁড়া। কারণ যা-ই হোক না কেন, আমরা দেখতে চাই চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ হয়েছে।

আমরা চাই অবিলম্বে সংশ্নিষ্টরা সক্রিয় হবেন। মনে রাখতে হবে, চালের দাম বৃদ্ধি মানে বাকি সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি। যে কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা দমন করতে হবে যে কোনো মূল্যে। ইতোমধ্যে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, অবিলম্বে তাও আনতে হবে নিয়ন্ত্রণে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে আত্মঘাতের নামান্তর।

আদিত্ব্য কামাল,বার্তা সম্পাদক জনতার খবর