ওহি(সত্য কবিতা) ঐশী বাণী ও এক প্রকার শক্তি। শক্তির সঞ্চারে গতির সঞ্চার। হাদিস থেকে জানা যায়,ওহি নাজেলের প্রাগমুহূর্তে মুহাম্মদ(সাঃ) অস্থির হয়ে পড়তেন, কেঁপে কেঁপে ওঠতেন। জ্বরগ্রস্তের মতো কম্বল জড়াতেন তাঁর পবিত্র দেহে।
আরবের জাহেলিয়াত যুগে ওহির কার্যকর ভূমিকা সম্পর্কে নজরুল ছিলেন ওয়াকেবহাল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, উপনিবেশ বঙ্গ-ভারতের পরাধীন জাতির মধ্যে জাগরণ ঘটাতে হবে। একরাতে ঠিক তাই করলেন।
“ক্কুল হু আল্লাহ হু আহাদ”
-বলো>বল (হে নবী) আল্লাহ এক। ওহির প্রকরণে ক্বুল শব্দের সফল প্রয়োগ করে লিখলেন-
‘বল বীর’।
কোরআনে একই আয়াত বা আয়াতাংশ একাধিক সূরায় আছে। একই আয়াত একই সূরায় একাধিকবার আছে।
সূরা আর রাহমান- এ ‘ফাবি আইয়্যি আলা-ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’- এই আয়াতটি ৩৩ বার আছে।[ -(তাঁর/স্রষ্টার) কোন কোন নিয়ামতকে (নিদর্শনকে) অস্বীকার করবে?] বারবার বহুবার এ জিজ্ঞাসা-বাক্যের তাৎপর্য হল- স্রষ্টার কোনো নিদর্শনকেই অস্বীকার করা যায় না। প্রভুর দয়া ও দান অনস্বীকার্য- এই চেতনাই পাঠকের মানসচেতনায় ভিত্তিভূমি হয়ে ওঠে। এ বাকশৈলীও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় অনুসৃত। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় ১৩৯ (১৪১ টি লাইন) টি পঙক্তি রয়েছে। বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়।
✪ কবিতায় ‘বল বীর’ শব্দদ্বয় যা চেতনাগুচ্ছ বা বিশ্বাসবন্ধন তৈরি করে- তা ৬ বার রয়েছে।
✪ ‘বল’ শব্দটি ৮ বার এবং
✪ ‘উন্নত মম শির’ ৬ বার ও
✪ ‘চির উন্নত শির’ উদ্দীপক শব্দবন্ধ রয়েছে ৬ বার।
✪‘আমি’ শব্দটি রয়েছে ১৩৭ বার।
এই আমি কবি নজরুলের ব্যক্তি আমিত্ব নয়। এই আমি- পরাধীন জাতির প্রত্যেকের একদেহে লীন জাতি- আমি। নিখিল বাঙালির বিশ্ব- আমি। ওহির অনুকরণে প্রযুক্ত এ ভঙ্গিটি সফল হয়েছে।
বিদ্রোহী কবিতায় ‘আমি’-র একাধিক ব্যবহার অনেকে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার কথা স্মরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ এই কবিতায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এর অনুরণনও লক্ষ্য করেছেন।
মেরাজের রাতে সিদরাতুল মুনতাহা নামক মোকাম পর্যন্ত ফেরেশতা জিব্রাইল যেতে পেরেছিল। কিন্তু মুহাম্মদ থামেননি। আরশ পর্যন্ত পৌঁছেন। আমাদের নজরুলের মহামিও তাই।
তিনি বলেন, ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ!’ তাই তার বাধা নেই। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছেড়ে, ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদ করে, অনেক ক্ষুদ্র আমি এর ঐক্যের অখণ্ড আমি। যা কোরআনের আয়াতে কথিত আমি কিংবা আমরা অর্থে সেই পরম আমি।
বিদ্রোহী কবিতায় বারবার ‘বল বীর’ কিংবা ১৩৭ বার ‘আমি’ আদতে কোরআনের ‘ইক্বরা’ অর্থাৎ পাঠ কর; কিংবা ‘ক্বুল’ অর্থাৎ বল ধরনের আজ্ঞা ও কর্তৃবাচ্যের বাগপ্রতিমা। যা অব্যর্থ ভাবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে জাতির জাগরণে। কবি জানতেন যে, কোরআনে ৮২ বার সালাতের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বহুবার বলা হয়েছে জাকাতের কথা। শুধু হতচেতন আদম সন্তানকে সচেতন আদম হয়ে ওঠার জন্য। ওহির এই কোরানীয় স্টাইলটি কাব্য প্রকরণে ব্যবহারের দৃষ্টান্তে নজরুল একক, অভূতপূর্ব ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
➤কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছেঃ
বিদ্রোহী’ কবিতাটি যেনো হিন্দু-মুসলিম পুরাণ বা মিথ প্রয়োগের এক জাদুঘর। এখানে হিন্দু-পুরাণের যেমন সার্থক ব্যবহার আছে, তেমনি আছে ইসলামি ঐতিহ্যের অভ্রান্ত অনুসরণ। রূপকার্থে বা প্রতীকার্থে পৌরাণিক এক-একটা চরিত্রের মধ্যদিয়ে কবি তাঁর ভাবনার জাল বুনেছেন। কবিতার ছত্রে ছত্রে আকাশভরা তারার মত পৌরাণিক , গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ছড়াছড়ি।
১। ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর।
২। মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)
৩। ‘আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড। আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র শিষ্য আমি দাবানল-দাহ দাহন করিব বিশ্ব।’ (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা)।
যেমন: ভূলােক মানে পৃথিবী, দ্যুলােক মানে স্বর্গ, আর গােলক মানে বিষ্ণুলােক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান। কৃষ্ণ রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত।
ঋগ্বেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মতাে ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন, ইনি ব্রহ্মার পুত্রাতার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী। মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়।
পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। প্রজা কল্যাণার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।
চেঙ্গিস খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গােত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গােত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গােত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মােঙ্গল গােত্রদের একীভূত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।
ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ:) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন