নিউজ ডেস্ক : অবহেলিত পাড়ার অবহেলিত সম্প্রদায়ের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এক ছেলে ছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। আজীবন দৈন্যতাকে সঙ্গী করে চলেছেন, তবে দানে ছিলেন অকৃপণ। শত প্রতিকূলতাকে জয় করেছিলেন নিমগ্ন, নিরবচ্ছিন্ন নিরলস সাহিত্য চর্চায়। ব্যক্তি হিসেবেও ছিলেন নির্লোভ অহংকারী। অর্থাভাবে চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ায় বেশিদিন জীবিত না থাকতে পারলেও তাঁর মহৎ কর্ম তাঁকে করেছে অমর। তাইতো জন্মের শত বছর পরেও এখনো মানুষ তাঁকে নিয়ে আলোচনা করেন, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চর্চা করেন। এখনো মানুষ ভাবে অদ্বৈতকে জানার, বোঝার, চর্চা করার, গবেষণা করার আরো অনেক কিছু বাকী রয়েছে। শত বছর পরেও মানুষ তার জন্ম উৎসবে আনন্দে মেতে ওঠে। একজন সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর মেধা, শ্রম ও সৃষ্টি এখনো মানুষের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে।
যে গভীর জীবনবোধ থেকে তিনি মালোপাড়ার মানুষের জীবনাচারণের সুখ-দুঃখের বর্ণনা করেছেন, যে আসীম মমতায় প্রিয় তিতাসের রূপ, বৈচিত্র্য বর্ণনা করেছেন, যে প্রাজ্ঞ দর্শন থেকে তিনি জীবনকে দেখেছেন, যে সাবলীল ভাষায়, বাক্য ও বর্ণ বিন্যাসে তিনি তাঁর ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন, যে নিপুণ কারুকার্যে তিনি সময়কে ধারণ করেছেন- সে সবকিছুই এখনও পাঠক মনে দোলা দিয়ে যায়। তিতাসের ঢেউয়ের দোলার মতোই সে দোলা চির বহমান। হাসি-আনন্দে, উল্লাসে-উৎসবে, প্রেম-রোমাঞ্চ-বিরহে, প্রত্যাশা-প্রাপ্তিতে, সফলতা-ব্যর্থতায়, ঝগড়ায়-বিভাজন ও ঐক্যে, সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতায়, ধর্মে-বর্ণে, ট্রাজিকতায়, দৈন্যতায়-সমৃদ্ধিতে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর এক অনন্য উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’।
এই কালজয়ী ঔপন্যাসিকের নামে ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একদল নিবেদিত প্রাণ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের মেধা ও শ্রমে পরিচালিত হচ্ছে এই অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার পর থেকেই নিয়মিতভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান, অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর স্মৃতি রক্ষা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিকাশ ও প্রসারে নানা কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। একটি সুদূর প্রসারী ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই কখনো ধীর; কখনো দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই প্রাণের প্রতিষ্ঠানটি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও মেলা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিশিষ্ট কবি জনাব মো. আ. কুদদূস মহোদয়। এই কর্মযোদ্ধা মানুষের মহৎ উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও ঘনিষ্ঠ নেতৃত্বে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে কেন্দ্র করে একে একে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার অর্থায়নে মল্লবর্মণ পাড়ার রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। এই রাস্তাটিও নামকরণ করা হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের নামে। সম্প্রতি শেষ হলো অদ্বৈত মল্লবর্মণ মুক্তমঞ্চের নির্মাণ কাজ। গবেষণা কেন্দ্রের মূল অবকাঠামোর প্রায় ৯০ ভাগ কাজ শেষ। বাকি দশ ভাগ আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এছাড়াও এই সংগঠনের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে প্রতি সপ্তাহে মঙ্গল সাহিত্য আড্ডার আয়োজন, ঋতুভিত্তিক সাময়িকী প্রকাশ, লেখক ভ্রমণ। বিভিন্ন দিবস পালনসহ নানান সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আয়োজন করে যাচ্ছে এই সংগঠনটি। গত বছর উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে আয়োজন করা হয় প্রথম অদ্বৈত গ্রন্থ মেলা-২০২৩। অনুষ্ঠানে ২২ টি বইয়ের স্টলে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন সাহিত্য অনুরাগী সংগঠনগুলো। অদ্বৈত এর বংশধর গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ার নানা বয়সী মানুষসহ অত্র অঞ্চলের শত শত লোক উপভোগ করে তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন।
এরই ধারাবাহিকতায় এই বছরও উক্ত গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র দ্বিতীয়বারের মত আয়োজন করতে যাচ্ছে তিনদিনব্যাপী ‘অদ্বৈত গ্রন্থমেলা’। আগামী ২০, ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ অদ্বৈত জন্মভিটা গোকর্ণ ঘাটে অনুষ্ঠেয় এই বইমেলার উদ্বোধন করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি, বরেণ্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। অংশগ্রহণ করবেন দুই বাংলার খ্যাতিমান লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের পরিবেশনায় থাকবে স্বরচিত কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, সংগীত ও নাট্যানুষ্ঠান।
এছাড়াও মেলায় বিশেষ আকর্ষণ অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাহিত্য পুরস্কার প্রদান। গত বছর প্রথম এই পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরব অর্জন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রথিতযশা কবি ও গবেষক জয়দুল হোসেন। এ বছর অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর) পাচ্ছেন লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক শান্তনু কায়সার। তিনি প্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে পরিচিত করে তোলেন। এবং অদ্বৈত গবেষণার তার উন্মোচন করেন। সম্মানজনক এই পুরস্কারে রয়েছে অর্থ মূল্য পঁচিশ হাজার টাকা। সাথে রয়েছে ক্রেস্ট ও সনদপত্র। তিনদিনব্যাপী অদ্বৈত গ্রন্থমেলার শেষ দিন ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার প্রদান করা হবে।
লেখক – মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া