
উপন্যাসটি খুব যত্ন সহকারে উপন্যাসিক পাঠকের নিকট উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথমেই বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। মলাটে প্যাছানো যে দৃশ্যটি আঁকা হয়েছে এর মাহাত্ম্য হলো যুবতী ষোড়শী তম্বী যৌবনা তারা এক সময়ে মাথার উপর চুলের সাথে জড়িয়ে রূপ চর্চা করে থাকে। বনের লতাপাতা ফুল মিশানো সৌন্দর্য মণ্ডিত দৃশ্য মাথার উপর সত্যই এক অবাক করার বিষয়। সুতরাং বইয়ের প্রচ্ছদ গল্পের সাথে মিল আছে।
পাঠ আলোচনা করার সময় যা ধরা পড়লো তা এখানে আলোচনা করতেই চলে এসে পরম পূজনীয় বাবা মায়ের ইচ্ছে অনুসারেই শুভ বিবাহের কাজ সুসম্পন্ন হলো। দুঃখের আকর যেখানে জায়গা করে নেয় সেখানে সুখ পাখির অবস্থা ভাল না। লেখক সুখের ঘরে একটি দুঃখের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। আর গল্পে কি রহস্য বিদ্যমান পাঠক হিসেবে তা জানার জন্যে অতি আগ্রহের সাথে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়তে হচ্ছে। যে মেয়েটি বউ সে তমা। সে এক আদর্শ নারী। তমা নামের স্ত্রীকে স্বামী তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং তালাকনামা তার ঘরে এসেছে। এ বিষয়ে তমার কোনো ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
শ্বশুর বাড়ি থাকার বড় ইচ্ছে ছিল তমার। কিন্তু স্বামী একা শহরের বাসা বাড়িতে থাকার কারণেই তাকে স্বামী সেবা করার জন্যে বাসা বাড়িতে আসতে হলো। মধ্যের সময়টাতে সুচিত্রা নামের মেয়ের সাথে এক জটিল বিষয় এনে লেখক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো যা কাহারো কাম্য ছিল না। এখানে পাঠককে এক উদ্ভূত রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে দিলো যে কারণে গল্প জমেছে বেশ ভালো। আর পাঠক মনোনিবেশে পড়তে লাগলো।
সুহাস তমার মধ্যে কোনো গড়মিল আছে এমনটা কেহ বলতে পারবেনা। সুচিত্রা নামের একটি মেয়ের সাথে সুহাস এর পাঁচ বছর যাবৎ গভীর পরিচয় ও প্রণয় চলছে খু্ব সন্তর্পণে। একসময় সুচিত্রার বিবাহ হয়ে গেল তবুও সুচিত্রার প্রেমময় মুখচ্ছবি আর একবার দেখার ইচ্ছে হচ্ছে সুহাসের। উদগ্র আকুতি নিয়ে রমনা পার্কে বসা হয়তো এপথে যাবে এমন সময় চিন্তন মনের মানুষটির নিকট এক কিশোরী ফুল বিক্রি করতে আসে। তার সাথে কথা বলতে বলতে সুচিত্রার কথা মন থেকে হারিয়ে গেছে। তবে কি সুচিত্রা নামের মেয়ের প্রণয় কি ভুলা যাবে? কখনো তা সম্ভব না।
লেখকের প্রেম খেলার ঢেউ এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে মা বাবার দান তমাকে হারাতে হবে, কারণে তমা নামের তালাক পত্রটি এই বাসার ঠিকানায় এবং এ বাসাতেই এসেছে। এক বিড়ম্বনা অবস্থা চলছে দুই জনের মধ্যে। এ সময় লেখক গল্পে সুহাসের মা বাবাকে উক্ত বাসাতে বেড়ানোর জন্যে নিয়ে আসেন, যা পাঠক মহলকে এক চিত্তাকর্ষক সময় পার করাচ্ছে।
ভয়ের লজ্জার বিষয় চলছে এই অবস্থায় মা-বাবা বাসায়। ইজ্জত রক্ষার নিমিত্তে তমা এই নিষ্ঠুরতাকে বুকে চেপে ধারণ করেই বাসার সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিয়োগান্ত ঘটনা তবু লেখক বুঝিয়ে দিলেন, এখন পর্যন্ত সুখের সংসার এতে কোনো আপদ বিপদ নাই।
তমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে এমন ভাবে যেন বিধাতা দেখে অন্য কেহ দেখেনা। কচুপাতার পানি যেমন গড়িয়ে পড়ে কেহ দেখেনা ঠিক তেমনি হৃদয় ক্ষরণের জল চোখ থেকে গড়িয়ে হরদম পড়তেছে কেহ দেখেনা। বাসায় তমাকে রেখে লেখক গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন।
যাকে হারিয়ে দিতে চাচ্ছে সে এখন নানান কারণে চোখের কোণে ভেসে থাকে— তাকে কোনোক্রমেই সরানো যাচ্ছে না। বরং মধুর স্মৃতি হয়ে মস্তিষ্কে ভেসে বেড়াচ্ছে। তমার নিকট ফেরত আসার চেষ্টা তদবির চলছে খুব জুড়ে সুড়ে।
বিপদ কাটিয়ে উঠতে যখন প্রাণপন চেষ্টা করা হচ্ছে। তমার শরীর ভাল না তবুও তমার নিকট গিয়ে বসা এবং একটু একটু কথা বলার চেষ্টা করা তখনই বুঝতে বাকি রইলো না তমাকে হারানো যাবেনা। চলছে খেলা মধুর হওয়ায় বিভোরে ঠিক এ সময়ে সুচিত্রা নামের মেয়েকে লেখক বাসায় নিয়ে আসেন। তমা অসুস্থ চোখ খুলে দেখেছে এ দৃশ্যটি যেন বারুদের মাঝে দিয়াশলাই এর আগুন জ্বলে উঠলো। হায় হায়, এখন কি হবে! বিপদের মাঝে আরেক বিপদ উপস্থিত।
সুহাসের মনোমন্দিরে কত লহড়ি হৃদয় তন্ত্রের সাথে বাজনা বাজিয়ে চলছে— শেষপর্যন্ত তমাকে বুঝিয়ে বললে হয়তো সে বুঝবে। ভাবনার তালে সে থাকুক এই ফাঁকে অসুস্থ শরীর নিয়েই তমা বাসা ত্যাগ করতে বাধ্য হলো। স্বামী জানেনা কখন সে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। জানারই বা দরকার কি, তমাকে তো আগেই তালাক লেটার দিয়ে রেখেছে। যদিও লেটারটি খোলা হয়নি কিন্তু জানার বাকি রইলো না ততক্ষণে তমা জেনে গেছে।
মায়ের মোবাইল কল আসছে, কৌশল মঙ্গল কামনা করা হওয়ার পর তমার মুখের বাণী শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সুহাসের মা জননী। তমা তখন বাসা ত্যাগী বউ বাবার বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছ। এই মুহূর্তে মাকে নানাহ কথা বলে মোবাইল কল রেখে দিয়ে ভাবনার সাগরে ভাসছে সুহাস।
তমাকে বাসায় রেখে লেখক গল্পের কাহিনি আরো বেশি জোড়ালো করছেন। কচু পাতার জলের সাথে তুলনা করেছেন লেখক। কচু পাতার জল গড়িয়ে পড়লে যেমন কচু পাতায় দাগ পড়ে না তেমনি তমার চোখের জল কি ভাবে কোনো সময় গড়িয়ে পড়ছে কেহ দেখে না। তমার হৃদয় ক্ষরণের জল কত কঠিন অবস্থায় আছে একমাত্র সে ছাড়া কেহ জানেনা এবং অনুভব করতে পারে না।
এতদিন যাকে হারিয়ে যেতে চাচ্ছিল, এখন তাকে পাওয়ার জন্যে সে হণ্যে হয়ে ঘুরছে। তমা তার চোখের কোণায় ভেসে থাকে। তার স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে সরানো যাচ্ছে না। তাকে তার চায়।
সুহাসে মনোমন্দিরে কত লহরির উটানামা হচ্ছে এই মুহূর্তে একমাত্র সেই জানে। একটি ফাঁকে তমা ঘর ছেড়েছে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে। এর আগে সে মনে এত আঘাত পায় নি। যে তালাক লেটার এসেছিল সেটি এখনও তাদের টেবিলের উপর। সুহাস জানেনা কখন সে বাসা ছাড়া হলো। জানার কি দরকার। মায়ের কানে মুখের কল ছিলো তমার কথা শুনতে কিন্তু কতরকমের তাল বাহানা করতে হলো এই মুহুর্তে। মা বলেছিলেন, তমা ভালো মেয়ে, তার প্রতি যেন লক্ষ্য রাখা হয়।
তমা বাসায় নেই উপরন্তু তার শরীর খারাপ, সুচিত্রা এসেছে বাসায়, মা কানে মুখে কল দিয়ে তমাকে খুঁজছিলো। অর্থাৎ এক টর্নেডো ঝঞ্ঝা চলছে সুহাসের বাসা বাড়িতে।
সুহাস তমার বাবার বাড়িতে যাচ্ছে যেভাবেই হোক তমাকে বুঝি ফিরাতে হবে। তমাদের বাড়ির দারোয়ান সে সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে আমি পারবো এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে। তার বাড়ি চাপাইনবাবগঞ্জ, মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লেখার সীমানা। মনে কত আনচান, হৃদয়ে ধব ধব আওয়াজ অসহ্য লাগছে। তবু তাকে চাই বলে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে নানান কথা বলে শ্বশুর শ্বাশুড়ির মন রক্ষা। পরে তমার সাথে কথা বলাতে নমনীয়, তমা বুঝতে পারছে বলেই কাজটা সহজে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হলো। প্রেম ভাব জমে উঠেছে, মনের কালিমা দূর হলো ।
সুহাস তমার নিকট হতে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে সময় বললো কানে মুখে কথা হবে। বাইক স্টার্ট করা মুহূর্তে তমা বাইকের পেছনে উঠে বসেছে মাত্র। এ সময় সুহাস তাকে বলে উঠলো আরে তমা এখন অফিসের সময়। এতে কি হয়েছে আমি যাবই। তাহলে পোশাক পরিধান করে এসো। আমি পোশাক পরিধান করবো তবে নতুন যা তুমি কিনে দিবে। বাবা মাকে এতদিন বুঝিয়ে রেখেছে যে তার সন্তান হবে যে কারণে তাকে অন্যত্র বিবাহ দিতে পারে নাই। লেখক বুঝাতে ইহাই চেয়েছেন মনে করি।
কিন্তু এখানে লেখক তাড়াহুড়ো করতে গেলো কেন? মা বাবার সাথে তমাকে কথা বলানো দরকার ছিলো বলে মন করি। উভয়ের বাবা-মা এর মধ্যে কথা বলাবলির দরকার ছিলো বলে মনে করি।
শেষ দিকে তমাকে দেখে সুহাসের তৃপ্তি মিটছে না।দৃস্টি নন্দন চাহনি বিস্তর কাহিনির জাল হৃদয় তন্ত্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবু যেন আরো দেখিবার মনে চায়। লেখক দেখিয়ে দিচ্ছেন সৃষ্টির সৃষ্টিতে নয়নের দৃষ্টিতে সে অন্যন্যা। এক ললনা তার তুলনা সে নিজেই।
অবশেষে তাদের কুলসিত মনের সব অসুবিধা চিরতরে শ্মশানের চিতার অনলে পুড়িয়ে ছাই ভস্ম করলো, এতোদিনের সব দুঃখ গ্লানি পুড়ে ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেলো দিগন্ত কিনারে। তারা এখন সুখে আছে।
চৌষট্টি পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি ভালো অফসেট কাগজের পাতা চার ফর্মার বইটি একটি স্বার্থক উপন্যাস হয়েছে বলে আমি মনে করি। সবচেয়ে বড় কথা হলো উপন্যাস লেখক বইটি তার মা-বাবাকে উৎসর্গ করেছেন, যাহা সকল স্তরের কাম্য হতে পারে।
মূল্য দুই শত টাকার মধ্যে নামিয়ে আনতে সচেষ্ট হবেন বলে মনে করি। সব্যসাচী, একুশ বইমেলা ২০২৪, প্রকাশক শতাব্দী ভব, ৩৩ কাওরান বাজার, ঢাকা।
লেখক : আবুল কাসেম তালুকদার
সভাপতিঃ সাহিত্য ভুবন ও সাহিত্য ভুবন গ্রন্থাগার।
কালীকচ্ছ সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।