আজ আমাদের জাতীয় জীবনের একটি শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছিল এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে মেতে উঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা হত্যা করে জাতির অনেক কৃতী সন্তানকে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি তাদের দোসর এ দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই দিনটি সরকারিভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এ দিন বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি শোকাবহ দিন। নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালায় তাতেও অনেক বুদ্ধিজীবী শহীদ হন।
তবে নীল নকশা অনুযায়ী চরম আঘাতটি আসে ১৪ ডিসেম্বর। পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তানি হানাদাররা। আর এ জঘণ্য কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনি। এই বাহিনি বুদ্ধিজীবীদের একটি নামের তালিকা করে।
এবং তালিকা অনুযায়ী এই বাহিনির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিথ্যে অজুহাতে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, লেখক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী. চলচ্চিত্র ও নাট্য ব্যক্তিত্ব, সংগীত শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী প্রমুখ। শিক্ষা, সংস্কৃতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথিকৃৎ এই বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীসময়ে চোখ বাঁধা, দু’হাত পেছন দিক থেকে বাঁধা, ক্ষত-বিক্ষত অনেক লাশ খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন বধ্যভূমিতে। অনেকে হারিয়ে যান চিরতরে, তাঁদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নি। সারা দেশেই এমন নৃশংসতা ঘটে। সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে ঢাকার মীরপুর ও রায়ের বাজারে।
এ হত্যাযজ্ঞের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা লাভের আগেই মেধাশূন্য করে ফেলা। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করার পর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা গণহত্যার পাশাপাশি বেছে বেছে কিছু মানুষকে হত্যা করে, যারা বিবেচিত হতেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক হিসাবে। মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়টায় ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা শহরে হত্যা করা হয় তাদের। পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর হত্যাকারীরা ঢাকার রায়েরবাজার, মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই তাদের নিকটাত্মীয়রা বধ্যভূমিতে স্বজনদের লাশ খুঁজে পান। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্যাতন করেছিল পৈশাচিকভাবে। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, তাদের কারও চোখ-হাত-পা বাঁধা, কারও শরীর ক্ষতবিক্ষত। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। অনেকের লাশ খুঁজেও পাওয়া যায়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর একটি ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। প্রাণরক্ষার্থে অথবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করায় তারা রেহাই পান ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে। নয়তো তাদেরও হতে পারত একই পরিণতি।
বুদ্ধিজীবীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনসাধারণকে স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন এবং সহায়তা জুগিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমরা হারিয়েছি, তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জনের ফলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই বিষাদে পরিণত হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণে। বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহিদ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এই শোকাবহ দিনটি প্রতি বছর আমরা পরম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।
–আদিত্ব্য কামাল,সম্পাদক- জনতার খবর