বুড়ো ছেলেটি আর আমাকে আব্বা বলে ডাকে না -আমির হোসেন

জনতার কন্ঠ, 12 September 2025, 31 বার পড়া হয়েছে,
আজ ১৩ সেপ্টেম্বর-এড. আব্দুস সামাদ এঁর মৃত্যুবার্ষিকী
প্রাচীন কালের কিরাতাস এরপর ত্রিপুরা তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা এবং বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে গৌরবান্বিত এই জেলা। অনাদিকাল থেকে এসব অঙ্গন বিভিন্ন আলোকিত কীর্তিমান মানবের সৃষ্টিশীল কর্মে সমৃদ্ধ হয়েছে। কালজয়ী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুরোধা এই জেলাতে জন্ম নিয়েছেন বিপুল সংখ্যক শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সুরের ভুবনে এক চিরঞ্জিব সাধক পুরুষ সুর স¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সেই কৃর্তিমান পুরুষ বাবু উল্লাসকর দত্ত, অবিভক্ত বাংলার এসেম্বিলিতে বাংলা ভাষার প্রথম দাবি উত্থাপনকারী শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কংগ্রেস নেতা ব্যরিস্টার এ রসুল, দানবীর মহেশ ভট্টাচার্য, তিতাস একটি নদীর নাম নামক কালজয়ী উপন্যাসের লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণসহ আরও অনেক প্রতিভাবান বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, যাঁরা তাঁদের অকৃত্রিম কৃতিত্ব ও প্রতিভার শাণিত ইন্দ্রজালে উজ্জীবিত করে ললাটে ধারণ করেছেন কিংবদন্তির তিলক। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বসিয়েছেন গর্বিত জননীর স্বর্ণ আসনে।
তাঁদের একজন প্রয়াত ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ। আমাদের শ্রদ্ধেয় সামাদ চাচা। কত অভিধায় অভিসিক্ত করবো তাঁকে। ভাষাসৈনিক, লেখক, প্রবন্ধিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী এরকম অসংখ্য অবিধায় অবিসিক্ত করে যার গুণাবলি শেষ করা যাবে না। তাঁর বৈচিত্রময় কর্মকান্ড ও বর্ণাঢ্য জীবনাতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি নিজ জেলার সীমানা অতিক্রম করে জাতীয় পর্যায়ে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই মহান গুণী মানুষটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যক্তিত্ব, ভাষাসৈনিক, বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রবীণ সংগঠক, জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি, আলহাজ্ব অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ।
আলহাজ্ব অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তাঁর জীবদ্দশায় দেশ ও জাতির জন্য অনন্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি ১৯৩১ সালের ১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী আমীর হোসেন মৃধা। তাঁর পিতার নাম আর আমার নাম এক বলে তিনি আমাকে আদর করে আব্বা বলে ডাকতেন। এবং বিষয়টি আমাদের শিল্প-সাহিত্য মহলের অনেকের কাছে পরিচিতি পেয়েছিল। তাঁর বাসায় গেলেও তিনি হাকডাক দিতেন-এই আমার আব্বা আসছে। একটু চা-বিস্কুট দাও।
অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং মহান ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেফতার হন। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মাওলানা ভাসানীসহ জাতীয় নেতাদের সান্নিধ্যে থেকে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি পাকিস্তান ন্যাপের জাতীয় পরিষদ সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ এর গণঅভূত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইরাক ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইংল্যান্ড এবং ২০০১-২০০২ সালে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি সফর করেন। তিনি হজ্বব্রতও পালন করেন। তিনি একাধিকবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাউন ক্লাব, পাবলিক লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ, সাহিত্য একাডেমি, উদীচীর উপদেষ্টা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক কমিটি, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ দেওয়ান মাহবুব আলী স্মৃতি পরিষদ, জেলা নাটাব এর সভাপতি ছিলেন। তাঁর লেখা একাধিক ভ্রমণকাহিনিসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে “আমার দেখা রাজনীতির ৬৫ বছর ‘টুইন টাউয়ারের অন্তর।”
১৯৭৩ সালে এবং ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই মহান ব্যক্তিটি ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখে এই আলো-ছায়ার পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করে আমাদের সকলকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।