গত ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। খোদ সরকারি দল, আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রিসভায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। এই সময় তিনি ঘরে বাইরে কোণঠাসা পড়েন। ওই ঘটনার পর এই প্রথম তিনি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন।
বাংলা ইনসাইডারের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ বোরহান কবীরের সঙ্গে আলাপচারিতায় বেশকিছু খোলামেলা কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, চিলে কান নিয়ে গেছে, কান ধরেও দেখে না আসলে কি জিনিস। আমার সহকর্মীরা আমাকে জিজ্ঞেস না করে আন্দাজে কথা বলে। আজকে বলে ভাই আমি সরি, আপনার সাথে কথা বলা উচিৎ ছিলো।
আমি বললাম, বলেন নাই কেন? বলে আপনি তো আমাদেরকে জানান নাই। আমি বললাম ওকে। উনি বললেন একটু জানান, তাহলে আমাদের জন্যও সুবিধা। আজকে লিখিত বিবৃতি দিয়েছি।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে কথা বলি নাই। কারণ, আমাকে সবাই বলে কিছু বইলেন না। আমাদের সাধারণ সম্পাদক উপদেশ দিয়েছেন আপনি কথা বইলেন না। তারপর আমার আশেপাশে সবাই বলছে কোনো কথা বলবেন না। এটা কি শুরু করেছেন এনারা।
কথা বলতে তারা দিবেনা আমাকে, এটা কি তাজ্জবের বিষয়। আজকে আবার আমাকে অভিযোগ করলেন আমার দুই কলিগ। বললেন, আপনি আমাদের বললেন না। বললাম, আমি না বলার আগেই তো আপনারা বলে ফেলেছেন। আমাকে তো আপনারা জিজ্ঞেসও করেন নাই। বললো, আমরা সরি। আপনি একটু আমাদের লিখে দেন কি ঘটনা হয়েছিলো।
ভারত ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমি বললাম, এটা জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠান। সেখানে আমরা সম্প্রীতির কথাই বলতেছি। কোনো নির্বাচন নিয়ে না, ভারতেও কোনো নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়নি। সন্ত্রাস আর উগ্রতা না থাকলে কেমন উন্নয়ন হয়। শুরুই করেছি ওখানে আসামের মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে। যে আপনার মুখ্যমন্ত্রী এটা বলেছেন। আপনার দেশেও কিছু উগ্র লোক আছে, দুষ্টু লোক আছে, আমার দেশেও আছে। এইসব ব্যাপারে যদি আমরা একমত হই যে, এগুলো আমরা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কখনো বলবো না, নিরুৎসাহিত করবো। তাহলে স্থিতিশীলতা থাকবে, সম্প্রীতি থাকবে। আর শেখ হাসিনা হচ্ছেন সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতার একটি প্রতীক। তাকে আমরা যেভাবে পারি সাহায্য করবো।
তিনি আরও বলেন, ওখানে নেত্রী বক্তৃতা দিয়েছেন। আমি বলেছিলাম নেত্রী বক্তৃতা দিয়েছেন, আমার কোনো বক্তৃতার দরকার নাই। বললো যে, আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর দেন। বললাম ঠিক আছে। তখন বলতে গেলাম ভারতে কি আলাপ হয়েছিলো। সেখানে আমি বললাম যে, এখানে মুখ্যমন্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়। ওখানে বিভিন্ন জায়গায় ইদানীং স্থিতিশীলতা যথেষ্ট বিরাজ করছে। আরেকটি আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি। আপনার ওখানে কি এক মহিলা একটা কি বক্তব্য দিয়েছে, তখন আমাদের এখানে খুব প্রেসার ছিল আমরা একটা বক্তব্য দিবো। আমরা দেই নাই, চুপ করে ছিলাম। কারণ, বক্তব্য দিয়ে তো কোনো লাভ নাই। আমি তখন গণমাধ্যমে বলেছি, রাসুল বলেছেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার দরকার নাই। কিন্তু তখন আমার খুব চাপ ছিল আমরা একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিব এর বিপক্ষে। কিন্তু আমি দেই নাই। আমি সেটা ওনাকে বলেছি যে, আমরা কোনো বিবৃতি দেইনি। কারণ, আপনার এখানে গণ্ডগোল হয়, আমার ওখানেও গণ্ডগোল হয়। আমার ওখানে গণ্ডগোল হলে আপনার এখানেও গণ্ডগোল হয়। কারণ, আমরা আইসোলেটেড আইল্যান্ড (isolated island) না। আমরা এমন জায়গায় থাকি যে এখানে কিছু হলে ওখানে কি প্রতিক্রিয়া হয়। উনি সমর্থন করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি, দেখেন শেখ হাসিনা একটা স্থিতিশীল। শি ইজ এ সিম্বল অব স্ট্যাবিলিটি (she is a symbol of stability)। তাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। কারণ, তিনি অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। এটা আমাদের গর্ব। আমি অবশ্য তখন বঙ্গবন্ধুর কথাও বলেছি। বঙ্গবন্ধু সারা জীবনই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন। আর বলেছি কয়েকটা ছোটখাটো কিন্তু বিব্রতকর ইস্যু থাকে। যেমন- সীমান্তে হত্যা করলো। এগুলো আপনারা সমাধান করেন, এই ব্যাপারে আপনাদের যা যা করা দরকার সেগুলো করলে আমরা খুশি হবো।
কলিগদের অবস্থান প্রসঙ্গে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমি বিস্মিত। আজকে বলছে যে, আপনি বলেন নাই। ওরা তো আমাকে জিজ্ঞেসও করেন নাই। জিজ্ঞেস না করেই বিবৃতি দিয়ে দিয়েছে। আজকে বলছে আপনি বলেন নাই। তারপরে আমি ছোট একটা লেখা লিখে উনাদের জানিয়েছি।
আব্দুর রহমান বলছেন যে, আপনি নাকি আওয়ামী লীগের কেউ না। আওয়ামী লীগের যদি আপনি কেউ না হন তাহলে আপনি নমিনেশন পেলেন কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, উনি যেটা বলতে চেয়েছেন প্রেসিডিয়ামের কেউ না বা কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ না। তিনি কারেকশন করেছেন।
‘বেহেশতে’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাকে বলেছে আমাদের অর্থনীতি খুব খারাপ। আমি বলেছি, শুনেন আমাদের অর্থনীতি খুব ভালো। দুনিয়ার সব জায়গায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আমাদের মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৭ শতাংশ, আর আমেরিকায় বেড়েছে ৯ দশমিক ১, যেখানে ২-৩ শতাংশের বেশি কখনোই বাড়ে না। ইংল্যান্ডেও অনেক বেড়েছে। তুর্কীর মতো একটি বড় অর্থনীতির দেশের ৬৭ শতাংশ বেড়েছে, পাকিস্তানে ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। আর গণমাধ্যমের তথ্যমতে শ্রীলঙ্কায় ১৫০ শতাংশের বেশি। সুতরাং দেখেন ওদের কীরকম কঠিন অবস্থা। এদের তুলনায় আমরা অনেক ভাল আছি। আফগানিস্তানে মানুষ মসজিদে গেলে মেরে ফেলে, আমেরিকায় স্কুলে গেলে মেরে ফেলে। আমরা সেই দিক থেকে ওদের তুলনায় অনেক ভাল আছি, আপনারা বলতে পারেন ‘বেহেশতে’ আছি। ‘বেহেশতে’ শব্দটা আমরা সবসময় ব্যবহার করি। এখন বাকি সব বাদ দিয়ে মোমেন সাহেব বলছে, ‘বেহেশতে’ আছি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, মিশেল তো এসে প্রথমদিনই আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ফেললো। আমরা একটা সুশীল গ্রুপ এনেছিলাম। কিন্তু আমাদের ফরমেটটা খুব খারাপ। আমি ওকে (মিশেল) উপরে বসিয়ে রাখছি, আর আমাদের সুশীলরা বড় বড় বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু ওদের সিস্টেম যেটা করেছেন সেটা ইন্টারেক্টিভ (interactive)। গোল টেবিলে সবাই বসেছেন। আর এমনিতে আগে থেকেই সে একটা আইডিয়া নিয়ে এসেছেন। আমাদের সাথে যখন আলাপ হয়েছে তখন খারাপ কিছু বলে নাই। কিন্তু তাদের ওখানে যখন গেলো, এরপর প্রেস কনফারেন্স করলো। আমি চেয়েছিলাম আমার সাথে কথা বলার প্রেস কনফারেন্স করুক। কিন্তু আমার মন্ত্রণালয়ের লোকজন বললো, স্যার এটা ঠিক হবে না। কিন্তু সে ঠিকই প্রেস কনফারেন্স করে গেছে।
মিশেল ব্যাচেলেট যে নিরপেক্ষ কমিশনের কথা বলে গেছেন আপনারা সেটা নিয়ে ভাবছেন কিনা এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমার সাথে তো এটা নিয়ে আলাপ হয়নি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে, আমাদের দেশে তো কমিশন আছে। তারা সক্রিয়। তাদের সরকারে নয়, তাদের নিজস্ব অথরিটি আছে। আমাদের দেশের ডেফিনিশন অনুযায়ী আমাদের আইনে, ফোর্স ডিসেপিয়ার শব্দটাই নাই। কোনো আইনই নাই। এগুলো ল্যাটিন আমেরিকা, অন্যদেশে আছে। মিশেল ব্যাচেলেটের বাবাকে ফোর্স ডিসেপিয়ার করে মেরে ফেলেছে। তাই তার নিজের এই অভিজ্ঞতা আছে।
মিশেল ব্যাচেলেটের সফর, একই সাথে নেত্র নিউজের আয়নাঘর প্রতিবেদন প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ৭৫ এর মতো একইভাবে এখন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। নেত্র নামে একটি নিউজ আছে। সুইডেনকে জিজ্ঞেস করলাম এই বিষয়ে। তারা বললো তারা জানেনা। এটা আমাদের পত্রিকা নয়। এটাতে যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই ফান্ডিং করে। তারা আমাদের ওখানে থাকে। ইংরেজিতে ডেভিড বার্গম্যান এবং বাংলায় তাসনিম খলিল। তাদেরকে যে কে তথ্য দেয় আমি বলতে পারবো না। তারা একেক সময় একেকটা আজগুবি বের করে। বের করে এটাকে ফলাও করে। কে প্রমোট করছে? নেত্র নিউজের এই আয়নাঘরের নিউজগুলো ভয়েস অব আমেরিকা, এরা প্রমোট করে। সুতরাং বিদেশে অবশ্যই কিছু হচ্ছে।