বাইরে লোহার ফটক বন্ধ। র্যাবের ঝোলানো তালাও অক্ষত। কিন্তু ভেতর থেকে জুয়া খেলার সব উপকরণ উধাও হয়ে গেছে। খবর যুগান্তর
এভাবে একটি-দুটি নয়, অন্তত ১০টি ক্লাবের ভেতরের অবস্থা একই। শুধু ক্যাসিনো-সামগ্রী নয়, ক্লাবের চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
বাথরুমের কমোড, বেসিন এবং মেঝের টাইলস তুলে নেওয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত কক্ষগুলো ইতোমধ্যে পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আস্তানায়। ফলে দেশ কাঁপানো সেই ক্যাসিনো অভিযান বড় এক প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর জব্দকৃত গুরুত্বপূর্ণ আলামত সুরক্ষা করতে না পারলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
তবে কেন, কী কারণে, কাদের অবহেলায় গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত এভাবে উধাও হয়ে গেল, তা নিয়ে যুগান্তরের কাছে দায়িত্বশীল কেউই মুখ খুলতে চাননি।
এদিকে ক্যাসিনো মামলার সব আলামত খোয়া যাওয়ার ঘটনা অফিশিয়ালি পুলিশ অবহিত নয়। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পাশে থাকা মতিঝিল থানা পুলিশও ঘুণাক্ষরে চুরির বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি।
তবে থানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন আরাফাতের সাফ জবাব ছিল, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।’
এদিকে ক্লাব কর্মকর্তারা বলছেন, ক্লাব থেকে এভাবে সবকিছু খোয়া যাওয়ার বিষয়ে জিডি করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। পর্যবেক্ষক মহল বলছে, এত বড় ঘটনা নিয়ে এই যখন অবস্থা, তখন চোর বেচারা আছে বড় বেকায়দায়। সব দোষ এখন চোরের। আসলে এমন দুঃসাহসিক ঘটনা কারা করল, সংঘবদ্ধ চোরচক্র, না পেশাদার দুর্বৃত্ত কিংবা অন্য কেউ-তা এখন তদন্তসাপেক্ষ বিষয়।
অভ্যন্তরে সরেজমিন : বুধবার বেলা ১২টা। রাজধানীর ফকিরাপুলে ঐতিহ্যবাহী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সামনে হাজির হয় যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম। মতিঝিল থানার সীমানাপ্রাচীর লাগোয়া ক্লাবটি ক্যাসিনো-কাণ্ডে বন্ধ হয়ে যায় আড়াই বছর আগে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর।
অভিযানের পর ভেতরের ক্যাসিনো আলামত জব্দ দেখিয়ে প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেয় র্যাব। সেই থেকে প্রধান ফটক এখনো বন্ধ। তবে পাশের একটি সরু সিঁড়ি দিয়ে গোপনে ভেতরে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সিঁড়িতে পা রাখতেই স্থানীয় কয়েকজন যুবক এসে বাধা দেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা আরও কঠোর অবস্থান নেন। সাফ জানিয়ে দেন, ভেতরে যাওয়া যাবে না। একপর্যায়ে পুলিশের স্থানীয় এক সোর্সকে ম্যানেজ করে ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়।
দেখা যায়, দোতলায় ৫/৬টি কক্ষ। একটি পরিত্যক্ত কক্ষে ঘুমিয়েছিলেন ক্লাবের সাবেক কর্মচারী মোস্তফা। দরজায় টোকা দিতেই বেরিয়ে আসেন তিনি। বলেন, ‘ক্লাবের প্রায় সব সরঞ্জাম চুরি হয়ে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই। চোরদের অনেকে সংঘবদ্ধভাবে গভীর রাতে এসে ঢোকে। বাধা দিতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। মাঝেমধ্যেই আমাকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় চোরচক্র। এ কারণে প্রতিবাদ বা বাধা দেওয়ার সাহস এখন আমার নেই।’
চারদিক ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ কক্ষের দরজা-জানালা পর্যন্ত নেই। মেঝেতে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। ইলেকট্রিকের তার, সুইচ, এমনকি বাথরুমগুলো থেকে কমোড পর্যন্ত খুলে নেওয়া হয়েছে। খুবলে তোলা হয়েছে মেঝের টাইলস।
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মূল ক্যাসিনো নিচতলায়, টিনের চাল দিয়ে তৈরি অস্থায়ী হলঘরে। দোতলা থেকে সেখানে যাওয়া যায় আরেকটি সরু সিঁড়ি দিয়ে। হলঘরটি অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঢোকার মুখে দুটি ক্যাসিনো টেবিল পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ঘরময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অসংখ্য তাস, জুয়া খেলার চিপস, কয়েকটি পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট সাইজ ছবি। দেওয়ালে একসময় লাগানো সুসজ্জিত পেপার ছিঁড়ে গেছে। মেঝেতে পাতা কার্পেট আবর্জনায় ঢাকা।
