পরিমনির ফ্রিজ ভর্তি শুধুই মিষ্টি। আমাদের ফ্রিজে আজকে কোনো মিষ্টি নেই। গতকালও ছিল না। এমনকি গত মাসেও ছিল না। ঠিক কতদিন আগে ছিল তাও মনে নেই। আমার মত দেশের আরও লাখ লাখ মানুষের ঘরের ভিজে সব সময় মিষ্টি থাকে না। কারণ মিষ্টি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার অন্যতম উপকরণ নয়। আবার ডায়াবেটিকসহ নানান রোগের জটিলতা এড়াতে অনেকে মিষ্টি এড়িয়ে চলেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষই মিষ্টি খান অনিয়মিতভাবে। নিয়মিত মিষ্টি খাওয়ার লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কাজেই কারো ফ্রিজে মিষ্টির থাকা না থাকাটা আমাদের জাতীয় কোনো সমস্যাও নয়। মিষ্টি তো দূরের কথা, কারো বাসায় ফ্রিজ থাকাটাও আমাদের মৌলিক চাহিদার মধ্যে পড়ে না। ফলে কার বাসায় ফ্রিজ আছে কি নাই- এই বিষয়টি নিয়েও আমাদের উদ্বেগ বা আনন্দিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কারো বাসায় যদি খাবার না থাকে- এই বিষয়টি তাদের জন্য যেমন উদ্বেগের, তেমনি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ।
এই যে সদ্য সকালটা পেরোলো, সকালে দেশের কতটি শিশু ঘরে খাবার না থাকার কারণে না খেয়ে থেকেছে, এক বোতল দুধের জন্য চিৎকার করে কাঁদছে কত শিশু- এই এই হিসেব দেশের কোনো সংবাদমাধ্যমের কাছে আছে ? রাজনীতিবিদ, সরকারি দপ্তর বা জনপ্রতিনিধিদের কাছে আছে ? না, নেই। আসছে দুপুরে খাবারের জন্য এখনো কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি কোন পরিবার- এই সংবাদ কি আছে ? না, নেই। আজ যে রাতটি আসবে- সেই রাতের কারা খাবার জোগাড় হবে না- এই তথ্যটি কারো কাছে আছে, না, এটিও নেই।
গত ২৭ মার্চ জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে বিশ্বে প্রতিদিন অনাহারে থাকছে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ। জাতিসংঘ কোন হিসেবে এই তথ্য প্রকাশ করেছে তা জানি না, তবে প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাটি ৮০ কোটিরও বেশি হবে। কারণ এই রিপোর্ট প্রকাশ করার সময় তারা আমার বা আপনার তথ্য নেয়নি । নিলে সংখ্যাটি আরো বেশি হত। আমাদের দেশেও প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষ মানুষ কোনো না কোনো কারণে না খেয়ে থাকে। ব্যস্ততা, অসুস্থতা ছাড়াও যার উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা হচ্ছে খাদ্যের জোগান না থাকা।
কথা ছিল- আমাদের সংবাদ মাধ্যম খাদ্য জোগাড় করতে না পারা অসহায় শিশুটির এবং তার পরিবারের সমস্যার কথা গণমাধ্যমে তুলে ধরবে। ছিল কথা ছিল- গণমাধ্যমগুলো হাজারো নিয়মের ভিতরে লুকিয়ে থাকা একটি অনিয়ম কে খুঁজে বের করবে অথবা হাজার হাজার অনিয়মের ভিতরের থেকে ক্ষুধার্ত মানুষের কথা তারা তুলে ধরবে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, দেশের প্রায় সকল ধরনের গণমাধ্যমগুলো তাদের অনলাইন সংস্করণে এমন কিছু সংবাদকে শিরোনাম করে নিয়ে আসে। যা সাধারণের মানুষের জানার, আলোচনা করার, চর্চা করার কথা নয়। এবং শিরোনামগুলো এত উদ্ভট, অশ্লীল এবং অপেশাদার যে ভাবতে অবাক লাগে এদেরকেই জাতির বিবেক বলে ? মাঝে মাঝে তারা খুঁজে খুঁজে নায়িকা বা মডেলদের এমন কিছু ছবি সংবাদ মাধ্যমে সংযুক্ত করে যা মোটেই সংবেদনশীল নয় ।
মসজিদ হোক আর মন্দির হোক, স্কুল হোক আর সচিবালয় হোক, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কম বেশি দুর্নীতি, অনিয়ম হচ্ছে, যা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এসবের খবর ঢাকা পড়ে যায় কোন নেতার কার বউয়ের সাথে সম্পর্ক, কার মেয়েকে কাকে নিয়ে ভেগে গেল, তথাকথিত কোন সেলিব্রেটি কার বাড়িতে খেতে গেল, কি কাপড় পরল, কোথায় বেড়াতে গেল, তার জুতোর দাম কত, তার ঘড়ির দাম কত, তার ব্যাগের ভিতর কি কি আছে ? এসব নিয়ে হামেশাই অনলাইন মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলো নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। বর্তমানে মিডিয়াগুলো যেন সমাজের চোখ না হয়ে আজ মানুষকে বিনোদন দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। জাতীয় সমস্যাগুলোকে আড়াল করে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বেশি পছন্দ করেন।
