বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান (এনজিও) সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট কমিটির (এসডিসি) দুই কর্মকর্তা ৩ মাসের ব্যবধানে খুন হয়েছেন। কিস্তির টাকা আদায় করতে গিয়ে তারা খুনের শিকার হন। গত বছর ৫ ডিসেম্বর এসডিসির সিনিয়র ক্রেডিট অফিসার রাজিবুল ইসলাম রাজিব এবং এ বছর ১৬ মার্চ ক্রেডিট অফিসার অভিজিৎ কুমার মালো নিখোঁজ হন। ঢাকার নবাবগঞ্জের একটি স্পটে তাদের ইলেকট্রিক শক দিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পারছিল না। অবশেষে মোবাইল ফোন সেটের সূত্র ধরে ঘটনা দুটির রহস্য ঢাকা জেলা ডিবি পুলিশ উদ্ঘাটন করেছে। একই ব্যক্তি তাদের হত্যা করেছে। এ ডাবল মার্ডারে জড়িত পোলট্রি ফার্মের মালিক ইউসুফ হোসাইন ও তার কর্মচারী মো. মোস্তফা।
জানা গেছে, স্থানীয় সোনালী অটোগ্যারেজ ওয়েল্ডিং পোলট্রি ফার্মের মালিক ইউসুফ হোসাইন এসডিসি থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণের বিপরীতে সাপ্তাহিক কিস্তি আদায় করতে গিয়েই দুই এনজিও কর্মকর্তা পরপর খুন হন। আদালতে দেওয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুই হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছে দুই ঘাতক। আরও কর্মকর্তাকে খুনের পরিকল্পনা ছিল বলে জানিয়েছে ঘাতক ইউসুফ।
সম্প্রতি ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিশকাত শুকরানার আদালতে ঘাতক ইউসুফ জানায়, ঋণের কিস্তির টাকা আদায়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে রাজিব আমার কাছে আসতেন। আমি তাকে প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার করে টাকা দিতাম। আরও বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমার ঋণ নেওয়া ছিল। ওইসব সংস্থার লোকজন কিস্তি নিতে আসত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হওয়ার আগে আমার ফার্মের অনেক মুরগি মারা যায়। এতে অর্থ সংকটে পড়ে যাই।
ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। এনজিওর লোকজনও কিস্তির জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন পরিকল্পনা করি রাজিবকে হত্যা করে তার কাছে থাকা টাকা নিয়ে অন্য এনজিওর ঋণ পরিশোধ করব। কর্মচারী মোস্তফাকে জানালে প্রথমে সে নিষেধ করেছিল। পরে আমার চাপাচাপিতে সে রাজি হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এক সপ্তাহ আগে একটি কাঠের মাঝে চার ইঞ্চি দুটি পেরেক লাগাই। একটিতে বিদ্যুতের সংযোগ দেই এবং অন্যটিতে নিউট্রাল তার লাগিয়ে শক দেওয়ার মেশিন (‘টি’ আকৃতির) বানাই। পাশাপাশি ফার্মের পেছনে মোস্তফাকে একটি গর্ত করে রাখতে বলি। যেখানে আগে থেকে মুরগির বিষ্ঠা ফেলে হয়।
জবানবন্দিতে ইউসুফ বলেন, নির্ধারিত দিনে বাইসাইকেল চালিয়ে রাজিব কিস্তির টাকা নিতে আমার ফার্মে আসেন এবং একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেন। তাকে কিস্তির দুই হাজার ১০০ টাকা দিই। ওই টাকা তিনি গুনতে থাকলে পেছন দিক থেকে আমি তার ঘাড়ে ইলেকট্রিক শক মেশিন চেপে ধরি। রাজিব নিস্তেজ হয়ে পড়লে মোস্তফাকে বলি রাজিবের সাইকেলটি দূরে কোথাও রেখে আসতে। টিকিরপুর এন মল্লিক পেট্রোল পাম্পের সামনে সে সাইকেলটি রেখে আসে। পরে তার লাশ ফার্মের পেছনের গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রাখি। উপরে ভুসি ও মুরগির বিষ্ঠা ফেলে রাখি। যাতে কেউ কোনো সন্দেহ করতে না পারে। ইউসুফ আরও বলেন, রাজিবকে হত্যার পর তার কাছ থেকে তখন আমরা ৩১ হাজার টাকা পাই। তার জুতা ও ব্যাগ পুড়িয়ে ফেলি। তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখি। ঘটনার পাঁচ দিন পর রাজিবের মোবাইল ফোন অন করে এসডিসির ম্যানেজারকে কল দিই।
