কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাসগুলি তাঁর অন্যতম সাহিত্যকর্ম- আমির হোসেন

সাহিত্য, 24 May 2025, 152 বার পড়া হয়েছে,

কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন প্রচুর। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান ও এগুলি সুরারোপ করেছেন। যেগুলি এখন নজরুল সঙ্গীত বা নজরুল গীতি নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম সত্যিকার অর্থেই ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তাঁর একটি দিক নিয়ে কথা বললে অন্য আরও দশদিক অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই ব্যতিক্রমী প্রতিভার কাজী নজরুল ইসলামের খ্যাতি কবি ও গীতিকার হিসেবেই অর্জিত হয়েছে বলে মনে করা হলেও তাঁর অবিস্মরণীয় প্রতিভা কেবল কবিতা ও সংগীত রচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ একটা অভিনব বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র মাহিমার স্বাক্ষর রেখেছে। ভাষার ঐশ্বর্যে, বিষয় বৈচিত্রে্য, শৈল্পিক নৈপুণ্যে, সর্বোপরি সৃষ্টি মাহাত্ম্যে এ সকল সহিত্যকর্ম তাঁর কবিতার মতই মাধুর্যমণ্ডিত। বাইরের জগতে মাঝে মাঝে যেমন ঝড় ওঠে মানুষের মনের জগতেও তেমনি এবং ওঠে একই কারণে। কোথাও কোন উত্তাপ যখন অস্বাভাবিক ও অসহ্য হয়ে উঠে তখন ঝটিকার প্রচণ্ডতার ভেতর দিয়েই অন্তর ও বহিঃপ্রকৃতি তার স্বাভাবিক সামঞ্জস্য ফিরে পাবার প্রয়াস পায়।

বাংলাদেশের মনে খ্রিস্টীয় শতাব্দির দ্বিতীয় দশকে এমনি অস্বাভাবিক উত্তাপই রাজনৈতিক সামাজিক ও আর্থিক কারণে জমে উঠেছিল। সেই উত্তাপ থেকে যে দুরন্ত বাষ্পবেগের সৃষ্টি হয়েছিল তার একদিকের প্রকাশ নজরুল ইসলামের মধ্যে মূর্ত। বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারি নজরুলের পরিচিতি কবি হিসেবে হলেও তাঁর সাহিত্যে আবির্ভাব গদ্য রচিয়তা হিসেবে। নজরুলের তিনটি উপন্যাস বাঁধন-হারা, কুহেলিকা, ও মৃতুক্ষুধা।

প্রকৃত অর্থে বাংলা উপন্যাসের প্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস সন্ধান করতে গেলে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে তার অঙ্কুর কখনো কখনো দেখা গেলেও, এর শুরু ইংরেজি উপন্যাসের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রে অর্থাৎ উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। এ সময় ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’ (১৮২৩), প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরে দুলাল’ (১৮৫৮) এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নকসা’ (১৮৬২) প্রকাশিত হয়। তিনিটি উপন্যাসেই সমকালীন জীবনের বাস্তব রেখাচিত্র সেখানে ধরা পড়েছে। এ তিনটির মধ্যে ‘আলালের ঘরে দুলাল’ বাস্তবতা ও চরিত্র-নির্মাণ দক্ষতার গুণে সর্বাধিক উপন্যাসের লক্ষণযুক্ত। তবে বাংলা ভাষায় সার্থক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের কথা। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় রোমান্স ও বাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয়ে উপন্যাসের সম্ভাবনার দ্বারোদঘাটন হয়েছিল। দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) ও সীতারাম (১৮৮৭) ইতিহাস-রোমান্স-ধর্ম ইত্যাদি বিশ্লেষণে বাংলা উপন্যাসের নানা দিগন্ত তিনি উন্মুক্ত করে দিলেন। ভাষা ও নির্মাণ কুশলতায়, ইতিহাস-রোমান্স-সমাজবাস্তবতা, ব্যক্তি-মানসের দ্বন্দ্বমুখর চরিত্র বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা উপন্যাসে প্রথম সার্থকতম শিল্পী: যাকে অতিক্রম করা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর মত শক্তিমান লেখকদের অবিরল অবদানের ফলে বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের ধারাটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘নতুন’ থেকে ‘পরিপক্কতা অর্জন করে।

উপন্যাসিকের আন্তরিকতায় উপন্যাসের পরিণতি আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে প্রথম পত্রোপন্যাস বাঁধন-হারা। উপন্যাস গ্রন্থ ‘বাঁধনহারা’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ১৯২৭ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত উপন্যাসটির উৎসর্গ পত্রে কবি লেখেন-সুর-সুন্দর শ্রীনলিনীকান্ত সরকার করকমলেষু। এ উপন্যাসের চরিত্রে হয়তো কোনো মহৎ শিল্পের রেখাপাত ধরে নির্দিষ্ট পথে পৌঁছার চেষ্টা নেই। অজস্র কথার ভিড়ে, বর্ণনার বাহুল্যে এক-একটি ব্যক্তিত্বের অস্পষ্ট গুঞ্জরণ মাত্র শোনা যায়। তাতে উপন্যাসের রস আস্বাদনে কোনো ব্যাঘাত