শৈশবে শহীদ মিনার নির্মাণ -আবদুল মতিন শিপন

সাহিত্য, 20 February 2022, 477 বার পড়া হয়েছে,
একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে স্মৃতিচারন বলেন,আর শৈশবের দাপটে বেড়ানোর রঙিন মুখোশই বলেন সবকিছু মনে করিয়ে দেয় ৮ ফাল্গুনকে ঘিরে আমার বাল্য বন্ধুদের উন্মাদনা।শহীদ মিনার নির্মানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহন শৈশবের নানান আনন্দঘন মূহুত্বের মধ্যে একটি যা স্মৃতির পাতায় সারাজীবন অম্লান হয়ে থাকবে।স্মৃতিতে একাকার হয়ে মিশে আছে মুন্না রাসেল,শিথিল,মিঠু,সায়েম বন্ধুদের নাম।যারা এলাকায় শহীদ মিনার নির্মানের কারিগর।
তখন বয়স কতই বা দশ কিংবা এগারো।বেশ ছোট ছিলাম। একুশ নিয়ে যে চেতনাবোধ মনে আঁছর কাটবে ঠিক তা নয়।কিসের তাড়নায় যে কিভাবে এই সৃজনশীল কাজগুলোতে অংশগ্রহন করেছি তা নিজেও আবিষ্কার করতে পারিনি।কোনটা রবীন্দ্রসংগীত, কোনটা নজরুল,কোনটা লালন ফকিরের গান তা কিন্তু মোটেও আমাকে কেউ পরিচয় করিয়ে দেননি, নিজে থেকে কিভাবে শৈশবে সৃজনশীলতা নিজের মাঝে পাখনা মেলতে শুরু করেছে তা কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে এখনও।
আমার বন্ধুদের উৎসাহ উদ্দীপনা বেশ আমাকেও অনুপ্রাণিত করত।কিন্তু শহীদ মিনার নির্মানের জন্য এলাকার মুরব্বিদের সহযোগিতা যে বেশ পেতাম তা কিন্তু নয়।ধর্মীয় রীতিনীতিতে তা কতখানি আঘাত হানতেন তা কিন্তু আমরা জানতাম না।কিছু কিছু স্বাধীনচেতার মুরব্বিরা যে সহযোগিতা একেবারেই  করতেন না তা কিন্তু সত্য নয়।শহীদ মিনার নির্মানের স্হান নির্বাচন,নির্মানের উপকরন সংগ্রহ ,ব্যানার, ফেষ্টুনে শ্লোগান লিখা,রং তুলিতে দেয়াল আল্পনা,দেশের গানের সাথে নৃত্য প্রস্তুত করা কি যে এক কর্মের মহাযজ্ঞ কিন্তু তার জন্য আমাদের পড়ালেখার যে ব্যাঘাত ঘটতো তা কিন্তু নয় এখনকার মত বছরের শুরুতেই আমাদের এত পড়াশুনোর চাপ থাকত না। যারা কবিতা,গল্প,নানান ছন্দ লিখত তাদের লিখা নিয়ে স্মরনিকা প্রকাশও বাদ যায়নি আমাদের একুশকে ঘিরে এই চমৎকার আয়োজনে।যখন সারা মাস কষ্ট করে ছাপা অক্ষরে নিজেদের লিখা ছড়া,গল্প স্মরনিকার পাতায় দেখতাম তা এক অন্য রকম উদ্ভত অনুভূতি ছিল।নতুন বইয়ের গন্ধ এখনো আমাকে মোহিত করে।
একুশে ফ্রেব্রুয়ারীর আগে সারাদিন নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মান শেষ করতে করতে আমাদের রাত হয়ে যেতো তারপরও  বার বার চোখ বুলিয়ে দেখে নিতাম কোন কিছুর অপূর্ণতা রয়ে গেছে কি না।সবকিছু যখন শেষ হত তখন প্রায় রাত ১০টা বেজে যেতো।যেখানে মাগরিবের পরেই বাসার বাহিরে থাকা ছিল কঠিন নিষেধাজ্ঞা, সময়ে সময়ে উওম মাধ্যম খেতে হতো দেরি করে ফেরার জন্য কিন্তু কুড়ি তারিখের রাত ছিল উন্মুক্ত।অভুক্ত আর ধূলোবালি নিয়ে যার যার বাড়িতে চলে গেলেও সবাই আমার সন্দেহ কেউ সারা রাত ঘুমাতে পারেনি কখন ভোর হবে নিজের হাতে গড়া শহীদ মিনারে সমবেত হবে,কখন ফুল দিবে।কি যে চমৎকার অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করবার মত না।
সকাল ভোরে পাঞ্জাবি পড়ে সবাই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য একত্রিত হয়,সাউন্ডে বাজতে থাকে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”। দেয়াল জুরে লিখা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “মোদের গরব মোদের আশা
আ ম’রি বাংলা ভাষা”।ভাষা সৈনিকদের মাটিতে লুটিয়ে পড়া রক্তাক্ত মরদেহের অংকন।যা আবেগ তাড়িত করত সবাইকে এবং ভাষা সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিত।এলাকার কিশোর কিশোরী বৃদ্ধা বনিতা আপামর উৎসুক জনতা ফুল হাতে শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করার দৃশ্য যে কি মনে শান্তি সঞ্চার করত,কি যে মহাভারত সিন্ধু জয় করেছি তা বহিঃপ্রকাশ করবার মত নয়।
সারাদিন দেশাত্মবোধক গানের ধ্বনিত হতো পুরো এলাকায়।বিকেল বেলা কবিতা পাঠ,একক অভিনয়,নৃত্য এবং পুরষ্কার বিতরন করার জন্য এলাকার বড় ভাইদেরকে নিমন্ত্রন করা হত।
সবকিছু মিলিয়ে একুশের দিন ছিল শৈশবের স্মরণীয় স্মৃতির বাতিঘর যেখান থেকে শিখেছি একুশ মানে মাথা নত না করা,একুশের দাবি ন্যায়ের দাবি,সত্যের দাবি,মাথা উঁচু করে বাঁচার দাবি।
একুশ এখনও আমাকে আবেগতাড়িত করে,এখনও আমি বন্ধু খুঁজি একুশের প্রথম প্রহরে।সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছে কিন্তু এখন আর কাঁচা হাতে শহীদ মিনার নির্মান হয় না।কিন্তু ফেসবুকে শেয়ার করতে ভুলি না।বাগান থেকে ফুল চুরি করে আনি না।তবে একুশের প্রথম প্রহরে ঘুমই হয়ত আর ভাঙ্গে না।
জুরে সাউন্ড বাজিয়ে হয়ত আর দেশের গান শুনা হবে না তবে হলুদের রাতে হিন্দি গান বাজাতে আমরা ভুলব না।স্মরনিকার পাতায় ছাপা অক্ষরে নিজের নাম হয়ত আর কোন দিন লিখা দেখব না কিন্তু চাকুরীর পদোন্নতিতে নিশ্চয় ছাপা অক্ষরে নিজের নাম দেখব।কিন্তু এমন আনন্দ হয়ত আর পাবো না।এলাকার ছোটদেরও এত সময় নেয় শহীদ মিনার নির্মানের কারন তারা তো এখন অনেক নেতার ভাষা দিবসের শুভেচ্ছা লাইক শেয়ারে ব্যস্ত।কি এক মিল-অমিলের খেলায় আমরা,নিজেরাও জানি না কি হারিয়ে কি পেয়েছি।
একুশ আমাদের চেতনায় মিশে আছে,হাজারো শহীদদের তাজা রক্তেমাখা,ছেলেহারা মায়ের আকুতি।
“রাষ্টভাষা বাংলা চাই” এই শ্লোগান ভাষা আন্দোলনের পরে পাল্টে হয়ে যায় “বাংলা ভাষার রাষ্ট চাই”। তারপরই পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখন্ড,লাল সবুজের পতাকা,মায়ের মুখের ভাষা,মানচিত্র।
‘জয়তু একুশ’
আবার তারুণ্যের একুশকে হারিয়ে ফিরে ফিরে পাই।
“যে ভাষার জন্যে এমন হন্যে, এমন আকুল হলাম
সে ভাষায় আমার অধিকার
এ ভাষার বুকের কাছে মগ্ন আছে আমার অঙ্গিকার….”
                                                    – কবীর সুমন
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা