নারী মুক্তি, নারী শক্তি ◼️ মো আবদুল মতিন শিপন

জনতার কন্ঠ, 7 March 2025, 76 বার পড়া হয়েছে,

নারীর অগ্রগতিতে নারীকেই সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হবে। ষাটের দশকের নারী আর আজকের নারীর মাঝে কতখানি তফাৎ তা লক্ষণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে ও পরে নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক মর্যাদা, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, নারীর নিরাপত্তা, ধর্মীয় বিশ্বাসে নারী কতখানি মুক্ত, কতখানি সমৃদ্ধ হয়েছে—এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না, নিশ্চয় বিজ্ঞজনেরা দিতে পারেন। তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান অনেকটা পরিবর্তিত হলেও, এখনও সমাজের অনেক স্তরে নারীরা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

এখনকার নারী অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করতে পারছেন, নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন, তবে সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ। গ্রামের নারীরা এখনও নানা ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক মর্যাদা এই সমস্ত ক্ষেত্রেই অনেক দুর্বল অবস্থানে রয়েছেন। বর্তমান ডিজিটাল যুগে, যেখানে তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছে, সেখানে নারীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছেন, তবে এখনও দেশের বেশিরভাগ নারী প্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নারীরা যদি নিজেদের ক্ষমতাবান করতে পারতেন, তবে তারা নিজেদের চিন্তা-ভাবনা এবং কাজের মাধ্যমে সমাজে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারতেন।

নারীকে নারী থেকে মানুষ হওয়ার জন্য তার পথ তাকেই খুঁজে নিতে হবে। সে সিদ্ধান্ত নিবে কোন পথে সে হাঁটবে। শহর হোক আর গ্রাম হোক, সব স্তরেই নারী বঞ্চিত হচ্ছে, অত্যাচারিত ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যা মোটেও কাম্য নয়। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর বঞ্চনার গল্প প্রতিনিয়ত খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাওয়া যায়। পুরুষ শাসিত সমাজকে আমি একা দোষারোপ করব না, নারীর নিজেরও দোষ রয়েছে নারী হিসেবে পিছিয়ে পড়ার। নারীরা যখন নিজেদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে, প্রতিযোগিতা বা ঈর্ষা প্রকাশ করে, তখন তাদের সংগ্রামের গতি আরও ধীর হয়ে যায়। সামাজিক সংস্কারের প্রচেষ্টা সফল হতে পারে, তবে এর জন্য নারীদের নিজস্ব চেতনা ও সমর্থন জরুরি।

নারী যখন বৌ থেকে শাশুড়ি হয়, তখন তার ছেলের বৌ যখন নতুন বিয়ে হয়ে তার বাড়িতে আসে, সেই শাশুড়ি তার ছেলের বৌ’কে কতখানি সৌজন্যবোধের সাথে স্বাগত জানায়, কিংবা কতখানি নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সহযোগিতা করে, তা আমরা সকলেই জানি। এখন যিনি শাশুড়ি হয়েছেন, তার জীবনের না পাওয়া সকল অপূর্ণতা ঢেলে দিতে চাই পুত্রবধূর ঘাড়ে। মা হিসেবে যখন নারী থাকে, তখন কি বড় মাছের অংশটা মেয়ের পাতে তুলে দেয়? কখনোই দেয় না। বরং ছেলের পাতে বড় অংশটা যায়, আর লেজের অংশ হয়ত মেয়ের পাতেই যায়।
তাহলে কি আমি এখানেও বলব, পুরুষ শাসিত সমাজ দায়? সেই মা’ই কি শিখায়নি “লিঙ্গ বৈষম্য”?

একটা ছেলে যত বড় হতে থাকে, সে তত স্বাধীন হতে থাকে। আর একটা মেয়ে যত বড় হতে থাকে, সে তত ঘরবন্দী, পরাধীন হতে থাকে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশে এখনও দৃশ্যমান। যাদের পরিবারের সদস্যরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় আচ্ছন্ন, তাদের জন্য নারীকে স্বাধীনতা দেয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের জন্য, বিশেষ করে গ্রামে, অনেকসময় বিয়ের পর পরিবার তাদের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয় এবং তাদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। এমনকি শহরে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, স্কুল, কলেজ, অফিস কিংবা চাকরি, সব জায়গায় তাদের ওপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়।

তাহলে কোথায় নারী-পুরুষের সমতা? কোথায় লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা করা নারী নেত্রীরা? যে বাহিরে নারী গৃহকর্মীর অধিকার নিয়ে গলা ফাটাচ্ছে, আদতে গিয়ে দেখবেন তার বাসাতেই সেই গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কর্মস্থলে নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, তাছাড়া পরিবারের চাচাতো ফুফাতো ভাইয়ের কাছেও ছোটবেলায় যৌন হয়রানির মত চিত্র জীবনের প্রারম্ভিকেই বিষাক্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে। এগুলোতেও মা হিসেবে অসচেতনতা দায়ী বলে আমি মনে করি। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য শুধু শ্রম বা কাজের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, তা রয়েছে আচার-ব্যবহার, সামাজিক মর্যাদা, এবং অধিকারের ক্ষেত্রেও।

বয়সন্ধিকালীন সময়েও একজন মা তার মেয়ের স্বাস্থ্যসেবা কতখানি নিশ্চিত করেন, তা’ও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ। একজন মা’ও কতখানি সচেতনতাসম্পন্নভাবে কন্যা সন্তানের সামনে তার যৌন চাহিদার প্রকাশ ঘটায়, এসবও কিন্তু বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশের অনেক পরিবারে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে, নারীদের যৌন শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হয় না। এটা শুধু নারী নয়, বরং সমাজের প্রতিটি সদস্যের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নারীর মৌলিক অধিকার, শারীরিক স্বাধীনতা এবং জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো দরকার।

উচ্চশিক্ষায় নারীরা পিছিয়ে, অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া, কর্মবিমুখ করা—এগুলো নারী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পিছনে যতখানি ভূমিকা পুরুষ শাসিত সমাজের, ততখানি মা হিসেবে নারীর সদিচ্ছার অভাব। আজকের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছা জাগরণ ঘটাতে পারে নারী মুক্তির। নারীরা যদি নিজের ইচ্ছাশক্তির ভিতকে মজবুত করতে পারেন, তবে তারা কোনো বাধা ছাড়া এগিয়ে যেতে পারবেন।

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার নামই হল জীবন। নারীকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে উদ্যোক্তা হতে হবে। পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সমাজের প্রচলিত কাঠামো কখনোই নারীর মুক্তি এবং শক্তি অর্জনে সহায়ক হবে না। নারীর প্রকৃত মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন সমাজের প্রতিটি স্তরের নারীই তার নিজস্ব ক্ষমতাকে উপলব্ধি করে এবং নিজের জন্য একটি সুষ্ঠু, সমৃদ্ধ জীবন গঠনে সক্ষম হয়।