প্রকৃতির একটি নিজস্বতা আছে। সে নিজের মতো করে তার কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়। এই বেড়াতে গিয়ে যেখানে যখন যেমন প্রয়োজন সেখানে তেমন পোশাক পড়ে আবির্ভূত হয়। শরীর থেকে রঙ ছড়ায়। সে রঙ নানান রঙ। নানান তার বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির এই মনের বদল, শরীরের বদল, ভাবের বদল, প্রভাবের বদলই ঋতু। ঋতু আবার খুব খেয়ালি গ্রাম্যকিশোরী। কাকন হাতে, নূপুর পায়ে, চুলে বেণী গেঁথে মেঠোপথ ধরে চপল পায়ে দৌড়ে চলে। চঞ্চল তার গতিবেগ। নিটোল তার হাবভাব। ভাবের পালে বাতাস দোলায় তার মনের মতো। নাগরদোলার মতো দুলে দুলে ঘুরতে থাকে। আনন্দময়ীর আনন্দগীত যেন ছিটে ছিটে পড়ে বিন্দু বিন্দু শিশির ফোঁটার মতো। যেখানেই পড়ে সেখানেই ছড়িয়ে যায় আলতো করে, আর রুপার বর্ণের মতো একটা রঙ হেসে ওঠে ঠিক শিশুর হাসি যেমন। কখনো এই হাসি অট্টহাসি, কখনো এই হাসি মুচকি, কখনো এই হাসি রোদেল হাসির মতো সোনা-রঙ-ধরা। নগর পথেও বালকের মতো তারে দেখা যায়। বাউণ্ডুলে মেজাজে। আবেশ পাওয়া গেলেও তার মনের বিধি ধরা কঠিন। শান্ত, নিরিবিলি, চুপচাপ কোনক্ষণে হয়তো ধরা যায়, আবার ধরা যায় না। এ বালকের চোখ, মুখ, শরীর দেখে সঠিক বোঝাও যায় না এখন প্রকৃতির কোন কাল। তবে ভজনরূপী প্রকৃতি-প্রেমিক মাত্রই সূর্যের গাও দেখে, তাপের মাত্রা বুঝে, বুঝে যায় কোন খেলা খেলিছে মাঠে প্রকৃতির দীক্ষিত মনন।
বাংলা ষড়ঋতুর আলাদা আলাদা ধরন। গ্রীষ্মে যেমন সবুজের সমারোহে যৌবনোদ্দীপ্ত থাকে, প্রকৃতির সর্বশরীর, বর্ষায় ভিজে ওঠে আপাদমস্তক। শীতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে চারপাশ, ত্বকের ফাটলে প্রাণপায় নিঃসাড়তা। মৃদুমন্দ বইতে থাকে বাতাস। বসন্তে তার উল্টো। উলঙ্গ গাছের ডালের বাকল-মুখ ভেদ করে উঁকি দেয় নবজীবন। গায়ের ছলম বদলিয়ে প্রাণের নৃত্য চলে প্রকৃতির জগৎজুড়ে। জীর্ণ-শীর্ণ মরা-ধরা দখিনা বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে যেন গত জনম থেকে ফিরে আসে। এভাবেই চলে ঋতুচক্র। ভূগোল বুঝে ঋতুর চলনে তারতম্য কিছু হয় না যে, তা নয়। আমাদের ঋতুরা এমনই।
এই যে হেমন্তকাল, আকাশ নিটোল নীল। কোথাও কোথাও কোদালি মেঘ, কোথাও সাদা ভেলা, কোনো মেঘ নেই একআনা, কোনো ভার নেই, গর্জন নেই, বিজলি নেই, গোমড়া মুখ করে বসে থাকা নেই, থেমে থাকা নেই, যেন হাতের কাছেই কাচ-স্বচ্ছ তুলো, যেন মই বেয়ে একটু উপরে উঠলেই হাতে ধরা যাবে, এ তো হেমন্তেরই গুণ। এ গুণ কারও সঙ্গে মেলে না। না গ্রীষ্মের সঙ্গে, না বর্ষার সঙ্গে। হেমন্তের রূপ-গুণ কিঞ্চিৎ মিল খায় শরতের সঙ্গে, আর কিঞ্চিৎ মিলে শীতের সঙ্গে। শরতের শেষে বায় হেমন্ত, হেমন্তের অন্তে শীত বলে দুই ঋতুকেই ছুঁয়ে দেখে এই ঋতু। কেউ কেউ বলেন, শরৎ আর শীতের সেতুবন্ধ হেমন্ত।
ষড়ঋতুর এ দেশে শরৎ শেষে আসে হেমন্ত। মধ্য দুপুরের রোদের তেজ কমে পৌঢ়ের চিন্তির, শান্ত, ধীর পায়ের বিকেল নামে। বিকেলে উত্তর থেকে তিরতির করে আসে বাতাস। বাতাসের গায়ে সামান্য হিম। টানটান শরীরে চটচট অনুভূতি। ঠোঁট ফাটার চিনচিন ব্যথা। সন্ধ্যা আসতেই চকচক কৃষ্ণকলির বদলে একটা নেতানো কালো জেঁকে বসে। পাতায় জমা ধুলোর মতো চারপাশটা মলিন ময়লা বদনে ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়। ভেজা ভেজা একটা কুয়াশা-চাদর মুড়িয়ে যায় নিবিড়ভাবে। পথের মানুষরা কাজের ফিরিস্তি ফেলে চায়ের দোকানে আড্ডায় বসতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে অধিক। গভীর গ্রামে কৃষাণিরা গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে গৃহকাজে মন দেয়। দিনের আলো সংক্ষেপিত হওয়ায় প্রাকরাতে সেরে নেয় আরো কিছু হাতের কাজ। বালক-বালিকারা সেন্টু-গেঞ্জি ছেড়ে নামায় ফুলহাতা জামা। সন্ধ্যা বাড়ে, রাত ঘনায়, বৃক্ষের পাতা বেয়ে টিনের চালে টপটপ করে পড়ে শিশির, শব্দ হয়। কুয়াশা ঘন হয়। শিশির জমে মাঠের ঘাসে। শীতের অনুষঙ্গরা দেখা দেয় ধীরে ধীরে। হেমন্ত শীতের পূর্ব ঋতু। পূর্বাভাস দেখা দেবে এটাই সত্য, স্বাভাবিক। সে স্বাভাবিকতায় প্রকৃতিজুড়ে নমনীয় একটা রূপ জেগে ওঠে ভিন্ন রূপে। যে রূপ শরতের নেই, যে রূপ বর্ষার নেই, যে রূপ গ্রীষ্মের নেই, যে রূপ বসন্তের নেই, যে রূপ শীতের নেই। হেমন্তের রূপ স্বতন্ত্র। অরূপ এক রূপ। প্রশান্তির রূপ। ভাদ্রের কাঠফাটা রোদের অতিষ্ঠতার শেষে হালকা হিমের নরম এক রূপ। শান্তির এক রূপ। হিমঝুড়ি ফুলের এক রূপ। এই রূপকে লিখে, মুখে বলে, ছবির ফ্রেমে দেখিয়ে, চিত্রের পটে এঁকে, নাট্যের বর্ণনায় ব্যাখ্যা করা যায় না। বলা যায় না। সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় না। কী কবিতায়, কী গল্পে, কী উপন্যাসে, কী নাটকে, কী সিনেমায় তুলে ধরে তুলে আনা যায় না। হেমন্তের সেই ধানের জমির সৌন্দর্য, সেদ্ধ ধানের রূপ, প্রথম ভাতের গন্ধ। হেমন্তের শরীর দেখতে হলে কাঁচা-মাটির দেশে যেতে হবে। পাড়া-গাঁয়ে যেতে হবে। যেখানে এখনো পিচের ছোঁয়া লাগেনি সেই পথে যেতে হবে। আজানেরও আগে ঘুম ভেঙে বিস্তীর্ণ মাঠে নামতে হবে। খালি পায়ে চলতে হবে। হাতের কাছেই কুয়াশার দেয়াল, দুহাতে সরিয়ে সরিয়ে সামনে বাড়তে হবে। মুখে, শরীরে জলের ভেজা ভেজা শিশির, চোখের পাতায় জমা ছোট্ট জলকণা, কয়েক পা পরেই কিছু দেখা যায় না। ঘাসের মাথায় বড় ফোঁটা, পা পিছলে যায়, হোঁচট খায়, অনেক সময় বোঝা যায় না এ কি শীত না হেমন্ত? এমনই এক পারত্রিক সৌন্দর্য হেমন্তজুড়ে। যে অভাগা কাঁচের শার্সিতে ঘেরা শহর ভেন্যুতে জন্ম নিল, পাকা রাস্তায় বেড়ে ওঠে বড় হলো, পিৎজা ও বার্গারে পুরে নিল পেটের ক্ষুধা সে জানে না এই বাংলায় কী রূপ নামে ঋতু-হেমন্তের পর্বে পর্বে। সে জানে না হেমন্তের আঙুলে কোন্ রমণীয় বিভা খেলা করে অলৌকিক ভঙ্গিমায়। যে অভাগার সময় কাটে আধুনিক ইলেকট্রনিকস মেকিতায় সে জানে না কী আনন্দ ফেলে যাচ্ছে তুচ্ছ অবহেলায়, কী রূপ থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে নিজেরই আবেগে, অবজ্ঞায়। জানবেও না কোনো দিন। যারা না জানে, না জানতে চায়, বঙ্গমৌলিকতা তার জন্য পথ চায় না। ঋতু বসে থাকে না কোনো দুর্ভাগার কপালে চুমু আঁকতে। হেমন্তও না।
কাত্তিকা তারার নামে কার্তিক, আর্দ্রা তারার নামে অগ্রহায়ণ এই দুই মাসে হেমনস্ত ঋতুর বসবাস বিধায় প্রকৃতির নিয়ম ধারায় এই দুই মাসে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক চিত্র ভেসে ওঠে। হেমন্তকে মূলত ধানের ঋতু হিসেবে গণ্য করা হয়। গ্রামবাংলার জনপদে ধানের মৌসুম হিসেনেই একে ধরে নেওয়া হয় আজও। আউশ-আমন ধান এ ঋতুর প্রধান ফসল। কার্তিকে এ ধানে সোনার রং লাগে, অগ্রহায়ণে কেটে বাড়ি তোলা হয়। অঞ্চলভেদে কিছুটা আগপিছ হলেও এ সময়েই ঘরে তোলা হয় নতুন ধান। উঠানে শুকিয়ে, সেদ্ধ করে ভাত রান্নাকে কেন্দ্র করে হিমকন্যার হেমন্তে বসে নবান্ন। উৎসবে উৎসবে মেতে ওঠে সারা বাংলা। পিঠা পায়েশ, মিঠা মন্ড ইত্যাদিতে ভরে ওঠে হাটবাজার, ঘর গেরস্থালি। কন্যা আসে বাপের বাড়ি, নাইয়র হয়। জামাই আদরে প্রতিটি ঘর জমে ওঠে অতিথি আপ্যায়নে। ঘরে ঘরে আনন্দযজ্ঞ। খাবার আসে, নতুন জামা আসে, কৃষক হাসে, কৃষাণি শাড়ি পরে, সব নতুন লাগে চাররঙা ঘুড়ির মতো। গোলায় ধান হাসে, মাঠে শান্তির বাতাস বয়ে যায়। নিশ্চিন্তের বাঁশি বাজে খেতের আলে। সারা বছরের হিসাব মিটিয়ে কৃষক যখন নির্ভার হয়, তার বুক থেকে যখন নেমে যায় জাগতিক গণিতের ভার, তখন তাকে যে কী সুন্দর দেখায় তা হেমন্ত জানে, হেমন্তের যে কী রঙ হয়। গোলাপি পোলাপি, বাদাম বাদাম, স্বচ্ছ জলের মতো চকচক তা অঘ্রাণ জানে। খোলা মাঠে মাঠে, উঁচু জমিতে, বাজার কেন্দ্রে কেন্দ্রে বসে সুখের মেলা। সে মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে ফেরিওয়ালা আসে। যার যার পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে। ক্রেতা আসে সে বাজারে, ফেরিওয়ালার কাছে, কথায় কথায় কত কী যে বেচাকিনি হয়। কত কত আনন্দের ডিঙি যে সাজে সে মেলাতে। নাগরদোলা, শখের চুড়ি, মিষ্টি দোকান, লাল ফিতা, কাকন বালা, রাঙা চশমা কী থাকে না সেখানে! ঘরের মেয়েরা দল বেঁধে মেলায় যায়, বাইস্কোপ দেখে, ফিতা কেনে, বধূরা জা’র সঙ্গে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ঘুরে আসে দেবর-ভাসুরের চোখ আড়াল করে। ছেলেরা নামে কাবাডি খেলায়, সাঁতার খেলায়, গরুর দৌড় খেলায়। কাজের ভার কম থাকায় আনন্দ আর আনন্দ, কে দেখে সে সুখের বাঁশি। উঠানে উঠানে পুঁথি পাঠ, যাত্রাপালা, কিচ্ছার মজমা হরেক পালা বসে চাঁদের আলোয়। শিশু-বৃদ্ধ-কিশোররা সে পালায় অংশ নেয়। উল্লাস উচ্ছ্বাস ভাগ করে নেয় সবাই সমান ভাগে। যদিও গ্রাম ক্রমে নগরে পরিবর্তিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে তবু এর ছাপ দেখা যায় অনেক গ্রামেই। নগর পার্শ্ব গ্রামে এ চল উঠে গেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছুটা বাকি আছে এখনো। এখনো তারা হেমন্তকে ধানের ঋতু বলে প্রার্থনা করে। উৎসব করে। পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করে। এ চিত্র গ্রামের চিরদিনের হলেও মফস্বল থেকে শহরেও এ আচার-অনুষ্ঠান চোখে পড়ে অন্য আঙ্গিকে। চিরায়ত এ ছবি দেখা যায় ফাঁকে ফাঁকে বোনা। শহরের মানুষরা ধানের সঙ্গে শেকড়ে বাঁধা নয় বলে তারা জানে না কখন ধানের ঋতু, কখন কাশের ঋতু, কখন বর্ষার ঋতু, কখন জাগরণের ঋতু। তারা কেউ কেউ সময়কে তপস্যা না করলেও সংবাদ শুনে প্রস্তুত হয়, সাজে, সে মতে বেড়াতে বের হয়, আয়োজনে নাচে, গান গায়, কবিতা পড়ে, গল্প শোনে, টিভিতে কথা বলে, মনের অজান্তে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছার আবেগ প্রকাশ করে। জীবন-জীবিকার ব্যস্ততায় তারা হয়তো মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়তে পারে না। তারা হয়তো আউশ ধানের গন্ধে মাতাল হতে পারে না। তারা হয়তো আমন ধানের ফিন্নি পাকায় না। কিন্তু তারা কুয়াশায় ভেজা ঘাসে হাঁটতে চায়। তারা হেমন্তকে ডেকে বাড়ির ছাদে চাঁদের রাতে প্রিয় মানুষের সঙ্গে চা খেতে বসতে চায়। দিন তারিখ মাস তারা ভুলে গেলেও জানালায় জল লাগলে তারা বুঝে শীত আসছে। শেষ রাতে বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ করে দিতে হলে তারা বুঝে হেমন্তের আগমনবার্তা। গায়ের লোশন পাল্টাতে হলে তারা জেনে যায় এখন ঋতুতে হিম। অলিগলি বা প্রাণকেন্দের নবান্ন উৎসবে যাওয়ার প্রস্তুতি তারা নেয়, সেখানে তাদের সন্তানকে হেমন্ত চেনাতে পিঠা পায়েশ খাওয়ায়, মঞ্চের সামনে বসে কোলের শিশুটিকে বা কিশোর সন্তানকে জানায় তার জানা ঋতুভিত্তিক কিছু কথা। এ দৃশ্যগুলো আমরা অন্য ঋতুর সঙ্গে হেমন্তেও দেখি। এটা বাংলার চিরায়ত রূপ। সেই যে ধানের জমি, নাড়া পোড়া আবার এই যে বকুল তলায় বসে মেকি হেমন্ত সাজিয়ে প্রাণহীন নবান্ন আয়োজন এও হেমন্ত ঋতুর বৈশিষ্ট্য। বাংলার বৈশিষ্ট্য। একে আমরা কোনোভাবেই বাদ দিতে পারব না। সরিয়ে দিতে পারব না। পারব না বলেই একেও বলি হেমন্তের রূপবিভার এক অনিন্দ প্রকাশ।
ধানের ঋতু, সে নয় একমাত্র পরিচয়। ফুল ফলেও হেমন্ত অন্য ঋতুর চেয়ে আরেক অঙ্গ শৈলীতে সাজে। তার রয়েছে আপন বৈশিষ্ট্য। ঋতুভিত্তিক বৈশিষ্ট্য, যা অন্যের থেকে আলাদা। যা হেমন্তকে চিহ্নিত করে নিজস্বতায়। বকফুল, ছাতিম, রাজ অশোক, শিউলি, কামিনী, মল্লিকাসহ আরো কত যে নাম না জানা সতেজ ফুলের গন্ধে ভরে হেমন্ত তা অনুচ্চারিত। ফলে তাকেও চেনা যায় তার মতো করে। সজিব ফসলে ভরে ওঠে মাঠ। টাটকা সবজিতে সবুজ হাসি হাসে খোলা প্রান্তর। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুদ্ধতার পরিবেশ। পরিম-ল। দীর্ঘ বেঁচে থাকার আহ্বান। বাতাসে জীর্ণতা, ধুলায় মলিনতা, গায়ে গতরে বার্ধক্যের রেখা দেখা গেলেও বসবাসে খুব নাতিশীতোষ্ণতায় একটা প্রাণ যেন জেগে ওঠে ক্লান্তিময়তায়। ঝরঝরা এক ভাব যেন অবয়বে। ক্ষুদ্র দিনের আকাশ মেঘমুক্ত এক বিছানা, আধো সাদা মেঘ কোদালি ঢঙে ভেসে বেড়ায় তাদের ছন্দে। কোথাও থাকে, কোথাও থামে না। শীতের মতোই ধীর লয়ে চলে। রোদের কোমলতায় মেঘও মিশে থাকে ঊর্ধ্ব আকাশে। এই ঋতুতে কোনো গাঁয়ে হালকা কাঁপন দিয়ে শীত নামে আবার কোনো কোনো গাঁয়ে ভারী কুয়াশা ঘিরে থাকে জমির উদ্যান। যেখানে বৃক্ষের সমাগম, যেখানে লতাপাতার জঙ্গল, যেখানে ঘাসের জমিন, যেখানে খোলা প্রান্তর, যেখানে খালি মাঠ, যেখানে সবুজের আধার সেখানে হেমন্তের সত্যি রূপ দেখা যায় মন ভরে। সেখানে হেমন্তচিত্র নামে আসল রূপ নিয়ে। নগরায়ণে এ ঋতু শুধু নয়, কোনো ঋতুর চিত্রই ধরা দেয় না। বেলা-অবেলায় কিছুটা আঁচ করা যায় মাত্র।
নগরের নাল ছেড়ে গ্রামে ঘুরে এলাম; কতদিন পর। কতদিন পর শুরুর কার্তিকে কয়েকটি দিন হা করে হাওয়ায় মেলেছি মুখ, আলে গিয়ে নিজ চোখে দেখেছি ধানের সোনালি ভার। ধানের ডগায় ডগায় ফুলে আছে ধানের ছড়া, কৃষকের ঘরে ওঠার অপেক্ষায় অধীর ধানের মন। বাতাসে দুলে দুলে কৃষাণীর হাতে ওঠার আগাম আনন্দ যেন হাসছে ধানের ক্ষেতে। সকালে কাঁচা রোদ, মিষ্টি আমেজ ছড়িয়ে বিলি করছে সতেজতা। রোদও যেন কাঁচা সোনারঙা, চিকচিক করছে আয়নার মতো। তাকালেই ভরে ওঠে নয়নযুগল। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে হেমন্ত রোদের আদিগন্ত দিকে। দুপুর বেলার আল কাত হলে শান্ত শীতের ছোঁয়া হালকা যেন ছুঁয়ে গেছে গা ঘেঁষে। আর বেলা হলে হেমন্তটা ধরা পড়েছে পুরো। হেমন্তে শীতের আগমন টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার পরে। বিদ্যুৎ পাখার বাতাস শিহরণ জাগায়, মাঝরাতে সুইচ টিপে বন্ধ করতে হয় ফ্যান। ভোরে পাখির ডাকে ঘর ছেড়ে দেখেছি কুয়াশার আবির, দূরে জমে আছে সাদা রঙ। আহা, খালি পায়ে কত দিন পর হেঁটে দেখেছি ঘাসের গা থেকে শিশির লেগে পা ভেজা। আমি বলি, এর নামই তো হেমন্ত। ঋতুকন্যার বরণ এমনই তো হয়।
শহরে যদিও অতটা আগে বোঝার জো নেই। রোদ কড়া হলে ঘুম ভাঙে এখানের মানুষের, তারা বোঝে না মিষ্টি রোদের স্পর্শ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের অফিস ঘরে শহুরেরা বুঝতেই পারে না কখন শীত, কখন গরম, কখন নাতিশীতোষ্ণ ঋতুর আগমন-নির্গমন। তারা পত্রিকার পাতায়, টিভির স্ক্রিনে, বাংলা উৎসব-পার্বণের খবরে বোঝে এখন এই ঋতু, ওই ঋতু। তাতে তাদের কিছুই যায়-আসে না। যেমন- হেমন্তে কৃষক ধান তোলে ঘরে, আশ্বিনে রান্ধে কার্তিকে খায়- বছরের আয় আসে তার ধান বিক্রি করে, কৃষাণীর জন্য বানায় নাকছাবি, শোধ করে পুরনো ঋণ, নবান্ন উৎসব হলে তাদের আনন্দের মিলে সুযোগ, এ বাড়ি ও বাড়ি একটু বেড়াতে পারে। তারপরও কিছু নাগরিক খোঁজ রাখে হেমন্তের। হেমন্তে তারা নেচে ওঠে আত্ম-আনন্দে। প্রকৃতির শোভা ভোগ করে উজিয়ে ওঠে আপনের ভেতর।
নয়ন আছে, যাদের তারা দেখে হেমন্তের অপরূপ রূপের বৈভব। তারা উপভোগ করে হেমন্তের সংস্কৃতি। তারা আপন মনে গেয়ে ওঠে হৈমন্তী গীত। তারা রাতের আকাশে তাঁরার দূর চলনে নির্মেঘের সজ্জায় অভিভূত হয়, চাঁদের নির্ভার জোছনায় বিস্ময় প্রকাশ করে, মৃদু শীতল বাতাসে শরৎ তাপ থেকে উঠে এসে ফেলে শান্তির নিঃশ্বাস। হেমন্তের আরাম তারা মেখে নেয় চোখে-মুখে-বুকে। যদিও শহরে হেমন্তের প্রকৃত রূপ দেখা যায় না, হেমন্ত এখানে নিজেকে খোলার সুযোগ পায় না; কিন্তু গভীর গ্রামে এখনো হেমন্ত ধানের শোভায়, গানের শোভায়, উৎসবের শোভায়, পার্বণের শোভায়, নবান্নের শোভায় ফুটে ওঠে আধেক। কেননা সভ্যতার বিবর্তনে, কালপরিক্রমায়, নগরায়নের তুমুল প্রতিযোগিতায়, বৈশ্বিক পোড়েন ঋতুর মায়াবি মুখ এখন চোখে পড়ে না। পড়ে না হেমন্তের পূর্ণ আবিরও। সব ঋতুই এখন আসে কিছুটা আগে, নয় তো কিছুটা পরে। সর্বত্র অসময়ের অশনি! রূপের রঙের বিভাবরিতে অনেক মলিন। একদা হেমন্ত ছিল ভরা যৌবনা। টলটলা। যখন ধানের, গমের, কৃষি উত্তাল প্রকৃতি ছিল এই মহাদেশে, ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতার করাল থাবার বাহিরে। এখন হেমন্ত গাঁথা আছে কবির ভাষায়। সাহিত্যিকের রচনায়। বর্ণনায়। হেমন্তের রঙে বিমুগ্ধ হয়ে বাংলার অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক তাদের কবিতায় লিখেছেন রূপের রসের পঙ্ক্তিমালা। যেমন দেখেছেন তেমন তুলেছেন কথায়।
