স্বাধীনতা শব্দটি একটি স্বপ্নের নাম -কোহিনূর আক্তার প্রিয়া

মতামত, 26 March 2023, 133 বার পড়া হয়েছে,
বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতা শব্দটি বহু প্রতীক্ষিত একটি স্বপ্নের নাম। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা ছিলাম পরাধীন একটি জাতি। ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ তারিখে সেই শৃঙ্খল থেকে চিরতরে মুক্তির লড়াই শুরু হয়। শত্রুর হাত থেকে স্বদেশ ভূমি তখনও মুক্ত না হলেও মনে মনে আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবতে শুরু করি এদিন থেকেই। তাই ২৬শে মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙানাে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন।
২৬ মার্চ ১৯৭১, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নামের অন্তর্ভুক্তি ঘটে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এ দিনটিকে ঘিরে রচিত হয়েছে। এ দিনের নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথা মনে পড়ে, তা হল এ দেশের অসংখ্য দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের ২৪ বছরের গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খুজে পেয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙানাে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। ২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা এ দেশের শ্যামল ভূমিতে ওঠাতে  সক্ষম হয়েছিল।

পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দেয়ার পর থেকেই মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে রােধ করার জন্যে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৫২ সালে পুনরায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘােষণা দিলে ছাত্র জনতা পুনরায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্যে গুলি চালানাে হয়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার বরকতসহ আরও অনেকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় লাভ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয়।

তখন থেকেই স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তাঁকে আটকে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ  সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বলে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সারা বাংলায় শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। পঁচিশে মার্চের রাতের অন্ধকারে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ। ২৫ মার্চ গভীররাতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।

পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা করেন। আহ্বান করেন বাঙালি সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্যে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, অসংখ্য ঘুমন্ত বাঙালি হত্যা এবং পরবর্তী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার মধ্য দিয়ে বাঙালিরা দেশকে শত্রু মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আধুনিক প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে গড়ে তােলে প্রতিরােধ ব্যূহ। হানাদার বাহিনীও নিরস্ত্র মানুষদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে।

অগণিত ঘর-বাড়ি তারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যাকে পায় তাকেই গুলি করে মারতে থাকে। গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি ইত্যাদি ধরে নিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড এক ভুতুড়ে রাজ্যে পরিণত হয়। এ অবস্থায় সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত বাঙালি সদস্য, আধা-সামরিক লােকজন, পুলিশ, আনসার অনেকেই বিদ্রোহ করে বাঙালিদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ক্রমে ক্রমে মুক্তিযোেদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের সর্বত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাজেহাল হতে থাকে। দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ফলে হানাদার বাহিনী আরও বিপাকে পড়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযোেদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী ক্রমেই বিপর্যস্ত হতে থাকে। এমনি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। এ সুযােগে ভারতের সেনাবাহিনী সরাসরি মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মওকা পেয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ জিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জিত হয়।

আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা যেমন তাৎপর্য বহন করে, তেমনি লক্ষ লক্ষ ক্লিষ্ট ও আর্তমানুষ যাতে জাতীয় পতাকাকে সমুন্নত রেখে নতুন জীবনকে পাথেয় করে নিজেদের গড়ার শপথ নিতে পারে সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। তাহলেই আমরা নতুন স্বপ্ন-সম্ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠব এবং দুঃখ-বেদনা ক্ষণকালের জন্য হলেও ভুলতে পারব। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি বটে, কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনাে আসে নি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেই আমাদের স্বাধীনতার রূপ পূর্ণাঙ্গ হবে। তাই এই নতুন রাষ্ট্রকে নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বিতাড়িত করতে হবে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বেকারত্ব, বুভুক্ষা ও দারিদ্র। তবেই না আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারব। তাই আসুন সবরকম বিভেদ-বিচ্ছেদ ভুলে, হানাহানি সংঘাত ভুলে, সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হই।

কোহিনূর আক্তার প্রিয়া, নারী সংগঠক ও সমাজসেবক