ইটালির শরণার্থী নীতির সফলতা ও ব্যর্থতা

প্রবাসী খবর, 10 January 2022, 349 বার পড়া হয়েছে,

২০১৩ সালে বিপুল অভিবাসী সমুদ্রপথে ইটালির লাম্পেডুসা দ্বীপে পৌঁছান৷ প্রতিক্রিয়ায় অভিবাসীদের জন্য দ্রুত নতুন একটি নীতি গ্রহণ করে ইটালির সরকার৷ প্রায় এক দশক হতে চললেও অনিয়মিত পথে আসা অভিবাসীদের প্রশ্নে পরীক্ষামূলক সেই নীতিতেই আটকে আছে দেশটি৷ সেটি কতটা সফল আর কতটা ব্যর্থ, আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে ইটালি সরকারের মনোভাব কেমন, তা খতিয়ে দেখেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস৷

চলতি বছর প্রায় ৬৬ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী ইটালিতে পা রাখেন৷ এই মানুষগুলো যাত্রা করেছেন লিবিয়া, টিউনিশিয়া, গ্রিস বা তুরস্ক হয়ে৷ তাদের সবার পথ এসে মিলেছে ইটালির কোন না কোন উপকূলে৷ আট বছর আগেও চিত্রটা এমনই ছিল, যখন কয়েক হাজার মানুষ এসে লাম্পেডুসার সৈকতে নেমেছিলেন৷ সে সময় পরিস্থিতি সামলাতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য একটি জরুরি নীতি গ্রহণ করেছিল সরকার৷ আট বছর পর তার ফলাফল মিশ্র৷ দেশটিতে পা রাখা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রহণে যে মডেলটি সরকার নিয়েছিল সেটি এখনও জাতীয় শরণার্থী নীতিতে উল্লেখ করার মতো কৌশল হয়ে ওঠেনি, নিজেদের সবশেষ প্রতিবেদনে এমনটাই উল্লেখ করেছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ফনডাৎসিওনে মাইগ্রান্তেস৷ তাদের মতে কিছু জরুরি পদক্ষেপকে সরকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে যার মাধ্যমে বড় ধরনের স্ববিরোধিতা তৈরি হয়েছে৷

অন্যদিকে মিলানভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আএসপিআই এর গবেষক আলডো লিগা বলেন, ‘‘প্রচুর অভিবাসীর আগমন ঘটলেও, আসলে পরিস্থিতির কোনো বদল হয়নি৷ ২০১৩ সালে ইটালি অপ্রস্তুত ছিল এবং যতটা সম্ভব সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোন সরকার অভিবাসীদের কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তা নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো লক্ষ্য বা সুদৃঢ় কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা কেউ হাজির করেনি৷

অভিবাসীদের লিবিয়ায় আটকে রাখা

অভিবাসীদের জায়গা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বদলে তাদেরকে সীমান্তের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন অনেকে৷ ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনে ইটালি লিবিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করে৷ চুক্তি অনুযায়ী, লিবিয়ার কোস্ট গার্ডকে আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয় ইটালি৷ বিনিময়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া অভিবাসীদের ঠেকাবে তারা৷ ২০১৯ সালে এই চুক্তির মেয়াদ আরো তিনি বছর বৃদ্ধি করে দুই পক্ষ৷

এই চুক্তির সফলতা বর্ণনা করে ২০১৯ সালে ইটালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইগি ডি মায়ো সংসদে বলেন, ‘‘কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে এর ফলে এক লাখ ৭০ হাজার (২০১৬ সালে আসা অভিবাসী) থেকে সংখ্যাটি মাত্র দুই বছরে দুই হাজার ২০০ তে নেমে এসেছে৷’’ প্রকৃতপক্ষে ২০১৯ সালে ১১ হাজার ৪৩৯ অভিবাসী ইটালিকে এসেছেন, যা ২০১৮ সালের অর্ধেক৷

ইউরোপ অভিমুখে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকাতে লিবিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ইটালি৷ ছবিতে ত্রিপোলির পশ্চিমে লিবিয়া উপকূল থেকে আটক অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি দলকে দেখা যাচ্ছে৷

অভিবাসীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ) এর সদস্য মার্কো বেরটট্টো মনে করেন এই কৌশলে প্রয়োগ করে মূলত অভিবাসীদের লিবিয়ার জেলে ‘পৃথিবীর নরকে’ পাঠিয়েছে ইটালি৷ ‘‘ইটালির সরকার বলছে তারা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চায়৷ কিন্তু বাস্তবতা হল তারা ফেরত পাঠানো আর আটকের চিরস্থায়ী নীতি নিয়ে চলছে৷