তাদের এই নাড়াচাড়ার আড়ালে থেকে যায় প্রতিবেলা না খেয়ে থাকা অসহায় নারী পুরুষ শিশুদের কথা। আড়ালে থেকে যায় দিনমজুর বাবা অথবা সরকারি বেসরকারি অফিসে স্বল্প বেতনের চাকরি করা বাবার ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফিস, সেশন ফি দিতে না পারার কথা। আড়ালে থেকে যায় চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরেও একজন শিক্ষক বা একজন কর্মচারীর বকেয়া বেতন অথবা পেনশন না পাওয়ার কথা। অর্থের অভাবে লেখাপড়া বা চিকিৎসা নিতে না পারা হাজারো মানুষের কথা গণমাধ্যমে আড়ালেই থেকে যায়।
আজকাল দেখি অনেক টিকটকারদের স্টাইল নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে দেশের সুনামধন্য স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। কিন্তু দেশের পাড়া-মহল্লায়, শহরে-গ্রামে-গঞ্জরে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তেমন কোনো অনুষ্ঠান হয় না। শত প্রতিকূলতা জয় করেও যে ছেলেটি পরিবারের হাল ধরেছে, সমাজের নানা বাধা পেরিয়ে যে মেয়েটি সংসারের হাল ধরেছে। নিজে লেখা না পড়া না পড়ে ছোট ভাইবোনদেরকে পড়াশোনা করাচ্ছে- এই ধরনের আত্মপ্রত্যয়ই, অদম্য, সংগ্রামী মানুষের খবর দেশের গণমাধ্যমে কয়টি আসে ? আসলেও কি তা ভাইরাল হয় ? আমরা পড়ি !
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পৌনে দুই লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক বাড়িঘরে এখনো জ্বলছে না চুলায় আগুন। অনাহারে অর্ধ হারে অথবা শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করছেন সেখানকার নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, তরুণ, এমনকি ছোট শিশুরাও। আর আমাদের অবিবেচক সাংবাদিকরা পড়ে আছেন পরিমসির ফ্রিজের মিষ্টির খবর নিয়ে। পরিমনির বেডরুমের খবর তো তারা আরো আগেই ভাইরাল করেছে, এখন বের করল ফ্রিজের খবর। সামনে বাথরুমের খবর নিতেও সাংবাদিকরা সেখানে পৌঁছাবেন কি না, আল্লাহই ভালো জানেন।
পরিমনির ফ্রিজ ভর্তি শুধুই মিষ্টি। গুরুত্বপূর্ণ এই সংবাদটি (!) প্রকাশ করেছে দেশের প্রথম সারির একটি অনলাইন পত্রিকা।। আমার এই পত্রিকাটির নাম উল্লেখ করিনি কারণ- এইরকম নিউজ হরহামেশাই অনেক পত্রিকাই করে থাকে। আমার বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে লিংকে গিয়ে ঢুকে দেখি বিষয়টি কি, পরিমনি কি আবার বিয়ে করলো, নাকি আবার মা হতে চলল। বিয়ে হয়ে থাকলে তার নতুন স্বামী কে অথবা নতুন সন্তানের বাবা কে? সন্তানের নামই বা কি ? পরে ভাবলাম না, লিঙ্কে ঢুকব না। উদ্ভট সংবাদ আর শিরোনাম দিয়ে কার সংবাদ শিকারিদের ফাঁদে পা জড়াবো না। এই ফাঁদ যারা তৈরি করার জন্য তাদের শাস্তিও চাইবো না। বরং আল্লাহর কাছে দোয়া করব আল্লাহ তায়ালা যেন তাদের বিবেক বুদ্ধি বাড়িয়ে দেন। তাদের আরো মানবিক মানুষ, মানবিক সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলেন। আর এই দোয়া যদি কবুল না হয় তাহলে অন্তত আমাদের কাউকে যেন এমন অপসাংবাদিকতায় না জড়ান।
লেখক : মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, সম্পাদক, সংগঠক
৩০ মে ২০২৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
(পরিমনিকে নিয়ে কিছু লিখে সময় নষ্ট করা এবং এই লেখায় পরিমনির নাম ও ছবি ব্যবহার করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।)