অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের ২১তম মৃতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা

জাতীয়, 28 October 2023, 169 বার পড়া হয়েছে,

হালিমা খাতুন : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (বাচ্চু মিয়া নামে পরিচিত) ১ আগস্ট ১৯২৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নুরুল হুদা ও মাতা জাহেদা খানম। সিরাজুল হক আব্দুস সামাদের কন্যা জাহানারা হককে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার সন্তান। তিনি ২৮ অক্টোবর ২০০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজুল হক হাজী মুহাম্মদ মহসিন বৃত্তি পেয়েছিলেন। তা দিয়েই তিনি লেখাপড়া করেছেন।

তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী ও অন্যতম সহচর ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল মধুর, সিরাজুল হকের ডাক নাম বাচ্চু। বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম খোকা। দুজনের মধ্য সম্বোধন ছিল ডাক নামেই।
সিরাজুল হক ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে কসবা বুড়িচং নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন কুমিল্লা-৪ (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ কসবা-আখাউড়া) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০২২ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।

সিরাজুল হক ছাত্র জীবন থেকেই কসবাতে প্রতি মাসে আসা-যাওয়া করতেন। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে নভেম্বর মাসে কসবা হাইস্কুলে মাঠের জনসভা বঙ্গবন্ধু এলেন দুপুর প্রায় ১২টায়। স্কুল মাঠে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সিরাজুল হক মঞ্চে উঠে প্রথমে যে বক্তব্য রাখলেন তাতে এত বড় জনসমাগমেও পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়েই ছয় দফা ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের অনেক নিবেদিত ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মীও সমালোচনামুখর হলেন। কারণ ওই সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পাট ক্ষেত ও ধান ক্ষেতের আড়ালে পালিয়ে যেতেন। আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দেশের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে দলীয় পরিচিতির আবডালে রেখে নির্বাচনী অভিযান পরিচালনার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, তা একজন মেধাবী আইনজীবীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি বলতেন আইনজীবীরা শুধু আইনের উপজীব্য করে না তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, তাই আইনজীবীদের অপর নাম কৌঁসুলি।
অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম প্রধান কৌঁশলী ছিলেন। কিংবদন্তী এই আইনজীবী একক নেতৃত্বে থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনা করেছেন। শুরু করেছিলেন জেলহত্যা মামলা। তা ছাড়াও অসংখ্য চাঞ্চল্যকর মামলার সফল কৌঁসুলি তিনি। অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌঁশলীর দায়িত্ব পালন করেন তাঁর ছেলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এডভোকেট সিরাজুল হকের সুযোগ‍্য সন্তান আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক কসবা আখাউড়াতে যে উন্নয়ন করেছেন সেই জন্য কসবা আখাউড়ার মানুষ সারাজীবন মনে রাখবে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর সিরাজুল হক নিজের এলাকায় এলেন এবং বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে এলাকার নেতা কর্মীদের ধারণা দিলেন। তিনি এলাকায় বেশিদিন অবস্থান করতে পারেননি। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান রচনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। দেশের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সংবিধান রচনার কাজ সমাপ্ত করলেন। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন তিনি ভারাক্রান্ত মনে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী মোশতাকের মুখের ওপর তিনি বলেছিলেন ‘আপনি অবৈধ, আপনার সংসদ মানি না।’

১৯৭৯ সালে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল এমএজি ওসমানীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে তিনি সক্রিয় ছিলেন। নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী হেরে গেলে তিনি দীর্ঘদিন নীরব ছিলেন এবং নিজের আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।

আমার বাবা গৌরাঙ্গ চন্দ্র ভৌমিক সব সময় প্রখ‍্যাত আইনজীবী এডভোকেট সিরাজুল হকের কথা বলতেন। বোরো ধানের জমিতে সেচের জন্য তিনিই সর্ব প্রথম ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করেছেন। এই জন্যই এলাকার লোকজন কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে সব সময়।

আমার বড় ভাই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ইন্দুভূষণ ভৌমিক ছাত্র জীবন শেষে কসবার সন্তান হিসেবে এডভোকেট সিরাজুল হকের চেম্বারে গেলে লাইব্রেরী দেখিয়ে বলেন আইনজীবী হতে হলে পড়তে হবে ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে ।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনী জনসভায় আমার গ্রামে এডভোকেট সিরাজুল হককে প্রথম দেখেছিলাম। তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। শিমরাইল যুব সমাজ কল‍্যাণ সংগঠনের সদস্যরা তখন নৌকার পক্ষে নির্বাচন করেছিলেন। আমি ভোটার ছিলাম না, কিন্তু নির্বাচনের মিছিলে যেতাম এবং নৌকায় নৌকায় বলতাম। আমার মা অপেক্ষা ছিলেন কখন গিয়ে শেখের বেটির মার্কা নৌকায় ভোট দিবেন। এই মহান ব‍্যক্তিটির প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা তখন থেকে আজও বিন্দুমাত্র বিচ‍্যুত হয় নাই। ধর্মনিরপেক্ষ ও আকাশচুম্বী প্রতিভার অধিকারী এই মহান ব্যক্তিত্বের সানি্নধ্য আমাদের জীবনকে মহীয়ান করেছে, তা আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে যখন সিরাজুল হক স‍্যারের চেম্বারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই তখন মনটা কেদেঁ উঠে স‍্যারের সঙ্গে থাকতে পারলে অনেক কিছু শেখা যেত। কসবা আখাউড়ার প্রত‍্যকটি গ্রামে জাতীয় ভাবে এডভোকেট সিরাজুল হকের মৃত্যু বার্ষিকী পালন করলে এই প্রখ্যাত আইনজীবীর অবদান নতুন প্রজম্ম জানতে পারবে। ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।