অন্যদিকে লিগার প্রশ্ন, ‘ইটালির মাটিতে অভিবাসীদের আগমনের সংখ্যা সীমিত করা গেছে, কিন্তু কিসের বিনিময়ে? এর ফলে ভূমধ্যসাগরে মৃত্যু ও ভোগান্তি আরো বেড়েছে৷ গত বছর লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা সাড়ে ৩১ হাজার অভিবাসীকে সমুদ্র পাড়ি দিতে বাধা দিয়ে দেশটির আটক কেন্দ্রগুলোতে বন্দি করেছে৷

আশ্রয়প্রার্থনা নীতির পরিবর্তন

কট্টর ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত মাত্তিও সালভিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদায়ের পর দায়িত্ব পেয়েছেন লুসিয়ানা ল্যামোরগিজ৷ তার নিয়োগের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছেন অভিবাসী অধিকারকর্মীরা৷ লিগা বলেন, ‘‘তার পূর্বসূরি খুব সফলভাবে অভিবাসীদের গ্রহণ প্রক্রিয়াটি ধ্বংস করতে সমর্থ্য হয়েছেন৷ নতুন মন্ত্রী একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন না এটা স্বস্তির বিষয়৷

ভূমধ্যসাগরের দুয়ার বন্ধ করে দেয়ার নীতি থেকে সরে এসে ল্যামোরগিজ বেশি ঝুঁকিতে থাকা অভিবাসীদের জন্য মানবিক সুরক্ষানীতি গ্রহণ করেছেন৷ অনিয়মিত পথে ইটালি আসা কোন অভিবাসী আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পাওয়ার শর্তগুলো পূরণ না করলেও তাকে বসবাসের অনুমতি দেওয়ার একটি ব্যবস্থা চালু করেন তিনি, যার প্রশংসা করছে অভিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো৷

কিন্তু অভিবাসীদের নিয়মিতকরণের এই ব্যবস্থাটি কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে অনেকেই এর আওতায় আসতে ব্যর্থ হন৷ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার ২৪১ জন এই ব্যবস্থার আওতায় ইটালিতে থাকার অনুমতি পেয়েছেন, যা মোট আবেদনের ১১ শতাংশ মাত্র৷ অন্যদিকে সব ধরনের সুরক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন ৮১ শতাংশ আবেদনকারী৷

২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত ইটালিতে বিভিন্ন সুরক্ষানীতির আওতায় থাকা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল মোট এক লাখ ২৮ হাজার৷ এর অর্থ দেশটিতে বসবাসকারী প্রতি এক হাজার জনে মাত্র দুইজনের কিছু বেশি শরণার্থী আছেন৷ এই সংখ্যা ফ্রান্স ও জার্মানির চেয়ে অনেক কম৷ ফ্রান্সে প্রতি হাজারে সাতজন ও জার্মানিতে ১৪ জন বা সুইডেনে ২৫ জন শরণার্থী সুবিধা পেয়ে আসছেন৷

অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ‘ট্রানজিট’ দেশ

পরিস্থিতির রাতারাতি পরিবর্তন ঘটনো সম্ভব হচ্ছে না লুসিয়ানা ল্যামোরগিজের পক্ষেও৷ গবেষক লিগা বলেন, ‘‘দ্রাঘি সরকারের কাছ থেকে চাপের কারণে ল্যামোরগিজের খুব বেশি কৌশল প্রয়োগের সুযোগ নেই৷ এখনও অভিবাসীদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইস্যুটি অধিকতর গুরুত্ব পায়৷ আমরা কেবল নিপীড়নের পর্যায়কে এক ধাপ কমাতে পেরেছি৷ যেমন, মানবিক কাজে নিয়োজিত জাহাজাগুলোর জন্য এখন আর শাস্তিমূলক আটকের বিধান নেই৷ কিন্তু তারপরও প্রায়ই তারা প্রশাসনিক আটকের সম্মুখিন হচ্ছে৷

মানবিক কারণে অভিবাসীদের নিজ থেকে আশ্রয় দেয়ার ঘটনা ইটালিতে এখনও বেশ বিরল৷ তবে ব্যতিক্রমও আছে৷ তালেবানের হাতে কাবুল পতনের পর দেশটি চার হাজার ৮৯০ জন আফগানকে নিয়ে আসে৷ ফনডাৎসিওনে মাইগ্রান্তেস এর মতে এই ঘটনা প্রমাণ করে ইটালি এখন যা করছে তার চেয়ে বেশি কিছু করার জন্য তার যথেষ্ট ‘সক্ষমতা ও সম্পদ আছে’৷

অন্যদিকে লিগা মনে করেন ইটালি অভিবাসীদের নিয়মতান্ত্রিক গন্তব্যের চেয়েও মূলত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুক অভিবাসীদের কাছে ‘ট্রানজিট দেশ’ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে৷ ‘‘পরিবর্তনশীল নীতির কারণে অভিবাসীরা ইটালিতে থিতু হতে পারেন না৷ তাদের বেশিরভাগ তাই সঙ্গত কারণে এখানে অবস্থান করেন না,’’ বলেন তিনি৷