সাহিত্যের প্রচীন যুগ বৌদ্ধ সহজিয়ায় রচিত চর্যাপদে হেমন্তের বর্ণনা নেই মোটেই। কোনো ঋতুর নেই প্রাচীনে। মধ্যযুগের কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম হয়ে বৈষ্ণব পদাবলি ছুঁয়ে, গোবিন্দ দাস পেরিয়ে আধুনিক কালের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ কালের কবিকুল থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে ছাড়িয়ে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক এবং সময়ের তরুণতম কবির হাতে রচিত হয়েছে হেমন্তের কবিতা, যে সাহিত্য সে বর্ণনায় তাকালে দেখা যাবে হেমন্ত ঋতুর মধু আর মাধুর্যতার ক্ষয়িষ্ণু ধারা। তারপরও কি হেমন্ত উদযাপিত হয় না এদেশে! এখনো হেমন্তে ধান ওঠে কম-বেশি। এখনো পিঠাপুলির ধুম পড়ে ঘরে ঘরে। হেমন্ত মেলা বসে গঞ্জে, ঘাটে। সড়কে, মোড়ে। এখনো হেমন্তের অবশিষ্ট আমেজ দেখা যায় প্রকৃতির মাঝে।
হেমন্তে সামান্য শিশির পড়ে শেষ রাতে, পাতা ভেজে গায়ে গায়ে, পথ ভেজে; গা শির শির করে। কাঁথাটা টেনে নিতে হয় কোমরঅবধি। সকালে রোদ চিকচিক করে সোনার মতো। দুপুর গড়ালে সূর্যটা ক্লান্ত হয় তেজে। বিকেলে সন্ধ্যা নামে আগে, দীর্ঘ হতে শুরু করে রাত। বাতাসে আরাম আরাম বোধ হয়। না শীত, না গরম। প্রকৃতির দিকে চোখ মেললে দেখা যায় অবারিত ফসলের ভরা মাঠ। কিছুটা শীতঘোর তার রঙে- শীতের যেন হাতছানি হেমন্তজুড়ে। হয়তো মানুষের আগ্রহ কমেছে ঋতুর বৈচিত্র্যে, প্রয়োজন কমেছে ঋতুভিত্তিক কর্মে; নাগরিক মস্তিষ্ক, নগর ইট-কাঠ, কারখানা, নগদ অর্থ ভুলিয়েছে ঋতুর রীতি-নীতি, দরকার তথাপিও প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে, সূচি মাফিক নিয়ে আসে ঋতুর এক এক পর্ব, ধাপে ধাপে বদলায় তার বৈশিষ্ট্য- এর থেকে বদলানো যাবে না, যতই বদল হয় সভ্যতা, বদল হই আমরা।
ঋতুর খোঁজ রাখি বা না রাখি, হেমন্তের খোঁজও রাখি বা না রাখি আরও আরও বহুকাল হেমন্ত আসবে, আকাশে-মাটিতে তার খেলা খেলবে; একান্ত আপন শ্রী নিয়ে ফুটে উঠবে হৈমন্তী উল্লাস। দুঃখ শুধু এই, ঋতুর জৌলুস থেকে বঞ্চিত আমরা, প্রকৃতির প্রতি আমাদেরই অধিক অনাচার হেতু।
আদিত্ব্য কামাল,ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক- জনতার খবর।