শাহরাস্তি (চাঁদপুর) প্রতিনিধিঃ “নারী ক্ষমতায়ন ও নারীদের স্বাবলম্বী হতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই’ : সুইডেন প্রবাসী সমাজ সেবক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবেদ মনসুর, প্রতষ্ঠাতা, মনুমিয়া-সুলতানা বালিকা এতিমখানা।”
‘দারিদ্রতা বিমোচনের জন্য শিক্ষাই একমাত্র উপায়‘ এমন শ্লোগানের রুপায়নে সমাজের একেবারে পিছিয়ে পড়া বাবা-মা হারা এতিম মেয়েরা পড়ালেখা শিখে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে চাঁদপুরের শাহরাস্তি পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের শ্রীপুর গ্রামের মিয়া বাড়ির মরহুম সৈয়দ মনিরুল ইসলাম(মনু মিয়া) ও সুলতানা বেগম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান সুইডেন প্রবাসী সমাজ সেবক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবেদ মনসুরের সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগে ৩ ভাই ও ৬ বোন মিলে তাদের মরহুম বাবা-মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে বাবা মরহুম সৈয়দ মনিরুল ইসলাম(মনু মিয়া) ও মা সুলতানা বেগমের নামে ‘মনুমিয়া-সুলতানা বালিকা এতিমখানা’ স্থাপন করেন।
এই এতিমখানায় বর্তমানে মোট ৩১জন এতিম মেয়ে শিশু লালিত-পালিত হচ্ছে। এখানে বসবাসরত শিশুদের মধ্যে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিশু রয়েছে। এই এতিমখানায় বসবাসরত শিশুরা স্থানীয় শাহরাস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শাহরাস্তি সরকারি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। এই এতিমখানায় বসবাসরত সকল মেয়েদের থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়ার যাবতীয় ব্যয়, প্রয়োজনীয় পোশাক, চিকিৎসা খরচ, বই-খাতা-কলম এতিমখানা কর্তৃপক্ষ বহন করেন। এতিমখানা কর্তৃপক্ষের একান্ত ইচ্ছা এখানে অবস্থানরত মেয়েরা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা শিখে নিজে স্বাবলম্বী হোক এবং সমাজে পিছিয়েপড়া মেয়েদের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখুক।
পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনুমিয়া-সুলতানা বালিকা এতিমখানার নির্মাণ কাজ ২০১২ সালে শুরু হয়। নির্মাণ কাজ শুরুর ২(দুই)বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৪ সালে এই এতিমখানার যাত্রা শুরু করে । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর, চাঁদপুর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধন লাভ করে, যার নিবন্ধন নম্বর- চাঁদ/৭৪৮/২০১৬, তারিখঃ-২৫/০৪/২০১৬ইং । এই এতিমখানাটি অফিসিয়ালী ২৫/১২/২০১৫ইং তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন সমাজ সেবা মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করেন। অফিসিয়ালী উদ্বোধনকালে এখানে ১২ জন শিশু ভর্তি ছিলেন। উদ্বোধনের পর থেকে অদ্যাবধি অত্র প্রতিষ্ঠানটি বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবেদ মনসুর নিজের ও তাঁর ভাইবোনের আর্থিক অনুদানে পরিচালনা করে আসছেন। শুরু থেকে সেপ্টেম্বর’২০২২ মাস পর্যন্ত দোতলা ভবন নির্মাণ বাবদ ব্যয় ছাড়াই এতিমখানা পরিচালনায় দৈনন্দিন ব্যয় বাবদ প্রায় সোয়া কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অত্র প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক বিবেচিত হওয়ায় জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর, চাঁদপুর হতে শুরুতে ১০ জন এবং বর্তমানে ১৭ জন শিশুর জন্য ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছর থেকে ক্যাপিটেশন গ্রান্ট মঞ্জুর করে এবং প্রতি বছর ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বাবদ =৪,০৮,০০০/- টাকা এককালিন অনুদান পেয়ে আসছে। সরকারি ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বাদে বাদবাকি প্রায় ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা সৈয়দ আবেদ মনসুর ও তার ভাইবোনগন তাদের ব্যক্তিগত তহবিল হতে ব্যয় করে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন।
বর্তমান ভবনে শিশুদের প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা, তাছাড়া চাহিদার তুলনায় এখানে কম শিশু রাখার সুযোগ থাকায় এর ধারণক্ষতা আরও বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় সৈয়দ আবেদ মনসুর ও তার ভাইবোনেরা মিলে বর্তমান স্থানের কাছাকাছি দক্ষিণ পাশে নিজস্ব অর্থায়নে ৭০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ৬২ শতক জায়গা ক্রয় করেন। ক্রয়কৃত জায়গায় ৪ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে নতুন আরও একটি ভবন নির্মাণের কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আপাততঃ নতুন ভবনটি দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে। নতুন ভবনের প্রতি ফ্লোরে ৭ হাজার বর্গফুট হিসাবে মোট ২৮ হাজার বর্গফুটের আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। এই ভবনের নীচতলা এতিমখানার প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হবে। ৪ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক ২ কোটি টাকা। যা আবেদ মনসুর একাই বহন করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মনসুর সাহেব বলেন, সমাজের বিত্তশালী কেউ চাইলে আমার এই উদ্যোগে সামিল হতে পারেন।
এই এতিমখানাটি পরিচালনায় ৯(নয়) সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুমোদিত কার্যনির্বাহী কমিটি রয়েছে। শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট হিসাবে সৈয়দ আবেদ মনসুর এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নাজরানা ইয়াসমিন হীরা দায়িত্ব পালন করে আসছেন। নাজরানা ইয়াসমিন হীরা বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের স্বনামধন্য বেসরকারি সংস্থা `মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ –এর কো-অডিনেটর পদে বর্তমানে কর্মরত আছেন।
৪ ফেব্রুয়ারী শনিবার এই প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়,নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
বিগত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সুইডেন প্রবাসী সত্তরোর্ধ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবেদ মনসুর এর সাথে কথা হয়।কথায় কথায় তিনি তুলে ধরেন পারিবারিক উদ্যোগে ‘মনুমিয়া-সুলতানা বালিকা এতিমখানা’ স্থাপনের আদ্যপ্রান্ত।
জনাব মনসুর জানান, ১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর শ্রীপুর মিয়া বাড়িতে তার জন্ম। তিনি সহ তারা ৩ ভাই ৬ বোন। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়। তন্মধ্যে ২ ভাই ২ বোন সুইডেনে, ২ বোন আমেরিকা, ১ ভাই জাপান প্রবাসী এবং ২ বোন বাংলাদেশে বসবাস করেন। সকল ভাইবোন সুশিক্ষিত ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সৈয়দ আবেদ মনসুর অংশগ্রহন করেছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি চাঁদপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী গনি মডেল স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করেন। কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে সারাদেশ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অপশাসনের প্রতিবাদে দেশ পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সারাদেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ঐ সময় তিনি ২০ বছর বয়সী টগবগে যুবক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি দেশমাতৃকার টানে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সালে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের হাতে ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ করেন তিনি।
অতঃপর বাবা-মায়ের তাগিদে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাসে ভর্তি না হয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজ হতে ১৯৭৩ সালে পাসকোর্স থেকে বি.কম পাস করেন। বি.কম পাসের পর চাকরিতে যাবেন না আরও পড়ালেখা চালিয়ে যাবেন এমন সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ১৯৭৭ সালের শুরুর দিকে তিনি উন্নত জীবন গড়ার উদ্দেশ্যে সুইডেনে পাড়ি জমান। সেই থেকে তিনি সুইডেনে বসবাস করে আসছেন। সুইডেনে অবস্থানকালে তিনি বেসরকারি চাকুরির পাশাপাশি ‘সুইডেনস্থ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার’ এবং একটি সুইডিস বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সুইডিস মুসলিম ফেডারেশন’ -এর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসাবে সংস্থার সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন। তার ভাইবোনদের কেউই গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন না। তারা সকলেই নিজ নিজ কর্মস্থলে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই মরহুম বাবা-মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি সহ তার সকল ভাইবোন মিলে মায়ের ক্রয়কৃত জমিতে ‘মনুমিয়া-সুলতানা বালিকা এতিমখানা’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।
দ্বিতল বিশিষ্ট এতিমখানাটি ঘুরে দেখা যায় পুরো ভবনটি ছবিরমত পরিস্কার। এখানে বসবাসরত শিশুরা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। এই প্রতিষ্ঠানের তত্বাবধায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন শিরীন সুলতানা রীনা। তিনি শিশুদেরকে মায়ের মমতা দিয়ে আগলিয়ে রেখেছেন।
এতিমখানায় বসবাসরত কয়েকজন শিশুর সাথে কথা বলে জানাযায়, তারা অনেক বড় হতে চায়। তাদের কেউ কেউ জানান, তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে বিয়ে করবেন না।
ব্যক্তিগত জীবনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবক সৈয়দ আবেদ মনসুর ২ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তানের জনক। জন্মসূত্রে তারা সকলেই সুইডেনের নাগরিক। তারা সকলেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহন শেষে সুইডেনে কর্মরত আছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরের অভিপ্রায় এই এতিমখানাটির কার্যক্রম যেন তার অবর্তমানে বন্ধ না হযে পড়ে সেজন্য তিনি একটি তহবিলের ব্যবস্থা করে রেখে যাবেন। তার স্বপ্ন মরহুম বাবা-মায়ের নামে স্থাপিত এতিমখানাটি চারতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে পার্থিব জীবনের ইতি টানতে পারলেই তিনি নিজেকে সফল ও স্বার্থক মানুষ বলে মনে করবেন।
তিনি আশাবাদি, তার অবর্তমানে এতিমখানার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে কেউ না কেউ এর হাল ধরবেন।
যোগাযোগের ঠিকানা : মনুমিয়া-সুলতানা এতিমখানা
গ্রাম-শ্রীপুর, শাহরাস্তি পৌরসভা, ৬ নং ওয়ার্ড, শাহরাস্তি, চাঁদপুর-৩৬২০।
মোবাইল নম্বরঃ ০১৭১৪১৬৬৯৫১
e-mail address : monumiaorphanage63@gmail.com