তার কাছে রাজিবের মুক্তিপণ হিসাবে দুই লাখ টাকা দাবি করি। পরে সিম ভেঙে রাস্তার পাশে ফেলে দিই। রাজিবের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনসেটই মোস্তফাকে দিয়ে দিই। পরবর্তীতে আমার একটি ফোনসেট নষ্ট হলে মোস্তফার কাছ থেকে রাজিবের বাটন সিম্ফোনি সেটটি নিয়ে ব্যবহার করতে থাকি। ইউসুফ আরও বলেন, রাজিব নিখোঁজ হওয়ার পর তার খোঁজে এনজিওর লোকজন আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাদের বলেছি, রাজিব এসে টাকা ও বই নিয়ে চলে গেছেন।
স্বীকারোক্তিতে ইউসুফ বলেন, রাজিবকে হত্যার পর তার জায়গায় ঋণের টাকা নিতে আসতেন অভিজিৎ। তাই একই কায়দায় তাকেও হত্যার পরিকল্পনা করি। ঘটনার আগের দিন গ্যারেজের পেছনে ইছামতি নদীর ধারে বাঁশঝাড়ে গর্ত খুঁড়ে রাখি। ১৬ মার্চ অভিজিৎ দুপুর ১টার দিকে আমাকে ফোন দেন। কিন্তু আমি তার ফোন রিসিভ করিনি। কারণ তিনি যেন আমার গ্যারেজে আসেন। দুপুর সোয়া ১টার দিকে অভিজিৎ সাইকেল চালিয়ে আসেন এবং আমি তাকে ৩৫০ টাকা দিই।
টাকা গোনার সময় তার ঘাড়ে ইলেকট্রিক শক মেশিন চেপে ধরি। এ সময় তিনি চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর তিনি নড়াচড়া শুরু করলে তার মুখে বাটালি ঢুকিয়ে দিই। এতে তার দুটি দাঁত ভেঙে যায়। এরপরও নড়াচড়া বন্ধ না হলে তার মুখ চেপে ধরি। তখন তিনি আমার হাতে কামড় বসিয়ে দেন। এরপর বাটালি দিয়ে আমি তার গলা কেটে ফেলি। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণের পর তিনি মারা যান। তার সাইকেলটিও মোস্তফা দূরে ফেলে আসে। অভিজিতের মাথা বিচ্ছিন্ন করে একটি পলিথিনে এবং দেহ পাটের বস্তায় ভরে গর্তে মাটিচাপা দেই। অভিজিতের কাছ থেকে তখন আমরা ২৪ হাজার ৮০ টাকা পাই। সেখান থেকে মোস্তফাকে তিন হাজার টাকা দিই। বাকি টাকা দিয়ে আমি অন্য এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করি।
অভিজিতের কালো ব্যাগ মোস্তফা পুড়িয়ে ফেলে। তার মোবাইল ফোনসেটটি পরদিন ছাতিয়া মোহনপুর ব্রিজের নিচে ফেলে দিই। অভিজিৎ মারা যাওয়ার পর এনজিওর লোকজন আমার কাছে আসে। আমি তাদের বলি, অভিজিৎ আমার কাছে আসেননি। একই আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোস্তফা বলেন, প্রথমে এনজিও কর্মকর্তা রাজিবকে হত্যা করতে আমার সঙ্গে ইউসুফ পরিকল্পনা করে। ইলেকট্রিক শক দিয়ে রাজিবকে হত্যার সময় আমি পাহারাদার হিসাবে বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। অভিজিতকেও একই কায়দায় হত্যা করে ইউসুফ।
রাজিব ও অভিজিতের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ঢাকা জেলা (উত্তর) ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী আকবর যুগান্তরকে বলেন, রাজিবের নিখোঁজের ঘটনায় থানায় জিডি হয়। পরে মামলাও হয়। কিন্তু থানা পুলিশ তদন্ত করে এর কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিল না। এরইমধ্যে অভিজিৎ নিখোঁজ হন। এ ঘটনাতেও প্রথমে জিডি ও পরে মামলা হয়। কিন্তু এর রহস্য উদ্ঘাটন করা যাচ্ছিল না। পরপর দুই এনজিও কর্মকর্তার নিখোঁজের ঘটনা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা জেলা ডিবির কাছে তদন্তের ভার দেওয়া হয়।
তদন্তের একপর্যায়ে জানা যায়, রাজিবের মোবাইল ফোনসেটটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সূত্র ধরে প্রথমে ইউসুফকে এবং পরে মোস্তফাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের কাছে তারা ফৌজদারি ১৬১ ধারায় এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ঘটনা দুটির রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে। আমাদের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। যুগান্তর