ভেঙে পড়েছে ক্যাশ কাউন্টার, ওয়েটিং রুমের কাঠামো। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য ফেনসিডিলের বোতল। এখানে-সেখানে ছড়ানো ইয়াবাসেবনের উপকরণ। উৎকট গন্ধে সেখানে বেশিক্ষণ টিকে থাকাও কষ্টকর।
আরামবাগ ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও র্যাবের তালা ঝুলছে। তবে ভবনের পূর্বপাশ দিয়ে যাতায়াত করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ক্লাবের দোতলার একটি কক্ষে অফিস স্টাফ শাহদাত হোসেনের দেখা পাওয়া যায়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ক্লাবের অবস্থা ভালো নয়। র্যাবের অভিযানের পর কার্যক্রম বন্ধ। পাহারা দেওয়ার পরও বিভিন্ন কক্ষ থেকে এসি, টিভি চুরি হয়ে গেছে। ক্যাসিনো হিসাবে ব্যবহৃত হলঘরের কোনো সামগ্রী এখন অবশিষ্ট নেই। সবই নিয়ে গেছে চোরের দল।
ভিক্টোরিয়া ক্লাবের প্রধান ফটকেও তালা। লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে সেই বিশাল ক্যাসিনো হলঘরটি দেখা যায়, যা একসময় ছিল আলো ঝলমলে। জাঁকজমকপূর্ণ। বর্তমানে হলঘর খালি। র্যাবের জব্দ ক্যাসিনো-সামগ্রীর সবই চুরি হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত ক্লাবের অভ্যন্তরে অনেকটাই ভূতুড়ে পরিবেশ।
দিলকুশা ক্লাবের লোহার ফটক বন্ধ এবং তালায় জং ধরে গেছে। ভেতরে গজিয়েছে আগাছা। কয়েক দফায় ক্যাসিনো-সামগ্রী চুরির পর হলঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ফলে দিলকুশা এখন অনেকটাই পোড়ো বাড়িতে রূপ নিয়েছে।
পাশেই মোহামেডান ক্লাব। ক্যাসিনো অংশ বন্ধ থাকলেও মোহামেডানের অফিস চালু রয়েছে। পরিচালকদের কেউ কেউ আসছেন নিয়মিত। টিম গঠন, নতুন ফুটবল ক্যাম্প আয়োজনের কথা ভাবছেন সংগঠকরা। কর্মকর্তারা জানান, ক্লাবের অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে সেখানে ক্যাসিনো বসায় বহিরাগতরা। র্যাবের অভিযানের পর থেকে অডিটোরিয়ামের গেট বন্ধ। তবে ভেতর থেকে ক্যাসিনোর সাজসরঞ্জাম সবই চুরি হয়ে গেছে। পেছনের দেওয়াল কেটে দুর্বৃত্তরা নিয়ে গেছে সবই। ঘটনার পর ক্লাবের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় অভিযোগ জানানো হয়। কিন্তু লিখিতভাবে ‘জিডি’ (সাধারণ ডায়েরি) নিতে রাজি হয়নি পুলিশ।
বুধবার দুপুরে ক্লাবের একটি কক্ষে বসে ছিলেন পরিচালক জামাল রানা। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ক্লাবের ক্যাসিনো ব্যবসার বদনাম কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন তারা। তবে একমাত্র অডিটোরিয়ামটি বন্ধ থাকায় আয় উপার্জনের পথ বন্ধ। তালা খোলার জন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার করলেও র্যাবের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না। এছাড়া ফকিরাপুল ইয়াংম্যানস, ওয়ারী, দিলকুশা এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব থেকেও ক্যাসিনোর সাজসরঞ্জাম গায়েব হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি ক্লাবেই ক্রীড়া সংক্রান্ত কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির হয়ে আছে।
জব্দতালিকায় যা ছিল : আদালতে দাখিলকৃত র্যাবের জব্দতালিকা অনুযায়ী প্রায় প্রতিটি ক্লাবে ছিল জুয়ার বিশেষ ধরনের বোর্ড, চিপস, কার্ড, কয়েনসহ বহুবিধ সামগ্রী-যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এছাড়া ক্লাবের অভ্যন্তর ছিল সুসজ্জিত। অনেকটা জলসা ঘরের মতো রাজকীয় কায়দায় সাজানো হয় মূল ক্যাসিনো হল।
মেঝেতে দামি কার্পেট, সিলিংয়ে বহু মূল্যবান ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে চোখ ধাঁধানো বিলাসী উপকরণে ছিল ঠাঁসা। প্রায় প্রতিটি ক্লাবে বিপুল অঙ্কের নগদ টাকা রাখার জন্য বিশালকারের ডিজিটাল লকার বা সিন্দুক, বিনোদনের জন্য মাল্টিমিডিয়া সাউন্ড সিস্টেম, বিগ সাইজের অনেক ওয়াল টিভি।
ছিল অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। কেবল মূল হলঘরেই ছিল তিন থেকে পাঁচ টনের ১০/১২টি এসি। এছাড়া ফ্রিজ, ওভেন, আধুনিক রান্নার উপকরণ এবং সিলিং ফ্যান। এছাড়া বেশ কয়েকটি ক্লাবে বসানো হয় জুয়ায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক রুলেট ও স্লট মেশিন। ছিল নগদ টাকা এবং মূল্যবান মোবাইল ফোন। সব মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্যাসিনো-সামগ্রী ছিল ক্লাবগুলোয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ফকিরাপুল ক্লাবপাড়ার অন্তত ৬টি ক্লাবের দূরত্ব মতিঝিল থানা থেকে সর্বোচ্চ ১০ গজের মধ্যে। অভিযানের পর প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে র্যাবের পক্ষ থেকে স্থানীয় থানার কাছে চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। অথচ রাতারাতি প্রায় সব ক্লাব থেকে ক্যাসিনো সরঞ্জাম হাওয়া হয়ে গেছে। ক্লাবগুলোর দরজা-জানালা খুলে নিলেও কিছুই টের পায়নি পুলিশ। ঘটনার বিষয়ে জানতে বুধবার বেলা দেড়টায় মতিঝিল থানায় গেলে ওসি ইয়াসিন আরাফাত বিরক্ত হন। জানান, এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাচ্ছেন না। এছাড়া ক্লাবের ক্যাসিনো-সামগ্রী চুরির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মতিঝিল জোনের উপকমিশনার আব্দুল আহাদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ক্লাব থেকে ক্যাসিনো-সামগ্রী যদি চুরি হয়ে থাকে তবে তা হয়েছে আমার যোগদানের আগে। আমি যোগদানের পর এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তবে আমি ক্যাসিনোর বিষয়ে সতর্ক থাকতে মাঠপর্যায়ে কর্মরত সব পুলিশ সদস্যের কাছে বিশেষ বার্তা দিয়েছি।’
ক্যাসিনো হোতারা কে কোথায় : ক্যাসিনো গডফাদার হিসাবে পরিচিত বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী ওরফে সম্রাটসহ যুবলীগ নেতা আরমান ও খালেদ কারাবন্দি।
তবে বেশির ভাগ আসামি এখনো পলাতক। কেউ কেউ জামিনে মুক্ত। অভিযানের পর থেকেই পলাতক ক্যাসিনো জগতের অন্যতম মাফিয়া মতিঝিলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আরামবাগ ক্লাবের ক্যাসিনো গডফাদার সাঈদ কাউন্সিলরের ভাতিজা ফটিক, সুমন এবং যুবলীগ নেতা জামাল দীর্ঘদিন পলাতক থাকলেও বর্তমানে এলাকায় ফিরে এসেছেন।
ইয়াংম্যানসে ক্যাসিনো আয়োজক যুবলীগ নেতা বকুল ওরফে বরিশালের বকুল এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের ক্যাসিনো হোতা আলী মিয়াকে গ্রেফতার করা যায়নি। তারা এখন প্রকাশ্যে ঘুরছেন। ওয়ান্ডারার্সের অন্যতম ক্যাসিনো আয়োজক মোবারক এবং করিম ফের ক্লাবপাড়ায় ফিরেছেন। গোপীবাগে নিজের বাসাতেই থাকছেন মোবারক। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সঙ্গে জড়িত দুই নেপালি নাগরিক বাবা এবং কৃষ্ণা অভিযান চলাকালেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। উত্তরা এলাকার ক্যাসিনো হোতা কামালকে যুবলীগের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেখা যাচ্ছে। এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চলাফেরা করছেন তিনি।
এছাড়া ক্যাসিনো মামলার আসামি যুবলীগ নেতা ইমরান ও জাকির দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে আছেন। ক্যাসিনো-কাণ্ডে নাম জড়িয়ে যায় বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার।
এদের মধ্যে একমাত্র শাস্তিমূলক বদলির শিকার হন রমনা এলাকার ক্ষমতাধর সাবেক এডিসি শিবলি নোমান। তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হয়।
সংঘবদ্ধ চোরচক্র : অনুসন্ধানে জানা যায়, মতিঝিল এলাকার একাধিক সংঘবদ্ধ চোরচক্র ক্যাসিনো-সামগ্রী চুরির সঙ্গে জড়িত।
তাদের বেশ কয়েকজনের সন্ধান পায় যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম। কেউ কেউ স্থানীয় থানা পুলিশের সোর্স হিসাবেও কাজ করেন। চুরির সঙ্গে জড়িত হিসাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তারা হলেন : সুমন ওরফে বাঙালি সুমন, সজিব, হাসান, মামুন, রিপন, লাভলু, আকবর, বশির, সালাউদ্দিন মোল্লা ও মোস্তফা।
তাদের মধ্যে বাঙালি সুমন, আকবরসহ বেশ কয়েকজন মতিঝিল এলাকার সাইফুল হত্যা মামলায় সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন।