মানবাধিকারের গুরুত্ব

মতামত, 30 September 2021, 558 বার পড়া হয়েছে,

মানবাধিকারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় মানবসমাজের জন্য দ্বিতীয়টি আছে বলে আমাদের জানা নেই। আজকের বিশ্বে তা আরও বেশি প্রমাণিত। মানবাধিকার শব্দটি কোনো আঞ্চলিক কিংবা জাতীয় পরিভাষায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক, ব্যাপক-বিস্তৃত অর্থবোধক ও সর্বজনীন শব্দ। কোনোরকম সঙ্কীর্ণতাকে এটি বিন্দুমাত্র সমর্থন করে না। অন্যায়-অত্যাচার ও বৈষম্যকে কখনোই সহ্য করে না। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে এতে অন্তর্ভুক্ত করে।

মানবাধিকার লড়াই করে বিশ্বের দুর্বলদের পক্ষে এবং কথিত শক্তিশালীদের বিপক্ষে। মানবাধিকার নিঃসঙ্কোচে লড়ে যায় পৃথিবীর কালোদের পক্ষে, অর্থবিত্ত ও ক্ষমতাহীনদের পক্ষে, হাজার বছর ধরে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত তথা অসহায় মানুষদের পক্ষে। মানবাধিকারই একমাত্র বিষয়, যা প্রতিটি মানুষেরই কল্যাণ কামনা করে। আমাদের জানামতে, মানবাধিকার কোনো ধর্মের বাইরে নয়। বরং সত্যিকার ধর্ম প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকারকেই জগতে প্রতিষ্ঠিত করে।

মানবাধিকার অর্থাৎ মানুষের যা অধিকার বা প্রাপ্য। এখানে মানুষই সর্বপ্রথম গবেষণার দাবিদার। মানুষের অনুপস্থিতিতে অধিকারের কল্পনা করা যায় না। আজ অধিকার নিয়ে লড়াই-সংগ্রামের মূল কারণ মানুষের প্রকৃত পরিচয়ের অভাব। জগতের আর কোনো সৃষ্টি নিজেদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করে না, করতে হয় না। একমাত্র মানুষই করে, করতে হয়। কেন করে, করতে হয়? কারণ মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে তাদের অধিকারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। অথচ মানুষের দ্বারাই মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়।

আজকের বিশ্বে হত্যা-জুলুম, যুদ্ধ, মানবতার বিপর্যয় ইত্যাদির একমাত্র কারণ মানুষের মৌলিক পরিচয়ের অভাব। সঠিক জীবন-দর্শনের অভাব। সুতরাং মানুষ সৃষ্টিগত বা জন্মগতভাবেই কতগুলো অধিকার প্রাপ্ত। যেমন_ হাত, পা, চোখ, নাকসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এগুলো শারীরিক শক্তি। অন্যদিকে বুদ্ধি, জ্ঞান, বাকস্বাধীনতা, চিন্তা, ইচ্ছা-অনুভূতি, বিশ্বাস ইত্যাদি। এগুলো মানসিক বা আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি।

সর্বজনীন চিন্তা, কোনো কিছুর সাময়িক মালিকানা, আকাশের চেয়ে বড়, সমুদ্রের চেয়ে বিশাল, পর্বতের চেয়ে কঠিন এবং মুহূর্তের মধ্যে বিশ্ব ভ্রমণের মানসিক শক্তির অধিকার একমাত্র মানুষেরই আছে। অন্য কোনো সৃষ্টির নেই। সাধারণভাবে এসব অমূল্য শক্তি ব্যবহার ও বিকশিত করার অধিকার সৃষ্টিগতভাবেই সব মানুষ পেয়ে থাকে। তাই এ অধিকারগুলোর প্রতি নজর রাখা, যত্নবান হওয়া এবং এসবের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রাথমিক দায়িত্ব। এগুলোর জন্য অন্য কাউকে দোষী বা দায়ী করা যায় না, করলেও কোনো লাভ নেই।

আমরা জানি, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্ম, বিবাহ, বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এসব প্রতিটি মানুষেরই একান্ত প্রয়োজনীয় অধিকার। অনেকে বলেন, এর মধ্যে কোনো কোনোটি মৌলিক অধিকার। একজন মানুষকে সাধারণভাবে চলতে-ফিরতে, স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে এ অধিকারগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আজকের বাস্তবতা কী বলে? পৃথিবীর কত কোটি মানুষ এ একবিংশ শতাব্দীতেও এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং কেন? পৃথিবীর সম্পদ কম? মানুষ গরিব? কখনোই নয়। বরং সমানুপাতিক বণ্টনের সমস্যা। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার অভাব, মানসিক দৈন্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত দুর্বলতা।

এসব অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য। তবে কোনোভাবেই এসব আদায় করতে গিয়ে নতুন করে সংঘাত-সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কিংবা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হিংসা-প্রতিহিংসায় জড়ানোর সুযোগ নেই। বরং মানুষ ও তার অধিকার নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হতে হবে। যতক্ষণ না একটি সমাজ, একটি দেশ ও একটি জাতি সাধারণভাবে এর ওপর সহমত পোষণ করে। কারণ বিশ্বের সব মানুষ মৌলিকভাবে এক, তাদের মৌলিক চাহিদা এক, মৌলিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও এর গতি-প্রকৃতি এক।

শারীরিক মৌলিক চাহিদা সুস্থতা। অন্যদিকে মানসিক মৌলিক চাহিদা শান্তি। এ শান্তির চাহিদা প্রতিটি মানুষের মধ্যে সব সময় বর্তমান। বিশেষ করে এটি বাড়ে দুঃখ-কষ্ট ও অশান্তির মুহূর্তে। এছাড়াও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এটি বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ভৌগোলিক স্বাধীনতা, বৈবাহিক স্বাধীনতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক সৌন্দর্য ও সুস্থতার পরও মানসিক শান্তির নিশ্চয়তা নেই। মানসিক শান্তির জন্য শর্ত জ্ঞান, সৃষ্টিগত তথা বাস্তবধর্মী জীবনদর্শন ও বৈপরীত্যের গতিতে সমন্বয়ের যোগ্যতা। মানবজীবন ক্লেশ-বিজড়িত। শত চেষ্টা সত্ত্বেও দুঃখ-কষ্ট থেকে মানুষ পালাতে পারে না। প্রতিটি আরাম, সুখ ও আনন্দের পর কষ্ট অবধারিত। কারও কারও ক্ষেত্রে এ কষ্টটা একটু পরে আসে, অনেক কষ্ট জমা হয়ে, একসঙ্গে।

আশার কথা, প্রতি মুহূর্তের অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী শত কষ্টের ভেতর দিয়েও মানবের জন্য অফুরন্ত শান্তির পথ খোলা আছে। আর এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। সুতরাং মানবাধিকারের আলোচনায় মানুষের মানসিক মৌলিক চাহিদা ‘শান্তির’ কথা থাকবে না, পারিবারিক-সামাজিক ঐক্যের বিষয় থাকবে না, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সমাধান থাকবে না_ এটা কী করে হয়?

মানবাধিকার কি শুধুই কথিত মানবতাবাদীদের দ্বারা বঞ্চিতদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মরা আওয়াজ? অথবা সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি?

জাকির মাহদিন: সাংবাদিক ও কলামিস্ট